বেনিয়াপুকুরের নার্সিংহোমে চিকিৎসককে থাপ্পড় মারার অভিযোগ স্বীকার করে নিলেন অভিযুক্ত। সোমবার তাঁকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে অবশ্য তিনি জামিনে ছাড়া পান।
রবিবার সন্ধ্যায় অভিযুক্তের বাবার চিকিৎসার জন্য নার্সিংহোমের ডিসচার্জ সার্টিফিকেট দেখতে চান দিলনওয়াজ আহমেদ নামে এক চিকিৎসক। তিনি পুলিশের কাছে অভিযোগে জানান, ডিসচার্জ সার্টিফিকেট দেখতে চাইতেই তাঁকে কষে দুই থাপ্পড় মেরেছেন তালবাগান এলাকার বাসিন্দা আসিফ খান। তাঁকে ভয় দেখানো হয়েছে। ফের মারা হবে বলে হুমকিও দেওয়া হয়েছে। পুলিশকে ওই চিকিৎসক এ-ও জানান, থাপ্পড় খেয়েও তিনি ওই রোগীকে ভেন্টিলেশনে ঢুকিয়ে চিকিৎসা করিয়েছিলেন।
ঘটনাচক্রে এ দিন সকালে অন্য একটি নার্সিংহোমে আসিফের ৯২ বছর বয়সী বাবা মারা যান। সোমবার অভিযুক্ত আসিফ খান স্বীকার করেন, মাথা গরম হয়ে যাওয়ায় তিনি ওই চিকিৎসককে থাপ্পড় মেরেছেন। একই সঙ্গে অভিযুক্ত জানান, তিনিও ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগ করবেন পুলিশের কাছে। এই ঘটনায় নার্সিংহোম থেকে সিসিটিভি-র ফুটেজ চেয়ে পাঠিয়েছে পুলিশ। ওই ফুটেজে চড় মারার স্পষ্ট ছবি রয়েছে বলে নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষের দাবি। |
থাপ্পড়ের এই ছবি ধরা পড়েছে নার্সিংহোমের সিসিটিভি-তে। ছবি: এবিপি আনন্দ
|
কী হয়েছিল রবিবার সন্ধ্যায়?
দিলনওয়াজ সোমবার দাবি করেন, নার্সিংহোমের চারতলায় তিনি অন্য রোগী দেখতে ব্যস্ত ছিলেন। রিসেপশন থেকে তাঁকে ফোন করে বলা হয়, আশঙ্কাজনক অবস্থায় এক রোগী এসেছেন। তাঁকে সম্ভবত আইসিইউ-তে ভর্তি করতে হবে। আইসিইউ-য়ের চিকিৎসক অন্য এক রোগীকে নিয়ে ব্যস্ত। দিলনওয়াজ যদি ওই রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা কী হবে তা বলে দেন, তা হলে ভাল হয়।
ওই চিকিৎসক আরও জানান, মহম্মদ ইউসুফ খান নামে সেই বৃদ্ধকে রিসেপশনের সামনে স্ট্রেচারে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। নার্সিংহোমের কর্মীরা তাঁকে জানান, সুস্থ হয়ে ওঠায় সকালে ওই বৃদ্ধকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। আবার অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে ফের সেখানে ভর্তি করাতে নিয়ে এসেছেন তাঁর বাড়ির লোকজন।
দিলনওয়াজের দাবি, তিনি রোগীর ছেলে আসিফকে বলেন, তাঁর অধীনে আগে তাঁর বাবার চিকিৎসা হয়নি। বাবাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময়ে নার্সিংহোম থেকে তাঁকে যে ডিসচার্জ সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছিল, তাতে কী চিকিৎসা হয়েছে, কী ওষুধ দেওয়া হয়েছে সব লেখা রয়েছে। সেই সার্টিফিকেট না দেখালে চিকিৎসা শুরু করতে দেরি হয়ে যাবে।
