গ্রাম ভেসেছে পানিগোলায়, গরুর ছাউনিই ভরসা
পাহাড়ের ধাপে ধাপে সব্জির খেত আর পাথরের চালা দেওয়া ছোট ছোট বাড়ি। ছিল।
দিন দশেক আগেও ছিল। এখন নেই। শ্যামলঘেরা কুটিরের শত শত স্বপ্ন স্রেফ ভেসে গিয়েছে।
পাহাড়ের উঁচুর দিকে যে সব ছাউনিতে গ্রীষ্মকালে বাছুর, মোষ, ছাগলদের এনে রাখা হত বরাবর, এখন সেখানে গাদাগাদি মানুষ!
না, উত্তরাখণ্ডের ত্রাণ-মানচিত্রের মধ্যে এঁরা এখনও নেই। সরকারের কৃপা থেকেও বঞ্চিত টিহরি গঢ়বাল অঞ্চলের চামারগাঁও, গাঁওয়ার গাঁও, হাডামের মতো ছোট ছোট গ্রাম। “কেদার-বদ্রীতে এত মানুষ মারা গিয়েছেন যে প্রশাসনের সব শক্তিই চলে যাচ্ছে সে সব সামলাতে। বেশির ভাগই সেখানে ভিন রাজ্যের পর্যটক। রাজ্যের ছোট গ্রামগুলি নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কারই বা আছে”, খেদোক্তি চাম্বা থেকে আমার সঙ্গ নেওয়া গাইড-এর। সেখানকারই একটি হোটেলের কর্মী তথা ম্যানেজার এই বিজেন্দর নেগি। যিনি সঙ্গে না থাকলে এই পিছল পাহাড়ে নামা-ওঠার ঝুঁকি নেওয়াই যেত না।
টিহরি গঢ়বালের এক গ্রামে চলছে স্থানীয়দের স্বাস্থ্য পরীক্ষা।
হৃষীকেশ বাইপাস ধরে নটরাজ চক পেরিয়ে নরেন্দ্রনগর ছাড়ানোর পরই পাহাড়ি পথের ভাঙন শুরু। গত দিন দেবপ্রয়াগ যাওয়ার পথে আগাগোড়া বৃষ্টি ছিল। আজ বর্ষার প্রকোপ কম, তবে ঘন কালো মেঘ বেশ নীচে এসে দিব্যি চলে-ফিরে বেড়াচ্ছে। সাধারণ অবস্থায় পর্যটকের কাছে এটা হয়তো স্বর্গীয় আবহ। কিন্তু অবস্থার ফেরে এই মেঘই গত কালের হেলিকপ্টার ভেঙে পড়ার প্রধান কারণ।
টিহরি বাঁধ ছাড়িয়ে মুসৌরির দিকে যাওয়ার পথেই গাড়ি দাঁড় করাতে হল। একটু আগেই সরু রুপোলি জলধারার পাশে ডগমগে সবুজ ঝুম চাষ চোখে পড়ছিল। এখন সে সব রঙ বদলিয়ে ছাইয়ের মতো হয়ে গিয়েছে। যত্রতত্র পাথর আর ভাঙা ডালপালায় প্রকৃতির আক্রমণের স্পষ্ট দাগ। “এখানেই ছিল গ্রামটা। নাম গাঁওয়ার গাঁও।” পাশ থেকে জানালেন নেগি। প্রায় মিনিট দশেকের পথ নীচে নেমে আরও স্পষ্ট বোঝা গেল ভগ্নস্তূপের স্বরূপ। ইতিউতি কিছু মৃতপ্রায় মানুষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন। ওই ধ্বংসের মধ্যে থেকে খুঁজছেন তাঁদের প্রিয় সংসারের স্মৃতিচিহ্ন।
এঁদেরই এক জন পূরণলাল বেলুনি। সেই প্রলয় রাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে বললেন ‘পানিগোলা’ ফাটার কথা। সেই পানিগোলার এমনই দাপট যে মাটি ফেটেও নাকি জল উঠে এসেছিল। ভাসিয়ে দিয়েছিল শয্যা। সঙ্গে কাদা নুড়ির স্রোত। আর সামনের ক্ষীণ জলধারা হঠাৎই শক্তিশালী হয়ে উঠে গিলতে শুরু করেছিল মাটির ঘর-দালান। প্রাণটুকু নিয়ে পাহাড়ের অন্য দিকে পালাতে শুরু করেছিলেন সকলে। যদিও বাঁচানো যায়নি কয়েক জনকে।
