স্বপ্ন দেখা ভাল। কিন্তু সেই স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে মস্তিষ্ক এবং পরিশ্রমকে কাজে লাগাতে হয়। না হলে ভাল কিছু করা যাবে না। আর ভাল কিছু না করতে পারলে ক্লাব প্রশাসনে গদি আঁকড়ে বসে থেকো না।
নিজস্ব ভঙ্গিতে ধীরে-সুস্থে কথাগুলি বলতেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের অন্যতম প্রাণপুরুষ প্রয়াত দীপক (পল্টু) দাস। ময়দানের জনপ্রিয় সেই ‘পল্টুদা’-র এই কথাগুলোকে মাথায় রেখেই লাল-হলুদ তাঁবুর ভোল পালটে দিতে চলেছেন তাঁর শিষ্যরা। পয়লা অগস্ট নবরূপে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে ইস্টবেঙ্গল তাঁবু।
এই মুহূর্তে ভারতের অন্যতম সেরা ফুটবল ক্লাবের অত্যাধুনিক তাঁবুর মধ্যে কী কী থাকছে? অত্যাধুনিক জিম, জাকুজি, কফি শপ, রেস্তোরাঁ, চিকিৎসক-সহ চব্বিশ ঘণ্টার মেডিক্যাল রুম থেকে বর্ষীয়ান সদস্যদের গ্যালারিতে পৌঁছোনোর লিফ্ট। কী না নেই সেই কর্মযজ্ঞে। ক্লাব তাঁবুর আধুনিক পরিকাঠামোর জন্য দেশের বাকি ক্লাবগুলোর কাছে আপাতত লাল-হলুদ সমর্থকদের গর্বের রিংটোন, ‘ম্যায় খিলাড়ি তু আনাড়ি’।
বেহালার ইস্টবেঙ্গল-অন্ত প্রাণ অভিজিৎ সরকার যেমন ক্লাব তাঁবুর পরিকাঠামো উন্নয়নের প্রশ্ন উঠতেই চিমটি কেটে বসলেন পাশের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবকে। শিক্ষা দফতরে কর্মরত অভিজিৎবাবুর সোজা-সাপটা জবাব, “এত দিন কংক্রিটের গ্যালারি এবং ফ্লাডলাইট নিয়ে পাড়ার আড্ডায় অনেক কিছুই শুনতে হত। এ বার আমরা বলব। বাকিরা শুনবে।” |
একই বক্তব্য বালিগঞ্জের সত্তরোর্ধ্ব দেবদাস গঙ্গোপাধ্যায়ের। ষাট-সত্তরের দশকে লাইন দিয়ে সবুজ গ্যালারিতে খেলা দেখতে আসতেন। শান্ত মিত্র-পরিমল দে, হাবিব, সুধীর, শ্যাম, সুরজিৎদের কথা উঠলেই ফিরে যান নিজের যৌবনে। সেই দেবদাসবাবু সদস্য গ্যালারিতে লিফ্ট বসতে চলেছে শুনে বলেই বসলেন, “আমার মতো বয়স্কদেরও কথা ভাবা হয়েছে জেনে আনন্দ হচ্ছে। বহু দিন মাঠে যাই না। এ বার আবার যাব।”
কী কী থাকছে নতুন তাঁবুর ভিতর? লাল-হলুদের অন্যতম শীর্ষ কর্তা দেবব্রত (নীতু) সরকার বলছেন, “বিপক্ষ দলের অত্যাধুনিক ড্রেসিংরুম, ম্যাচ কমিশনার-রেফারিদের ঘর, মহিলা সদস্যদের বসার ঘর, মিডিয়া রুম, ডোপিং রুম সব থাকছে নতুন। থাকবে গ্যালারির মাথায় শেডও। সব কিছু ঠিকঠাক চললে ফ্লাড লাইটও বসবে আগামী দিনে।”
