প্রবন্ধ ১...
মুখ্যমন্ত্রীর সামনে এখন দুটো কাজ
দুনিয়ার কোনও প্রশাসনের পক্ষেই হয়তো ধর্ষণ বা হত্যা জিনিসটা পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়। সে কলকাতা দিল্লি ওয়াশিংটন ডি সি যেখানেই হোক। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে যা চলছে, তাতে এই গোড়ার কথাটা পরিষ্কার করা খুব জরুরি।
কিন্তু প্রশাসনের পক্ষে যেটা অত্যন্ত সম্ভব, তা হল, ধর্ষণ বা খুনের ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে একটা দ্বিধাহীন কড়া পদক্ষেপ নেওয়া। যাতে ধর্ষণকারীরা বোঝে, যে মাটিতে দাঁড়িয়ে তারা এ কাজ করছে, সেই মাটির প্রশাসনের চোখে এগুলো অ-গ্রহণীয়, অ-সহনীয়, কড়া হাতে দণ্ডনীয়। উল্টো দিকে, যাতে ধর্ষিত দুর্ভাগারা বোঝে, প্রশাসন সত্যিই তাদের পাশে, তাদের সঙ্গে এবং তাদের জন্য।
কড়া পদক্ষেপ নিলেই অবশ্য ম্যাজিকের মতো অপরাধটা উবে যায় না। দিল্লিতে যখন প্রতিবাদের চাপে ধর্ষণকারীদের চরম শাস্তির সিদ্ধান্ত হল, সেখানকার নারী-নির্যাতনের পরিসংখ্যান কিন্তু হুড়মুড়িয়ে কমল না। আজও দিল্লি অতটাই বিপজ্জনক, হয়তো পরের জুনেও তাই থাকবে। এত বড় সামাজিক বিকার, এত চট করে কি প্রতিকার সম্ভব? যদি সত্যিই ধর্ষণকারীদের কড়া শাস্তি পাওয়ার দৃষ্টান্ত অব্যাহত থাকে, নাগরিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা উন্নত হয়, তবে তারও পরের জুনে দিল্লিতে কোনও পরিবর্তন আসতেও পারে। অন্তত সেই আশায় বুক বাঁধা যায়।
আর যদি বুক বাঁধার মতো আশা না-ই পাওয়া যায়? উপর্যুপরি অন্যায় ঘটে গেলেও যদি প্রশাসনের ‘কড়া’ হওয়ার ইশারা না মেলে, বরং অনবরত অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার ফন্দিফিকির দেখতে হয়? তা হলে যা হওয়ার কথা, পশ্চিমবঙ্গে এখন সেটাই ঘটছে: ক্ষোভ ও ত্রাসের প্রবল বিস্ফোরণ। পার্ক স্ট্রিট থেকে বারাসত: দুর্ভাগ্যের মুখোমুখি এমনিতেই দাঁড়িয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ। এ বার বিষফোঁড়ার মতো উদিত হল একটা অতিরিক্ত দুর্ভাগ্য: চূড়ান্ত প্রশাসনিক দুর্ব্যবহার।
ছবি: প্রদীপ সান্যাল
অর্থাৎ এই মুহূর্তে একটা নয়, দুটো সমস্যা নিয়ে এ রাজ্য নাজেহাল। এক, নারী-নিরাপত্তার চরম অভাব। দুই, প্রশাসনের মাত্রাছাড়া অসংবেদনশীলতা। এই দুই নম্বর সমস্যাটা কিন্তু একেবারে অকারণ। যেই-না এক নম্বর সমস্যাটার বিষয়ে অভিযোগ উঠতে শুরু করল, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ধরে নিলেন অভিযোগটা নির্ঘাত তাঁর দলের বিরুদ্ধে, ফলে সম্পূর্ণ অকারণে, অমার্জিত ঔদ্ধত্যে, প্রবল হিংস্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন অভিযোগকারীদের উপর। একা হাতে গুলিয়ে দিলেন অভিযোগটাকে। পাল্লা দিয়ে গুলোতে শুরু করল প্রতিবাদের একাংশও। ফল দাঁড়াল বিষম। এক দিকে মুখ্যমন্ত্রীর প্রাত্যহিক হুঙ্কার, অন্য দিকে মিডিয়ার সান্ধ্য প্রতিবাদে প্রাত্যহিক কনফিউশন, কতখানি প্রতিবাদ মুখ্যমন্ত্রীর দুর্ব্যবহারের বিরুদ্ধে আর কতখানি প্রতিবাদ নারী-নিরাপত্তার প্রসঙ্গে, তার ভ্রম-বিভ্রম।