ডাল, রাজমা, করলা, শাকের ছোট ছোট খেত বড় যত্নে বানিয়ে তুলেছিলেন এই গ্রামের শ’পাঁচেক মানুষ। নেগি বলছিলেন, উত্তরাখণ্ডে এমন অসংখ্য নদী রয়েছে যা আজ মৃত। গত চল্লিশ বছর ধরে তাতে তেমন জল আসেনি। মানুষ সেই শুকিয়ে যাওয়া নদীখাতের ভিতরেই গ্রামবসতি গড়ে তুলেছিল। আশেপাশে আবাদও করেছিল। গ্রামবাসীদের বক্তব্য, আজ এত যুগ বাদে জল যে ভয়ংকর রূপ ধারণ করে পাথরের ঢল নিয়ে ফিরে আসবে এটা দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি কেউ।
ভরসার কাঁধ: শিশুকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছেন জওয়ান।
এখন তাই শূন্য থেকে শুরু। বেলুনি সঙ্গে করে উপরে নিয়ে এলেন গাওয়ার গাঁও-এর নতুন ঠিকানায়। অর্থাৎ পাহাড়ের উপরে গরু-ছাগলের ছাউনিতে। গবাদি পশুরা সব ভেসে গিয়ে প্রিয় গ্রামবাসীকে এটুকুই উপহার দিয়ে গিয়েছে! ভিজে যাওয়া বিবর্ণ প্লাস্টিক পেতে গাদাগাদি করে বেঁচে থাকা। অথচ চেহারা দেখে অনুমান করা যায়, মাত্র পক্ষকাল আগেও এঁরা ছিলেন মোটের উপর সম্পন্ন গৃহস্থ। এখন যে যেটুকু বাঁচাতে পেরেছেন, এনে ডাঁই করেছেন। প্রতি পরিবারের জন্য বরাদ্দ জায়গার পরিমাণ হাস্যকর রকম কম। পুতুলের সংসারও বোধহয় এর থেকে বড় হয়।
পাঁচ কিলোমিটার দূরে দু’বেলা লঙ্গর বসছে রাস্তার ধারে। পেটের জ্বালা কমাতে সেখানে হাঁটা লাগাচ্ছেন গ্রামবাসীরা। “কিন্তু ওখানেও বড় ভিড়, রোজ খাবার জুটছে না। আমাদেরই মতো আরও অনেক তলিয়ে যাওয়া গ্রামবাসী হাজির হচ্ছে কি না”, জানাচ্ছেন ভজন সিংহ। একটি সিগারেট চেয়ে টান দিলেন। বললেন, “রাস্তা তৈরির সময় ঠিকে কাজ করতাম। সেই কাজ হয়তো আবার করব। কিন্তু মাথার উপরের ছাদটাই যে উড়ে গেল।”
মনে পড়ল, গত কাল এখানকার ডিজাস্টার সেলের সেক্রেটারি উমাকান্ত পওয়ার বলেছিলেন, “আসল লড়াইটা শুরু হবে সমস্ত পর্যটককে উদ্ধার এবং নিজের নিজের রাজ্যে ফিরিয়ে দেওয়ার পর। রাজ্যটাকে ফের গড়া, অসংখ্য রাজ্যবাসীকে পুনর্বাসন দেওয়ার চ্যালেঞ্জটা হয়তো সাময়িক উত্তেজনায় ঢাকা পড়ে গিয়েছে। কিন্তু সে বড় সহজ কাজ নয়।”
সহজ তো নয়ই। উড়ে গিয়েছে রাজ্যের ১৯০টি সেতু। প্রায় ১২০০ রাস্তা চরম ক্ষতিগ্রস্ত। উত্তরাখণ্ড পাবলিক ওয়ার্কস সূত্রে জানানো হচ্ছে, শুধুমাত্র রুদ্রপ্রয়াগ, পৌরি, উত্তরকাশী এবং চামোলি জেলাতেই ভেঙে পড়েছে ৭,৯৫৩ কিলোমিটার রাস্তা! তাঁদের অনুমান, শুধু এই রাস্তা সারাইয়ের জন্যই প্রয়োজন হবে ৫০০ কোটি টাকা। মুখ্যমন্ত্রী বিজয় বহুগুণা অবশ্য বরাভয় দিয়ে জানিয়েছেন, পুঁজির অভাব হবে না। ইতিমধ্যেই কেন্দ্র উত্তরাখণ্ডের জন্য হাজার কোটির সাহায্য ঘোষণা করে ফেলেছে। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং কংগ্রেসের যুবশক্তির প্রতীক রাহুল গাঁধীর মধ্যে ত্রাণ ও সহায়তা নিয়ে দ্বৈরথও প্রকাশ্য।
পাহাড় থেকে নেমে আসতে আসতে মনে হচ্ছিল, এই সব রাজা-উজির আর কোটি কোটি টাকার গল্পের থেকে অনেকটাই দূরে এই সব ‘গাঁওয়ার’ গাঁও। অভুক্ত শিশুদের কান্নার আওয়াজ যেখানে শোকসঙ্গীতের মতো বেজে চলেছে।

ছবি: পিটিআই

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.