শ্বশুরবাড়িতে ফোন এসেছিল সেনাবাহিনীর তরফে। বলা হয়েছিল, বিয়ের শংসাপত্র ও জীবনবিমা সংক্রান্ত কাগজপত্র দ্রুত ফ্যাক্স করতে। তখনই সন্দেহ হয়েছিল তাঁর। মঙ্গলবার সেই কাগজপত্র নিতেই বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পথে স্বামীর এক বন্ধুর কাছ থেকে দুঃসংবাদটা পেলেন। কাশ্মীরে জঙ্গি হামলায় মৃত্যু হয়েছে সেনা-জওয়ান স্বামীর। সেই রাতেই গায়ে আগুন দিয়ে নিজের জীবন শেষ করে দিলেন পিউ নন্দী (২০)।
সোমবার বিকেলে শ্রীনগরের শহরতলি হায়দারপোরা এলাকায় সেনাবাহিনীর কনভয়ের উপরে জঙ্গি হামলায় মৃত্যু হয় আট জওয়ানের। নিহতদের অন্যতম অদ্বৈত নন্দী (২৪) বাঁকুড়ার তালড্যাংরা থানার পাঁচমুড়া এলাকার বাসিন্দা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঘটনায় শোক প্রকাশ করে বলেছেন, “এই মৃত্যু অত্যন্ত দুঃখজনক।” মঙ্গলবার সকালে অদ্বৈতের পরিবার ঘটনার কথা জানতে পারে। তখন থেকেই মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন তাঁর স্ত্রী, মেদিনীপুর শহরের গোপ কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী পিউ। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ শ্বশুরবাড়ির বাথরুমে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেন তিনি। বুধবার ভোরে বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।
কয়েক বছর আগে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। বর্তমানে ‘রাষ্ট্রীয় রাইফেলস’ বাহিনীর ৩৫ নম্বর ব্যাটেলিয়নে ছিলেন। ঠাকুরমা, বাবা, স্ত্রী ও সদ্য সেনাবাহিনীতে চাকরি পাওয়া এক ভাইকে নিয়েই ছিল তাঁর পরিবার। ১৬ মাস আগেই পশ্চিম মেদিনীপুরের রাজাডালা এলাকার সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা মেয়ে পিউয়ের সঙ্গে বিয়ে হয় অদ্বৈতের। কর্মসূত্রে বাইরে থাকলেও স্ত্রী-র পড়াশোনার দিকে বিশেষ নজর ছিল জওয়ান স্বামীর। সম্প্রতি ৩০ দিনের ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন অদ্বৈত। |
বুধবার বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে চত্বরে পিউয়ের বাবা দীনবন্ধু দে বলেন, “দিন দশেক আগে মেয়েকে বাড়িতে রাখতে এসেছিল জামাই। এখান থেকেই সে শ্রীনগর রওনা দেয়। যাওয়ার আগে বলেছিল, বন্ধুর ডিউটি করতে যাচ্ছে। এর পর অনেক দিনের ছুটি পাবে। পিউ যাতে মন দিয়ে পড়াশোনা করে, তা-ও আমাকে দেখতে বলেছিল। জঙ্গি হামলার আগের রাতেও আমার সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল জামাইয়ের।” অদ্বৈতের মৃত্যুসংবাদ জেনে তাঁর পরিবারকে সান্ত্বনা জানাতে ফোন করছিলেন বেশ কিছু সহকর্মী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাঁদেরই এক জন (বর্তমানে রাষ্ট্রীয় রাইফেলসের হয়ে পঞ্জাবে কর্মরত) বললেন, “আমি অদ্বৈতকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। খুবই পরিশ্রমী আর সাহসী ছেলে ছিল। স্ত্রীকে খুব ভালবাসত।” তাঁর কথায়, “আমি যতটুকু জেনেছি, জঙ্গিদের গুলিতে অদ্বৈতই একমাত্র ঘটনাস্থলে মারা যায়।”
মঙ্গলবার সকাল ন’টা নাগাদ শ্রীনগর থেকে সেনাবাহিনীর লোকজন ফোন করে কিছু কাগজপত্র ফ্যাক্স করতে বলে। সেগুলি নিতেই পিউ শ্বশুরবাড়ি রওনা দিয়েছিলেন। বাসে যেতে যেতেই ফোনে দুঃসংবাদ পেয়ে জ্ঞান হারান। তাঁকে কোনও মতে পাঁচমুড়া বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের হাতে তুলে দেন বাসকর্মীরা। তাঁরা পিউকে শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে দেন। সমস্ত খবর পেয়ে পাঁচমুড়ায় পৌঁছে যান দীনবন্ধুবাবু ও তাঁর স্ত্রী প্রতিমা দে।
“জ্ঞান ফেরার পর থেকেই পিউ নিজের জীবন শেষ করে দেওয়ার কথা বলছিল। আমরা ওকে চোখে চোখে রেখেছিলাম। তবু, বাঁচাতে পারলাম না!”হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার রুমে এই কথাগুলি বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন দীনবন্ধুবাবু। এ দিন পাঁচমুড়ায় গিয়ে দেখা গেল, গোটা গ্রাম ভেঙে পড়েছে নন্দী বাড়িতে। ছেলে-বৌমাকে হারিয়ে শোকে পাথর অদ্বৈতের বাবা, ৫৬ বছরের সুশীল নন্দী। সেনা জওয়ানদের একটি গ্রুপ ফটো হাতে নিয়ে নিজের ছেলের ছবিটি শুধু খুঁজে চলেছেন। মুখে কোনও কথা নেই।
সেনাবাহিনীর একটি সূত্রে জানা যাচ্ছে, আজ, বৃহস্পতিবার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হতে পারে অদ্বৈতের মরদেহ। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। যদিও বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার বলেন, “নিহত জওয়ানের দেহ কখন আসবে, সে বিষয়ে আমাদের কাছে খবর নেই। সেনাবাহিনীর তরফে আমাদের কিছু জানানো হয়নি।” |