দুটো সমস্যা আলাদা গোত্রের। একটা দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক সমস্যা। একটা বর্তমান সরকারের চলতি সমস্যা। দুটোর বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ দরকার। কেননা, দুটোরই প্রতিকার চাই।
দুটো প্রতিকারের ব্যবস্থাই কিন্তু করতে হবে প্রশাসনকে, মুখ্যমন্ত্রীকে। কোনও বিকল্প নেই। মুখ্যমন্ত্রীর সামনে এখন দুটো কাজ। প্রথম কাজ, দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা অর্থাৎ নারী-নিরাপত্তার ব্যবস্থা, যে কাজে প্রশাসনকেই নেতৃত্ব এগিতে অগিয়ে আসতে হবে, অন্য পথ নেই। দ্বিতীয় কাজ, নিজের ও দলের অসহিষ্ণুতা দূর করা। সে কাজটাও তিনি নিজে ছাড়া কেউ পারবে না। দ্বিতীয় কাজটাই আগে করা দরকার, কেননা সেটা তুলনায় সহজ। ধর্ষণের সমস্যাটা তাঁর নিজের বা সরকারের তৈরি নয়, তবে কেবল এই বৃথা উত্তেজনা অভব্যতা অশালীনতা দিয়ে সমস্যা সমাধানের পথে অতিরিক্ত বাধা তৈরি কেন? যে দু-চারটে ভাল প্রশাসনিক পদক্ষেপ ইতিমধ্যেই করা হয়েছে, দুর্ব্যবহার দিয়ে সেগুলোর গুরুত্ব তিনি নিজেই কমিয়ে দিচ্ছেন না কি? যত বার অভিযুক্তের বদলে অভিযোগকারীদের দিকে আঙুল উঁচিয়ে ‘চোপ’ বলছেন, তত বার প্রতিকারের পথটা আরও লম্বা হয়ে যাচ্ছে না কি? মুখ্যমন্ত্রী বুঝতে পারছেন তো যে, তাঁর এই এক-একটি ‘সাজানো ঘটনা’ কিংবা ‘চোপ’ একই সঙ্গে দু’রকম ক্ষতি করছে: এক, যারা অপরাধীর শাস্তি চাইছে, তারা তাঁর ও প্রশাসনের উপর আস্থা হারাচ্ছে, এবং দুই, যারা অপরাধকারী, তারা তাঁর ও প্রশাসনের উপর আরও আস্থাবান হয়ে উঠছে! পুলিশ প্রহরার ঘেরাটোপে বসেও ধর্ষণকারীরা স্বস্তির শ্বাস ফেলছে: এই সরকার থাকলে কীসের চিন্তা, ‘চোপ’-এর ছত্রচ্ছায়ায় তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ের ভাবনা কী।
আসলে প্রথম কাজটা সত্যিই যদি মুখ্যমন্ত্রী করতে চান, দ্বিতীয় কাজটা তাঁকে আগে সেরে নিতেই হবে, কোনও শর্টকাট নেই। তাঁর নিজের ব্যবহার পাল্টাতে হবে। রাজনীতির অনেক কঠিন অঙ্ক তিনি বোঝেন। রাজনীতির খাতিরেই তাঁকে বুঝতে হবে যে, গণতন্ত্র মানে কেবল ভোট দিয়ে তাঁকে জেতানোর অধিকার নয়, গণতন্ত্র মানে তাঁকে প্রশ্ন করার অধিকারও বটে। এই দ্বিতীয় কাজটা একটু তাড়াতাড়ি সারলে ভাল হয়। প্রথম কাজটা অনেক বড় আর গুরুতর, দ্বিতীয় সমস্যাটার অকারণ উপদ্রবে, অর্থহীন দৌরাত্ম্যে সেটা সারতে বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে।
