প্রেসার কুকার, নন-স্টিক কড়াই, স্টিলের বালতি, কফিকাপের সেট। কিংবা দেওয়াল ঘড়ি, মোবাইল ফোন। তালিকায় অটোম্যাটিক ইস্ত্রি, ট্রলিব্যাগ, মায় জলের ফিল্টারও বাদ নেই!
ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্সে ‘ধামাকা’ ডিসকাউন্টের ঘোষণা নয়। অধুনা রাজ্যের যে কোনও প্রান্তে স্বেচ্ছায় রক্তদান করলে এমন সব ‘উপহার’ মিললেও মিলতে পারে, শুধু লটারিতে শিকে ছেঁড়ার অপেক্ষা। রক্তদান শিবিরের উদ্যোক্তাদের একাংশের দাবি, সহজে রক্তদাতা মিলছে না বলেই তাঁরা রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিয়ে এই সব উপহারের কথা জানাতে বাধ্য হচ্ছেন। যা শুনে প্রমাদ গুনছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্তারা। তাঁদের মতে, এই প্রবণতা দানের রক্তে বিলক্ষণ দূষণের সম্ভাবনা তৈরি করছে।
বিভিন্ন রক্তদান শিবিরের উদ্যোক্তাদের আক্ষেপ, কলা-ডিম-পুষ্টি পানীয়, এমনকী বিরিয়ানি-মাংসের বন্দোবস্ত করেও সে ভাবে রক্তদাতা পাওয়া যাচ্ছে না। অগত্যা তাঁরা এই রাস্তা বেছে নিয়েছেন, সোজা কথায় যাকে ‘টোপ’ বলা যেতে পারে। শিবির চলাকালীন মঞ্চে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে আকর্ষণীয় উপহার, যাতে তা পথচলতি মানুষের চোখে পড়ে, এবং তার টানে তাঁরা রক্ত দিয়ে যান। অনেক জায়গায় লটারির মাধ্যমে রক্তদাতাদের ইনাম বিলি করা হচ্ছে। গত জানুয়ারিতে দক্ষিণেশ্বর ও উদয়রাজপুরের দু’টি ক্লাব রক্তদাতাদের স্টিলের বালতি ও বড় কিটব্যাগ দিয়েছে। মার্চে আলমবাজারের এক ক্লাব দিয়েছে ইস্ত্রি। এপ্রিলে কলকাতার মৌলালির এক ক্লাব আয়োজিত শিবিরে রক্তদানকারীদের কেউ কেউ পেয়েছেন জলের ফিল্টার। একই ভাবে সরকারবাগান, বাগবাজার, বেলেঘাটা-সহ একাধিক শিবিরে ‘স্বেচ্ছায়’ রক্তদাতারা পেয়েছেন টেবিল ফ্যান, প্রেসার কুকার, মিক্সার গ্রাইন্ডার।
এ ভাবে উপহারের লোভ দেখিয়ে রক্তদাতা জোগাড় করায় আপত্তি তুলছে স্বাস্থ্য দফতর। কর্তারা জানাচ্ছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র নির্দেশনামায় স্পষ্ট বলা আছে, স্বেচ্ছা রক্তদান শিবিরে দাতাদের আকৃষ্ট করতে কোনও উপহার দেওয়া যাবে না। ‘ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অফ ব্লাড ট্রান্সফিউশন’-এর রক্তদান সংক্রান্ত যে নীতি-নির্দেশিকা (কোড অফ এথিকস), তার ৩, ৪, ১৪ নম্বর ধারায় রক্তদাতাদের উপহার প্রদান পুরোপুরি অবৈধ ঘোষিত করা হয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, রক্তের বিনিময়ে উপহার দিলে ক্ষতিটা কী?
রাজ্যের রক্ত নিরাপত্তা বিভাগের ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর কল্যাণ মুখোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, “উপহারের লোভে অনেকে রোগ লুকিয়ে শিবিরে রক্ত দিচ্ছেন। অনেকে জানেন না, অ্যাম্পিসিলিন জাতীয় ওষুধ খেলে বা ডায়াবেটিস থাকলেও রক্ত দেওয়া উচিত নয়। এঁদের রক্ত অন্যের শরীরে গেলে তাঁর সমস্যা দেখা দিতে পারে।”
অথচ এ ভাবে শিবিরে সংগৃহীত রক্তই চলে যাচ্ছে মানিকতলার কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্ক-সহ বিভিন্ন ব্লাড ব্যাঙ্কে, এমনকী মেডিক্যাল কলেজগুলোতেও। সেখান থেকে তা বিভিন্ন রোগীর দেহে ঢুকছে। বিভাগের জয়েন্ট ডিরেক্টর অরবিন্দ বালার অভিযোগ, “বেসরকারি ব্লাডব্যাঙ্ক এক ইউনিট রক্ত আটশো টাকা-হাজার টাকায় বিক্রি করে। ওরাও তাই বেশি রক্ত জোগাড়ের তাগিদে দামি উপহার দিয়ে থাকে। অনেক সময় সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কের প্রতিনিধিরা কোনও শিবিরে গিয়ে উপহারের ব্যাপারটা জানতে পারলেও আমাদের খবর দেন না স্রেফ ঝামেলা এড়াতে।”
ফলে সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কেও দূষিত রক্ত চলে আসার প্রভূত আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য-কর্তারা। ডি আশিস, অচিন্ত্য লাহা বা দীপঙ্কর মিত্রের মতো রক্তদান-আন্দোলনকর্মীরা আবার অন্য প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের বক্তব্য: এক বার রক্ত দিলে তিন মাসের মধ্যে আর দেওয়া যায় না। অথচ উপহারের লোভে অনেকে নিয়মটা মানছেন না। তাঁদের দেওয়া রক্তে যথেষ্ট পরিমাণ হিমোগ্লোবিন থাকছে না। এতে গ্রহীতারই ক্ষতি ।
তবে রক্তদাতাদের উপহার দেওয়ার মধ্যে অপরাধের কিছু দেখছেন না সংশ্লিষ্ট শিবিরের আয়োজকেরা। ওঁদের সাফ কথা, “নিছক দানের জন্য রক্ত দেওয়ার দিন প্রায় শেষ। উপহার না-দিলে দাতা কমে যাচ্ছে। রক্তের আকাল হলে মানুষই সমস্যায় পড়বেন।” অনেকের মন্তব্য, “এটা দেওয়া-নেওয়ার যুগ। বেশির ভাগ দাতা উপহারের টানেই আসেন।” একটি শিবিরের উদ্যোক্তাদের পর্যবেক্ষণ, “লটারিতে প্রেসার কুকার দেওয়ার ঘোষণা করে ঘণ্টায় ৬০ জন রক্তদাতা পেয়েছি।”
অর্থাৎ উপহার নিয়ে ‘স্বেচ্ছায়’ রক্তদান চলছে-চলবে। স্বাস্থ্য-কর্তারাও কার্যত হাল ছেড়েছেন। “কিছুতেই কিছু করা যাচ্ছে না। স্বেচ্ছায় রক্তদানের ধারণাটাই প্রায় মুছে যেতে বসেছে।” আক্ষেপ করেছেন দফতরের রক্ত নিরাপত্তা বিভাগের এক কর্তা। |