অন্যান্য বার প্রথম সারিতে থাকত তারাই। তারাই হাসিমুখে রাস্তা দিয়ে হাঁটত প্ল্যাকার্ড-পোস্টার হাতে। কিন্তু বুধবার আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস উপলক্ষে পুলিশ ও প্রশাসনের উদ্যোগে জেলার অন্যান্য থানা এলাকার মতো বোলপুরের শোভাযাত্রায় চোখে পড়ল না সেই সব কচিকাঁচাই। অথচ একই কারণে হওয়া মিছিলে সহপাঠীদের সঙ্গে সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে দেখা গেল কাঁকরতলা বা খয়রাশোল থানা এলাকার স্কুল পড়ুয়াদের। এমন সামাজিক অনুষ্ঠানে পড়ুয়াদের অনুপস্থিতিতে দৃশ্যতই অবাক বোলপুরের নানা মহল। |
নানুরে মিছিলের মুখ ছিল পড়ুয়াই। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি |
বোলপুরের মহকুমাশাসক প্রবালকান্তি মাইতি বলেন, “সামাজিক জনসচেতনামূলক প্রচার অভিযানে পড়ুয়াদের সামিল হওয়াটা দরকার। ঠিক কী কারণে তারা এল না, খোঁজ নেব।” স্থানীয় নেশা বিমুক্তিকরণকেন্দ্রের প্রকল্প অধিকর্তা হাসনাথ মোল্লা বলেন, “বিগত বছরগুলিতে একাধিক স্কুলের পড়ুয়ারা এই কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছে। এ বার তাদের অনুপস্থিতিতে আমরা বিস্মিত।”
কেন এমনটা হল?
শহরের বেশ কয়েকটি স্কুলের শিক্ষকেরা কিন্তু এর জন্য দায়ী করছেন শিক্ষা দফতরের সাম্প্রতিক একটি সিদ্ধান্তকে। কামদুনি-কাণ্ডের প্রতিবাদ করে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে মিছিল করেছিলেন সেখানকার প্রধান শিক্ষক। যার জেরে সরকারের কোপের মুখে পড়ে ‘শো-কজ’ চিঠিও পেতে হয় তাঁকে। বোলপুরের শিক্ষকদের একটা বড় অংশের দাবি, ওই ঘটনার জেরেই ‘শো-কজে’র ভয়ে এ দিন বোলপুর এলাকার কোনও স্কুলের ছাত্রছাত্রীকেই ওই সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মিছিলে হাঁটতে পাঠাননি স্কুল কর্তৃপক্ষ। বোলপুর হাইস্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সুপ্রিয় সাধু কিংবা নিচুপট্টি নীরোদবরণী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দিব্যেন্দু ধরেরা অবশ্য প্রকাশ্যে বলছেন, যোগাযোগের সমস্যার জন্যই এমনটা হয়েছে। তাঁদের দাবি, “আসলে সোমবার বিকেলে আমন্ত্রণ পেয়েছি। মঙ্গলবার ছুটি ছিল। |
বোলপুরের মিছিলে রয়েছেন এলাকার বাসিন্দারা। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী। |
তাই পড়ুয়াদের সঙ্গে সেই অর্থে যোগাযোগ করা যায়নি।” এমন কর্মসূচিতে স্কুল পড়ুয়াদের না পাঠিয়ে ভুল হয়েছে বলে তাঁরা মেনে নিয়েছেন।
অথচ যাঁরা এই জনসচেতনতামূলক কর্মসূচির উদ্যোক্তা, সেই পুলিশ-প্রশাসনের কিন্তু দাবি, মিছিলে যোগ দিতে এলাকার বিভিন্ন স্কুলে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এমনকী বিভিন্ন স্কুলের ব্যান্ড দলের সঙ্গে শহর পরিক্রমার কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছিল। তারপরেও কেন এমনটা হল, তা তাঁদেরও মাথায় আসছে না। এ দিন অনুষ্ঠানের আয়োজনে অবশ্য কোনও খামতি ছিল না। কোথাও স্থানীয় ক্লাবের সদস্যদেরকে নিয়ে কোথাও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহায়তায় স্কুল পড়ুয়াদের নিয়ে মাদকের ব্যবহার বন্ধ ও বেআইনি পাচার রোধে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে জেলার ১৯টি থানা এলাকায় শোভাযাত্রা বের হয়। এলাকার বিভিন্ন সংগঠনকে নিয়ে শোভাযাত্রা বের হয় বোলপুরের ডাকবাংলো মাঠ থেকেও। সেই শোভাযাত্রা শহরের বিভিন্ন এলাকা পরিক্রমা করে। পুলিশ ও স্থানীয় একটি ক্লাবের সদস্যেরা বাইক মিছিলও করেন। কর্মসূচিতে যোগ দেন বোলপুরের অতিরিক্ত জেলা জজ মানস বসু, মহকুমাশাসক প্রবালকান্তি মাইতি, এসডিপিও প্রশান্ত চৌধুরী এবং একটি স্বেছাসেবী সংস্থার নেশা বিমুক্তিকেন্দ্রের কর্মকর্তা-সহ বহু বিশিষ্ট জন। বর্তমানে বিশেষ করে যুব প্রজন্মের মধ্যে মাদকে আসক্ত হওয়ার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। মাসখানেক আগেই নেশা করার টাকা না পেয়ে এলাকার একাধিক যুবক আত্মঘাতী হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী মাদক ঠেক ভেঙেছিলেন, বিক্রেতাদের বাড়িতে অগ্নি সংযোগের ঘটনাও ঘটেছিল। স্থানীয় একটি সমীক্ষা ও পুলিশ সূত্রেও জানা গিয়েছে, নানা অপরাধমূলক কার্যকলাপে আটক বা গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের একটা বড় অংশই মাদকাসক্ত। এলাকায় চুরি, ছিনতাই বা নারী নিগ্রহের মতো অপরাধ বেড়ে চলার নেপথ্যেও দায়ী করা হচ্ছে মাদকাসক্ত হওয়াকেই। কিছু ক্ষেত্রে এমনও নজির ধরা পড়েছে, অপরাধ করতে এসে মাদক খেয়ে সেই অপরাধী ঘটনাস্থলেই অচৈতন্য হয়ে পড়েছেন! গবেষকদের দাবি, মাদক সেবনের জন্য অপরাধ বাড়ছে। এ দিনের জনসচেতনমূলক কর্মসূচিতে উদ্যোক্তা থেকে উপস্থিত বিশিষ্ট জন, সকলেই মাদক সেবন বন্ধে ও বেআইনি পাচার রুখতে সকল স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসার ডাক দিয়েছেন। তাই এমন একটি কর্মসূচিতে বোলপুরের ছাত্রছাত্রীদের অনুপস্থিতি বিতর্ক বাড়িয়েছে। |