কলাকেন্দ্রে ‘আলো আসুক।’ সামাজিক বন্ধুত্বের সাইট ফেসবুকে এমনই আর্জি জানিয়ে গ্রুপ তৈরি করেছেন জলপাইগুড়ি শহরের বাসিন্দাদের একাংশ। ‘সেভ আর্ট গ্যালারি-লেট দ্য লাইট ইন’ নামে তৈরি হওয়া ফেসবুকের ওই গ্রুপের সদ্যসদের বেশির ভাগই তরুণ এবং যুব প্রজন্মের। কেউ শিক্ষক কেউ বা বেসরকারি কোনও সংস্থার আধিকারিক। এদের বক্তব্য আর্ট গ্যালারি সংস্কার করে ভাল সিনেমা দেখার ব্যবস্থা হোক, সঙ্গে নাটক-গান-অন্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও চলুক। তার জন্য পেশাদারি বেসরকারি সংস্থার হাতে গেলেও কোনও ক্ষতি নেই।
অন্য দিকে, বুধবার সকাল দশটা নাগাদ জলপাইগুড়ি কলাকেন্দ্রের চত্বরে জড়ো হোন শহরের বিভিন্ন নাট্যদল, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্য, গায়ক-লেখকরা। প্রবীণ থেকে তরুণ শিল্পীরা বৃষ্টি মাথায় নিয়েই গাইলেন, আবৃত্তি করলেন। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে চলল গানে-কবিতায় প্রতিবাদ। শহরের সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান বলে পরিচিত কলাকেন্দ্রকে কোনওভাবেই বেসরকারি বাণিজ্যিক বিনোদন সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। তাঁদের আশঙ্কা, বেসরকারি হাতে গেলে এর বাণিজ্যিককরণ ঘটবে। কলাকেন্দ্রকে লিজে বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে এবং প্রতিবাদ করে পথে-‘ফেসবুকে’ এমন ভাবেই প্রচার চলছে জলপাইগুড়িতে।
কলাকেন্দ্রের হস্তান্তরের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন জলপাইগুড়ি পুরসভার চেয়ারম্যান মোহন বসু। তিনি বলেন, “জলপাইগুড়ি শহরের সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র কলাকেন্দ্রকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার কোনও কারণ নেই। আমরা সেটির দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলাম।”
শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এসজেডিএ) দায়িত্বে থাকা জলপাইগুড়ির সরোজেন্দ্রদেব রায়কত কলাকেন্দ্রকে লিজে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাতানুকূল অডিটোরিয়ামে নিয়মিত অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া না হওয়ায় রক্ষণাবেক্ষণের খরচ ওঠে না। বছরে প্রায় ৬০ লক্ষ টাকা ক্ষতি হয় বলে এসজেডিএর দাবি। কলকাতা তথা পূর্ব ভারতের একটি প্রতিষ্ঠিত বিনোদন সংস্থা কলাকেন্দ্রকে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে এসজেডিএ সূত্রে জানা গিয়েছে। সংস্থার সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনাও হয়েছে এসজেডিএর। এই সংস্থাটি কলকাতার ‘স্টার থিয়েটারের’ পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন। কলাকেন্দ্রে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বাছাই করা সিনেমাও দেখানো হবে বলে সংস্থাটি জানিয়েছে।
এসজেডিএর এই সিদ্ধান্ত প্রকাশ্যে আসার পরেই জলপাইগুড়ি শহরে আলোড়ন পড়ে যায়। প্রতিবাদে সামিল হন শহরের একাংশ বিশিষ্টজনেরা। গত মঙ্গলবার জেলা শাসকের দফতরে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। এদিন বুধবার কলাকেন্দ্র চত্বরেও প্রতিবাদ হয়। জলপাইগুড়ির বিধায়ক সুখবিলাস বর্মা এদিনের প্রতিবাদে গানও গেয়েছেন। গবেষক উমেশ শর্মা, সাহিত্যিক গৌতম গুহরায়, আকাশ পালচৌধুরী, শৈবাল বসু, জলপাইগুড়ি পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান পিনাকী সেনগুপ্তও এদিন কলাকেন্দ্র চত্বরে উপস্থিত ছিলেন। কলাকেন্দ্র রক্ষা মঞ্চের আহ্বায়ক গৌতম গুহরায় বলেন, “সর্বস্তরের শহরবাসীর কাছেই কলাকেন্দ্রের একটি গুরুত্ব রয়েছে। শহরবাসী একে নিজস্ব সম্পদ বলে মনে করে। একে কিছুতেই বেসরকারি হাতে দেওয়া হবে না। সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক আগ্রাসন মানব না।”
অন্য দিকে কলাকেন্দ্র বেসরকারি হাতে গেলে, অডিটোরিয়ামের রক্ষণাবেক্ষণ যথাযথ হবে, নাটক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ভাল সিনেমাও দেখা যাবে বলে ফেসবুকে প্রচার শুরু করেছেন শহরেরই একল যুবক-যুবতী। ফেসবুকের ওই গ্রুপে মন্তব্য লিখেছেন শিক্ষক সিদ্ধার্থ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “কতদিন আমরা ভাল সিনেমা থেকে বঞ্চিত থাকব। বাংলার সংস্কৃতির আদানপ্রদান কেন্দ্র হিসেবে কলাকেন্দ্র রাজ্যে জায়গা করে নিক এটাই চাই। আর ইতিহাস বলে, বেসরকারি ক্ষেত্রেই বরঞ্চ বরাবর সুস্থ ও নিরপেক্ষ সংস্কৃতি বিরাজ করেছে।” পাশাপাশি, প্রতিবাদীরাও ফেসবুকে প্রচার চালাচ্ছেন।
তবে জলপাইগুড়ি শহরের সংস্কৃতিপ্রেমীদের আশ্বস্ত করে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব এদিন বলেন, “জলপাইগুড়িকে উত্তরবঙ্গের সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল বলা হয়। এই শহরের সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করতে যা পদক্ষেপ করার তাই গ্রহণ করা হচ্ছে। এ নিয়ে কোনও আশঙ্কার কারণ নেই।” পাশাপাশি এসজেডিএ সূত্রে জানানো হয়েছে, বেসরকারি হাতে গেলেও নাটকের দলগুলিকে আগের মতোই ভর্তুকি হারে কলাকেন্দ্রে অনুষ্ঠান করার সুযোগ দেওয়া হবে। |