|
|
|
|
আজ জঙ্গলমহলে মুখ্যমন্ত্রী |
পাট্টা দিয়েছিলেন মমতা, তবু জমির হদিস পাননি শবররা |
কিংশুক গুপ্ত • বেলপাহাড়ি |
‘অনাহারে না মইর্যলে সরকার আমরাকে কিছু দিবে নাই। কেবল ভোটটো লিবেক।’ ঝাঁঝিয়ে উঠলেন সলগি শবর। একটু দম নিয়ে আদিবাসী রমণীর গলায় ফের ঝাঁঝ, “গেল বচ্ছর মমতা বেলপাহাড়ি আস্যেছিল। আমার আর মরদের হাতে জমিনের কাগজ দিল। ব্লকবাবুরা বইল্যো আড়াই কাঠা জমিনে ঘর কইরে দিবে। মুরগি-ছাগল সকইল দিবেক। কই কিস্যু দিল নাই।”
গোড়া থেকেই জঙ্গলমহলের উন্নয়নে বহু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজে বারবার এলাকায় এসেছেন। জানিয়েছেন, তাঁর সরকার উন্নয়নের অস্ত্রে মাওবাদী মোকাবিলা করে জঙ্গলমহলের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। বেলপাহাড়ি ব্লকের শিমুলপাল পঞ্চায়েতের রিমড়াডাঙা গ্রামে গেলে অবশ্য উল্টো ছবিই দেখা যাবে। ব্লক সদর থেকে রিমড়াডাঙার দূরত্ব প্রায় ১৪ কিলেমিটার। ওদলচুয়া পর্যন্ত পিচ রাস্তা থাকলেও শেষ ৩ কিলোমিটার রাস্তা মোরামের। বর্ষায় তাতে হাঁটা যায় না। গাড়ি বা মোটর বাইকে যাও বা গ্রামে পৌঁছনো যায়, তার পর শবরপাড়ায় যাওয়ার আর রাস্তা নেই। পায়ে হেঁটে ঝোপঝাড় ছড়িয়ে যেতে হবে কুঁড়েঘরগুলিতে। সেখানেই ফাঁকা প্রতিশ্রুতি আর চরম অভাব নিয়ে বেঁচে রয়েছে শবরপাড়া। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গোটা তিরিশেক পরিবারের বাস। ভোটার ৫৮ জন। আদিম জনজাতি শবরদের জন্য হরেক উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে। টাকাও বরাদ্দ হয়। কিন্তু এলাকায় পা রাখলেই বোঝা যায়, উন্নয়নের ছিটেফোঁটাও পৌঁছয়নি এই শবরপাড়ায়। |
|
সুদিনের অপেক্ষায়। বেলপাহাড়ির রিমড়াডাঙার শবরপাড়া।—নিজস্ব চিত্র |
গোটা এলাকা যেন নেই-রাজ্য। রাস্তা নেই। পানীয় জল নেই। কাজ নেই। সলগির স্বামী কোঁদা শবর বলেন, “রোজদিন খাতে পাই নাই। জঙ্গলের কাঠ কাট্যে বিকি। হাড়ভাঙা খাটালির কাজ করি। রেশনের চালে পেট ভইর্যে না। পঞ্চায়েত কাজও দেয় নাই।” কোঁদা ও সলগির জব কার্ড বলছে, ২০০৬ সালে মাত্র এক দিন কাজ পেয়েছিলেন এই দম্পতি। তার পর আর একশো দিনের প্রকল্পে কাজ জোটেনি।
গত বছর অগস্টে মুখ্যমন্ত্রী বেলপাহাড়িতে প্রশাসনিক জনসভা করেন। সে দিন রিমড়াডাঙার ৮টি শবর পরিবারের সদস্যদের হাতে ‘নিজ গৃহ নিজ ভূমি প্রকল্পে’ জমির পাট্টা তুলে দিয়েছিলেন মমতা। প্রায় এক বছর হতে এল বাড়ি তৈরি শুরুই হয়নি। মমতার সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, এই প্রকল্পে গরিব মানুষকে জমি দিয়ে সরকারি খরচে বাড়ি বানিয়ে দেওয়া হবে। দরিদ্র পরিবারগুলি যাতে ছাগল-হাঁস-মুরগি প্রতিপালন করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে, সেই বন্দোবস্ত করে দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি রয়েছে প্রকল্পে। অথচ বাস্তব হল, কোন জমিটা কার জানেন না রিমড়াডাঙার শবরেরা।