সুধীর কর্মকারের মতে, “আমাদের সময়ের চেয়ে ইস্টবেঙ্গল তাঁবু এখন অনেক ভাল হয়েছে। এতে মেহতাবদের সুবিধা। সুবিধা ক্লাবেরও। এটা শুনে আরও ভাল লাগছে, নতুন ইস্টবেঙ্গল তাঁবু যাত্রা শুরু করবে আমার মতো প্রাক্তনদের সঙ্গে নিয়ে।” কিন্তু হঠাৎ এই বিশাল কর্মযজ্ঞের কারণটা কী? দেবব্রতবাবু ফের বললেন, “আসিয়ান কাপ জয়ের পর থেকেই আন্তর্জাতিক মানে ক্লাবকে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। নির্বাচনের আগে সদস্যদের লিফলেট বিলি করে এই পরিকল্পনা জানানোও হয়েছিল। এ বার তা বাস্তবায়িত হল। কথা দিলে কথা রাখতে হয়এই ব্যাপারটা আমাদের শিখিয়ে গিয়েছেন পল্টুদা। আমরা সে পথেই চলছি বলতে পারেন।” |
দেবব্রতবাবুর কাছে জানা গেল, জিম এবং নতুন তাঁবুর উদ্বোধনের দিন থাকবেন লাল-হলুদের প্রাক্তন ফুটবলাররাও। দেবব্রতবাবু বলছেন, “আমাদের কাজ আশি শতাংশ সম্পূর্ণ।”
গৌতম সরকার জানালেন, “ইস্টবেঙ্গল তাঁবু নতুন সাজে সেজে উঠছে শুনেই মনটা ভাল হয়ে গেল। আমার ফুটবল-জীবনে সাফল্যের সূচনা ওই তাঁবু থেকেই। আধুনিক ব্যবস্থা এবং জিমন্যাসিয়াম ফুটবলারদের উদ্বুদ্ধ করতে সাহায্য করবে।”
ময়দানে একটা ইট গাঁথলেও যেখানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে উত্তেজনার চোরাস্রোত বয়ে যায় সেখানে এত কিছু নির্বিঘ্নে? উত্তরে সচিব কল্যাণ মজুমদার এবং সহ-সচিব শান্তিরঞ্জন দাশগুপ্ত যা বললেন তার নির্যাস, “কর্মসমিতির সর্বসম্মত সিদ্ধান্তগুলো দিল্লি থেকে ফোর্ট উইলিয়াম দৌড়াদৌড়ি করে কার্যকর করার নেপথ্য নায়ক একজনই। তিনি দেবব্রত সরকার।” যা শুনে দেবব্রতর বিনয়ী উত্তর, “এটা কোনও ব্যক্তিবিশেষের প্রয়াস নয়। এটা ইস্টবেঙ্গলকে আধুনিকতার সরণিতে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দলগত সফল উদ্যোগ।” তিরানব্বই বছর আগের এক ২৮ জুলাই-এর ঘটনা। বছরটা ১৯২০। কোচবিহার কাপের ম্যাচে মোহনবাগানের মুখোমুখি জোড়াবাগান ক্লাব। জোড়াবাগান দলে সে দিন কোনও এক অজ্ঞাত কারণে জায়গা হয়নি ওপার বাংলার শৈলেশ বসুর। যে ক্ষোভ আর আত্মসম্মানবোধের ফলশ্রুতি, তার কয়েক দিন পরেই ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জন্ম। শতবর্ষের প্রাক্কালে ক্লাব তাঁবুর এই আধুনিকীকরণ কি ইস্টবেঙ্গলের প্রতিবেশী দুই শতাব্দীপ্রাচীন ক্লাবকে কিছুটা হলেও টেক্কা দিচ্ছে? মোহনবাগান কর্তারা এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে না চাইলেও মহমেডান কর্তা ইকবাল আহমেদ বলছেন, “ভালই তো। এখান থেকে আমরাও কিছু শিখতে পারব।” আর দেবব্রতবাবুর সপ্রতিভ জবাব, “আমাদের আধুনিকতাই যথেষ্ট। অন্যদের নিয়ে মন্তব্য করার মানসিকতা বা রুচি কোনওটাই নেই।”
|