প্রবন্ধ ২...
আমরা কি তা হলে সুবিধে মতো জাগব
তগুলো আমি? কতগুলো মুখ আমার? কতগুলো চোখ-ঠোঁট-কান-নখ-দাঁত? কোন মুখটা সত্যি আমার? ‘সত্যি-মিথ্যে’ নিয়ে গড়ে ওঠা আমার চুয়াল্লিশটা বছর এমনই নানান প্রশ্নে দগ্ধ হয়েছে, ছাই হয়ে উড়েছে... নিঃশেষ হয়েছে। তবুও ভাঙাচোরা যে কাঠামোটা রয়ে গিয়েছে, তার কারণ আমার চার পাশে আমি এমন অনেক মানুষকে দেখেছি, যাঁরা পালটে দিয়েছেন আকাশের রং, বদলে দিয়েছেন আমার মতো নগণ্য মানুষের ভাবনাচিন্তা। ‘থিয়েটার’কে অবলম্বন করে আমার বেঁচে থাকা, যেটুকু প্রচেষ্টা, সবটাই তাঁদের দান। তাঁদের মধ্যে কিছু মানুষকে আমি চিনি-জানি, বেশির ভাগ মানুষকেই চিনি না। শুধু বুঝতে পারি, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, যে ‘তাঁরা’ অভুক্ত থাকেন বলেই আমার পেট ভরে। ‘তাঁরা’ বস্ত্রহীন বলেই আমার গায়ে ‘ব্র্যান্ডেড’ জামা। ‘তাঁদের’ই হেলায় ছুড়ে দেওয়া‘সময়’ ছোট্ট একটা চাকতির মধ্যে ঢুকে পড়ে শোভা পায় আমার কবজিতে... আমি গম্ভীর কণ্ঠে বলি, ‘আমার সময় নেই।’ সত্যিই সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। দ্রুত, খুব দ্রুত চিনে নিতে হবে নিজেকে।
‘আমরাই আক্রান্ত এই ছবি গেঁথে দেওয়া চাই পুরজনমনে’
প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলই বলে, তারাই নাকি আক্রান্ত। মজিদ মাস্টার, আরাবুল ইসলাম, কেউই নাকি আক্রমণকারী নন, বরং তাঁরাই নাকি আক্রমণের শিকার। কবির ভাষায় ততক্ষণে মঞ্চের গভীর কোণে গড়ে ওঠে সতেজ অস্ত্রভার। যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে, তারাই সবচেয়ে গলা তুলে বলে কত বেশি আক্রান্ত তারা। এ রকমই একটা সময়ে ভাতের থালা ফেলে রেখে ‘টুম্পা-মৌসুমি’ ছুটল দিদির কাছে, কিছু নালিশ, কিছু প্রশ্ন নিয়ে। বুঝলই না তাদেরই হাতে ‘আক্রান্ত’ হতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী, বুঝলই না অত নিরাপত্তারক্ষী থাকা সত্ত্বেও কতটা বিপজ্জনক ওরা। ভাগ্যিস ধরা গেল ‘ওদের’, চিনে নেওয়া গেল ওরা ‘মাওবাদী’। কী আশ্চর্য, এর পরেও মেয়ে দুটোর কোনও অনুশোচনা নেই, ভয় নেই! সবাই বলছেন, ২১ জুনের মহামিছিল সাহস-ভরসা জুগিয়েছে কামদুনির এই চিন্তা যেন কোনও ভাবেই গ্রাস না করে আমাদের। কারণ, ‘নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর’-এর মতোই ‘কামদুনি’ই সাহস দিয়েছে আমাদের। আমরা বুঝতে পারলাম আমরা বেঁচে আছি, মাথাটা এখনও কাজ করছে, আর করছে বলেই কিছু প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে মনে।
যাঁরা বলছেন, ২০০৭ সালের ১৪ নভেম্বরের ওই ঐতিহাসিক মিছিলের প্রয়োজন হয়েছিল, কারণ তার পিছনে ছিল সি পি আই (এম)-এর সংগঠিত সন্ত্রাস। দোষীরা ধরা পড়েছে এবং শাস্তির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে সরকার সুতরাং প্রতিবাদ কেন এই কথা বলে যাঁরা ‘প্রতিবাদ’ করতে অসম্মত হলেন, তাঁদের কাছে জানতে ইচ্ছে করে, দুঃস্বপ্নের প্রতিধ্বনি কি তাঁরা এখনও শুনতে পাচ্ছেন না? বাম জমানায় ঘটে যাওয়া নানান ‘অন্যায়’ দেখে-শুনেও যেমন আমরা এক সময় ভান করতাম ‘আমরা ভাল আছি’, তারই পুনরাবৃত্তি করে যাওয়া কি সংগত হবে? আমরা কি তবে অপেক্ষা করব কবে ঘটবে ‘নন্দীগ্রামের’ মতো একটা ঘটনা? অপেক্ষা করব আবারও কবে ভিজে উঠবে মাটি নিরপরাধ মানুষের রক্তে?
মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন ‘পরিবর্তন’ এক দিনে হয়নি। যথার্থ কথা। আমি এ কথাও বিশ্বাস করি ‘নাগরিক’ আন্দোলন রাজনৈতিক পালাবদল ঘটাতে পারে না। বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লাগাতার লড়াইয়ের স্বীকৃতি দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের অগণিত মানুষ, গত বিধানসভা নির্বাচনে। সেই সময় নাগরিক সমাজও তার যথার্থ ভূমিকা পালন করেছিল ‘অন্যায়’-এর প্রতিবাদ করে। একটি রাজনৈতিক দল বা তাদের দলনেত্রী ক্ষমতায় আসার পর বদলে গেলেন কি না সেটা অন্য প্রশ্ন, তাঁরা যদি যে-কোনও ‘অন্যায়’ ঘটনাকে সাজানো বা চক্রান্ত ভাবেন, সেটা তাঁদের ভাবনার দৈন্য। সেই দৈন্যের মধ্যে আমরাও শামিল হব কেন? কেন সতর্ক ভাবে বলব, ‘নতুন সরকার’কে ‘সময়’ দেওয়া উচিত? যে কোনও উন্নয়নমূলক কাজের ক্ষেত্রে নতুন সরকারকে সময় দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু যেখানে অসম্মানিত হচ্ছেন মেয়েরা, প্রশাসন যেখানে সতর্ক করা সত্ত্বেও সন্দেহজনক ভাবে নিষ্ক্রিয়, সেখানে কেন চুপ করে ধৈর্য দেখাবেন ২০০৭-এর ১৪ নভেম্বরের সামনের সারিতে থাকা লড়াকু গুণিজনেরা? কোনও প্রশ্ন উঠবে না? সেই কারণেই মনে হয়, চিরকালই সহায়সম্বলহীন মানুষরাই সাহস করে প্রশ্নগুলো তোলেন, মরেন, তার পর আমরা মিটিং-মিছিল করি।
‘টুম্পা-মৌসুমি’ এবং ওঁদের পরিবার কিন্তু এখনও বিপদের মুখে, তবু ওঁরা ওঁদের মৃতা বন্ধুর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি শুনে সন্তুষ্ট থাকতে পারেনি, কারণ ওঁদের প্রত্যেক দিনের বেঁচে থাকা শিখিয়েছে যে, শুধু ‘প্রতিশ্রুতি’তে কিছু হয় না, প্রয়োজন হয় আগামী দিনগুলোকে সুরক্ষিত করার জন্য লাগাতার লড়াই।
‘টুম্পা-মৌসুমি’ আরও একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছিল। ওঁরা চেয়েছিলেন, ‘দিদি’ যেন ওঁদের, মানে মেয়েদের কথাগুলো একটু শোনেন। সমাজে যখন মেয়েদের ওপর নানান ভাবে আক্রমণ হয়, তখন আমরা ‘পুরুষ’রাও তার প্রতিবাদ করি। কিন্তু নিজেদের অজান্তেই আমাদের প্রতিবাদের ভিতর থাকে একটা পুরুষসুলভ অহমিকা, খুব কম পুরুষই পারেন সেই দেওয়াল ডিঙোতে।
স্মরণ করে দেখুন, দীর্ঘ দিন বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন বামফ্রন্টের নানা রকম রাজনৈতিক সমালোচনা ও আক্রমণের পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট ভাবে শুধুমাত্র ‘নারী’ বলেই শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এমন-এমন কথা বা আচরণ সহ্য করতে হয়েছে, যা রাজনৈতিক শিষ্টাচার পার হয়ে প্রকাশ করেছে পুরুষশাসিত সমাজের প্রতাপভঙ্গি। সেই সব কিছু সহ্য-করা মুখ্যমন্ত্রী টুম্পা-মৌসুমিদের কণ্ঠে কী এমন ভয়ানক ধ্বনি শুনলেন যে তাঁরা আর ‘নারী’ রইলেন না, হয়ে উঠলেন ‘সি পি এম’ বা ‘মাওবাদী’?