দ্বিজেন শবর, কাকলি শবর, টিপু শবর, পার্বতী শবরেরা জানালেন, রীতিমতো খাতির করে মুখ্যমন্ত্রীর সভায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁদের। প্রশাসন গাড়ি পাঠিয়েছিল। ছিল জলখাবারের ব্যবস্থা। খোদ মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে পাট্টার কাগজ পাওয়ায় আশাও জেগেছিল। ভাঙা তোরঙ্গ থেকে সেই কাগজ বের করে দেখাতে দেখাতে কাকলি বলেন, “কোন জমিনটা যে দিইলো, সেটাই তো জানি নাই।”
লোধা-শবর কল্যাণ সমিতির বেলপাহাড়ি ব্লক সম্পাদক দেবাশিস শবরের মতে, “উন্নয়নের নামে প্রহসন চলছে। আমলাশোলে ১১টি শবর পরিবারকে ‘আমার বাড়ি প্রকল্পে’ বাড়ি বানিয়ে দিল পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদ। অথচ মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে যাঁরা পাট্টা পেলেন, তাঁদের জমিটুকুও চিহ্নিত হল না।” জানা গিয়েছে, গ্রামের একটি অংশে জমি চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে কোন দাগের জমি কার, সেটা শবর পরিবারগুলি জানে না। ঝাড়গ্রাম মহকুমা ভূমি-ভূমি সংস্কার আধিকারিক তপন মান্না অবশ্য বলেন, “কোন জায়গায় জমি দেওয়া হবে, তা পাট্টা বিলির আগেই প্রাপকদের জানানো হয়েছিল। এ নিয়ে তো সমস্যা নেই।”
যদি সমস্যা নাই থাকে, তাহলে বাড়ি তৈরি হয়নি কেন?
বেলপাহাড়ির বিডিও সর্বোদয় সাহার মুখে কুলুপ। তাঁর উপরের কর্তারাও কিছু বলতে নারাজ। নিয়মানুযায়ী, ‘নিজ গৃহ নিজ ভূমি প্রকল্পে’ প্রাপকের তালিকা তৈরি করে গ্রাম পঞ্চায়েত। জমি চিহ্নিত করে ভূমি দফতর। প্রাপকদের খাসজমি বিলি করা হয়। তার পর বাড়ি তৈরির জন্য দু’দফায় ৪৮,৫০০ টাকা বরাদ্দ হয়। বাড়ি তৈরির দায়িত্ব উপভোক্তার। তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা জমা পড়ার কথা। অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়ার দায়িত্ব যদিও পঞ্চায়েত-প্রশাসনের। সলগি, কাকলিদের বক্তব্য, ঝাড়খণ্ডী পঞ্চায়েত সদস্যা বাসন্তী মুড়া এলাকার খোঁজই রাখেন না। বাসন্তী আবার পঞ্চায়েতের উপপ্রধান। তাঁর দাবি, “আমরা প্রাপক তালিকা বানিয়েছি ঠিকই। কিন্তু বাদবাকিটা দেখার দায়িত্ব প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরের।”
সমস্যাগুলো দেখার কথা, পাশে থাকার কথা অনেক শুনেছেন পার্বতী, লুসকি শবররা। ভোট এলেই এ সব শোনা যায়। আবার ভোট আসছে। গুরুচরণ শবরের উঠোনে তৃণমূল ও সিপিএম দু’দলই পতাকা-ফেস্টুন টাঙিয়ে দিয়ে গিয়েছে। গুরুচরণের স্ত্রী লক্ষ্মীমণি মুখ টিপে হেসে বলেন, “আমলাশোলের শব্বররা মরইল বলে কত কিছু পাই্যল। আমরা মরছিও নাই, পাচ্ছিও নাই।”
|
পুরনো খবর: আইন থেকেও নেই, আদিবাসীরা বঞ্চিতই |
|
|
|
|
|