অর্থহীন দৌরাত্ম্য কী ভাবে বৃহত্তর সমস্যাটির প্রতিকারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সাম্প্রতিক জাতীয় সমীক্ষায় নারী-নির্যাতনে পশ্চিমবঙ্গের করুণ হাল দেখে রাজ্য সরকারের প্রতিক্রিয়াই সেটা প্রমাণ করে। ‘তথ্যে ভুল আছে’, ‘উদ্দেশ্য-প্রণোদিত’, ‘সি পি এম আমলেও’.. ইত্যাদির ছড়াছড়ি চলছে। অথচ, রিপোর্টের উনিশ-বিশ হয়ও যদি, পশ্চিমবঙ্গর অবস্থা যে মন্দ, সেটা নিয়ে তো সন্দেহ নেই! এও ঠিক যে দুই বছরে ব্যাঙের ছাতার মতো ধর্ষণকারীতে দেশ ছেয়ে যায়নি, আগের আমলেও তারা নিশ্চয় ছিল। সুতরাং অর্থহীন তর্ক ছেড়ে প্রতিকারটাই একটু ভাবলে হয় না? প্রতিটি থানাকে সতর্ক করা যায় না যে, অভিযোগ এলে তৎক্ষণাৎ ডায়রি নিতে হবে, চটপট খোঁজখবর করতে হবে, রাজনৈতিক পরিচয় না দেখে অভিযুক্তদের অন্তত প্রাথমিক গ্রেফতারটুকু করতে হবে? এবং এই জঘন্য অপরাধের বিচারকে রাজনীতি-নিরপেক্ষ করা যায় না? বেশি অপরাধ-প্রবণ এলাকাগুলিকে চিহ্নিত করা যায় না? অপরাধ অপরাধের জন্ম দেয়, সুতরাং মাদকসেবন, চোরাচালান ইত্যাদি ব্যস্ত ব্যক্তি ও দলের উপর স্থানীয় প্রতিরোধ তৈরি করা যায় না? প্রশাসন ছাড়া কে করবে এ সব কাজ?
দীর্ঘমেয়াদের অপরাধ দীর্ঘমেয়াদের সংস্কারও দাবি করে। সে কাজটাও প্রশাসনেরই। যে রাজ্যে শিক্ষার হাল করুণ, স্কুলছুট-সংখ্যা রকেটবৎ বর্ধমান, যে রাজ্যে কর্মসংস্থান বলতে কেবল শূন্যতার ভবিষ্যৎ, পঁয়ত্রিশ হাজার স্কুলশিক্ষকের চাকরির জন্য পঁয়ত্রিশ লক্ষেরও বেশি প্রার্থীর ভিড়, সে রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা তো ক্রমে ভাঙবেই, গুণ্ডামি ধর্ষণ খুনোখুনি বৃহৎ গুণিতকে বাড়বেই। কোনও ‘ফাঁসি এবং মৃত্যুদণ্ড’ দিয়ে এই সামাজিক বিকারের ভবিতব্য সামলানো যাবে না, যদি না ধর্ষণের মতো ‘প্রকট’ সংকটের পাশাপাশি শিক্ষার অভাব, বেকারত্ব ইত্যাকার ‘প্রচ্ছন্ন’ সংকটগুলির বিষয়েও প্রশাসনিক নীতি তাড়াতাড়ি নির্ধারিত হয়। প্রশ্ন উঠতে পারে: কেবল প্রশাসন? সমাজ নয়? সমাজের কোনও দায়িত্ব নেই এত বড় সামাজিক সমস্যার প্রতিকারের পথে? মেয়েদের সম্মান করার শিক্ষা, অন্তত অসম্মান না করার শিক্ষা দান তো সমাজেরই কাজ? নিশ্চয়ই। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে, সমাজকে এই কাজে প্রবৃত্ত ও নিয়োজিত করতেও প্রশাসনিক নেতৃত্বকেই এগিয়ে আসতে হয়। এ দেশে উনিশ শতক থেকেই তেমনটাই হয়ে চলেছে। সমাজের একাংশ অন্য রকম ভাবার সাহস দেখিয়েছে, সামাজিক অন্যায়ের প্রতিকার চেয়েছে। কিন্তু একমাত্র যখন প্রশাসন এসে সংস্কারকামী সেই একাংশের পাশে দাঁড়িয়েছে, তাদের যুগলবন্ধনই বাকি সমাজটাকে টেনে তুলতে পেরেছে, পিছিয়ে-থাকা মানুষকে হাত ধরে টেনে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। সুতরাং সমাজের দায়িত্ব স্বীকার করে নিয়েও বলতেই হবে, প্রধান ও প্রত্যক্ষ দায়টা প্রশাসন কিছুতেই এড়াতে পারে না। প্রশাসন কেবল বেছে নিতে পারে তার পছন্দসই পক্ষ: সামাজিক অন্যায়ের প্রতিকারকামীদের সঙ্গেই সে হাত মেলাতে চায়, না কি অন্যায়-মগ্ন অত্যাচারীদের হাতগুলিই তার বেশি পছন্দের!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.