‘উল্টো/ যা-কিছু দেখছে লোকে, সবটা যদি ভুলত!’
যাঁর ডাকে ২১ জুন ২০১৩-র মহামিছিল, হাজার হাজার প্রতিবাদীদের পদধ্বনিতে মুখর ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, সেই শ্রদ্ধেয় শঙ্খ ঘোষ ও মিছিলে অংশগ্রহণকারী জনস্রোতকে প্রণাম! মিছিল আশ্রয় দেয়, ভরসা দেয়। মিছিলের মানুষ, তাঁদের গান, কথা, আবেগ, স্লোগান বার্তা বয়ে আনে আগামী দিনের সংঘবদ্ধ হওয়ার বার্তা। অনেকগুলি অসামান্য ফেস্টুনের মধ্যে একটি ফেস্টুন দেখে বুকের ভিতরটা কেমন ধক্ করে উঠল, ‘লাশগুলি আমরা রাখবো কোথায়?’
সত্যি তো, গেল কোথায় লাশগুলি? নন্দীগ্রামের সেই ১৪টা লাশ? রাধারানি আড়ি বা তাপসী মালিক? ওঁরা কি আদৌ ধর্ষিতা হয়েছিলেন?
কী বলছেন?... শুনতে পাচ্ছি না, একটু জোরে বলুন না, প্লিজ!
সত্যি, মাঝে মাঝে কান-মাথা-চোখ-স্মৃতি সব কেমন গুলিয়ে যায়।
নন্দীগ্রামে চোদ্দো জন যদি সত্যি মারা গিয়ে থাকতেন, যদি সত্যিই ধর্ষিতা হয়ে খুন হতেন তাপসী, তা হলে বিমান বসুদের সূর্যোদয়ের যথার্থতা প্রমাণ করার জন্য ১৪ নভেম্বরের (২০০৭) মিছিলের পাল্টা হিসেবে পরের দিন কলকাতায় বেরোতে পারত আরও একটি মিছিল? সেই দিনের লাশগুলো লাশ ছিল না? ধর্ষণগুলো ছিল না ধর্ষণ? ১৫ নভেম্বরের মিছিলে যোগদানকারী বহু গুণিজন পা মিলিয়েছেন ২১ জুনের মিছিলে। কোনও সন্দেহ নেই, ‘বিপন্ন’ সময় বহু ক্ষেত্রেই একসঙ্গে মিলিয়ে দেয় অনেককে। ইতিহাস তো সেইশিক্ষাই দেয়।
ইতিহাসই প্রশ্নও তোলে। বিরোধী আসনে বসা বাম নেতৃবর্গ বলছেন, তাঁরা বদলাচ্ছেন, শুদ্ধ হচ্ছেন। একটা সময় তাঁদেরই নৈতিক সমর্থন নিয়ে পথে নেমেছিলেন যে গুণী মানুষরা, যাঁরা অস্বীকার করেছিলেন নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরের মানুষের আত্মত্যাগ, তাঁরা নতুন উদ্যমে লড়াই করার আগে এক বার মনে-মনেও কি মার্জনা চেয়েছিলেন সেই সব ভুলতে বসা মৃতদের কাছে? না কি তাঁরা মনে করছেন সে সবই ভুলে যাব আমরা? সুবিধা মতো জাগব, ফের ঘুমিয়ে পড়ব?
কিন্তু শঙ্খবাবু যে লিখেছেন: ‘জেগে থাকাও একটা ধর্ম’...


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.