ওই চিকিৎসক বলেন, “বলা নেই, কওয়া নেই, আসিফ আমার কানের পাশে কষে পরপর দু’বার থাপ্পড় মারলেন। মেরে বললেন, এটাই ডিসচার্জ সার্টিফিকেট!” ক্ষোভের সঙ্গে দিলনওয়াজ আরও বলেন, “রবিবার শহরে চিকিৎসকের অভাব থাকে। তা সত্ত্বেও প্রায় রবিবার আমি নুরউল্লা ডক্টর লেনের ওই নার্সিংহোমে গিয়ে রোগী দেখি। এই ভাবে নিগৃহীত হওয়ার পরে এই শহরে চিকিৎসা করার আর মানসিকতা থাকে না।”
ওই নার্সিংহামের ডিরেক্টর মহম্মদ শাহনওয়াজ জানান, আসিফ খান রবিবার সন্ধ্যায় কমপক্ষে হাজারখানেক বাইরের ছেলে জড়ো করেন নার্সিংহোমের সামনে। ওই চিকিৎসককে থাপ্পড় মারা হয়। নার্সিংহোমের অন্য এক কর্মীকেও মারধর করেন আসিফের লোকজন। শাহনওয়াজের দাবি, “তা সত্ত্বেও দিলনওয়াজ বৃদ্ধের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। পরে আমি আসিফকে বলি, আমি অ্যাম্বুল্যান্স জোগাড় করে দিচ্ছি। আপনি অন্য কোনও ভাল জায়গায় বাবাকে নিয়ে যান।”
অভিযুক্ত আসিফ বলেন, “৪৫ হাজার টাকার বিল মিটিয়ে বাবাকে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম। কী এমন চিকিৎসা হল, যাতে বাবা ফের অসুস্থ হয়ে পড়লেন? আর অসুস্থ অবস্থায় বাবাকে ওরা ছাড়লই বা কেন?”
নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ বলেন, “বয়সের ভারেই ইউসুফ খান ফের অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ওঁকে সুস্থ করিয়ে তবেই ছাড়া হয়েছিল। সেই অর্থে ব্যবসাই যদি করতাম, তা হলে রোগীকে ছাড়তামই না। রোগী থাকলে বিলের টাকাও তো বাড়ত।”
আসিফ খান সোমবার বলেন, “ছ’দিন ধরে ওই নার্সিংহোমে বিরানব্বই বছরের বাবার চিকিৎসা হয়েছে। নার্সিংহোম রবিবার সকালে বাবাকে ছেড়েও দেয়। ফের অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেই নার্সিংহোম যদি সন্ধ্যায় বাবাকে ভর্তি নিতে না চায়, তা হলে ছেলের মাথার ঠিক থাকে! কার না মাথা গরম হবে?”
নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ জানান, পুনরায় ভর্তি নিতে রাজি না হওয়ার অভিযোগ একেবারেই ঠিক নয়।
অন্য দিকে, রবিবার এক রোগী-মৃত্যুর ঘটনায় গাফিলতির অভিযোগ ওঠায় সোমবার বি এন বসু মহকুমা হাসপাতাল পরিদর্শনে গেলেন স্বাস্থ্য দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর এইচ কে চন্দ। এই হাসপাতালে আগেও একাধিক বার চিকিৎসায় গাফিলতি, চিকিৎসকদের দুর্ব্যবহার, সময়ে না আসার অভিযোগ উঠেছে। বসেছে তদন্ত কমিটিও। রবিবার তালপুকুরের বাসিন্দা আনোয়ার আলির মৃত্যুতে তাঁর পরিবার অভিযোগ করে, চিকিৎসক সময়মতো না আসায় মৃত্যু হয়েছে আনোয়ারের। ৬ জুনও এক রোগীর মৃত্যুতে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ ওঠে। এ দিন হাসপাতালের সব বিভাগ ঘুরে দেখে রোগী ও তাঁদের আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলেন স্বাস্থ্য-অধিকর্তা। তিনি বলেন, “সব খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” হাসপাতালের সুপার মৃদুল ঘোষ বলেন, “পরিকাঠামোগত কিছু সমস্যা আছে। তবে কয়েক জন চিকিৎসকের জন্য সকলকে বদনামের ভাগীদার হতে হয়, এটা ঠিক নয়।”
|