|
|
|
|
আইন থেকেও নেই, আদিবাসীরা বঞ্চিতই |
কিংশুক গুপ্ত • ঝাড়গ্রাম |
পেটের ভাত জোগায় জঙ্গল। প্রায় পনেরো কিমি দূরের পড়াডি হাটে গিয়ে কাঠ বেচতে হয় বেলপাহাড়ির ওড়োলি গ্রামের সুমিত্রা ভূমিজ ও পাটাঘর গ্রামের ফটিক শবরদের। মাজুগোড়ার শম্ভু সিংহ সর্দার, বিজয় সিংহ সর্দার আবার জঙ্গল থেকে কাঠ ও ডালপালা সংগ্রহ করে সাইকেলের পিছনে বেঁধে ২৫ কিমি পথ হেঁটে শিলদার হাটে গিয়ে বিক্রি করেন। তবেই তাঁদের বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে।
আইনের চোখে এঁরাই অপরাধী। বনকর্মীরা এঁদের ধরপাকড় করে। হতে হয় হেনস্থা। বেলপাহাড়ির কৃষ্ণপুরের গঙ্গারাম মাণ্ডি, ব্যাঙভুটা গ্রামের জগমোহন মাণ্ডিদেরও হেনস্থা হতে হয়। কারণ, বংশ পরম্পরায় বনভূমিতে বসবাস ও চাষাবাদ করলে আজ পর্যন্ত জমির পাট্টা পাননি এঁরা। অথচ কেন্দ্রীয় সরকারের ‘অরণ্যের অধিকার আইন-২০০৬’ অনুসারে এ সবই জঙ্গলবাসী মানুষগুলির অধিকার। কিন্তু আইনটি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকায় তাঁরা বঞ্চিতই রয়ে গিয়েছেন। বেলপাহাড়ির প্রবীণ কংগ্রেস নেতা সুব্রত ভট্টাচার্যের মতে, “কেন্দ্রীয় সরকার বনবাসীদের স্বার্থে আইন করলেও রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক গড়িমসিতে বনবাসীরা অরণ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রকৃত বনবাসী হওয়া সত্ত্বেও অনেকের আবেদন বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে। এই বঞ্চনা নতুন করে ক্ষোভের জন্ম দিতে পারে।” জঙ্গলমহলে বনবাসীদের জঙ্গলের অধিকারের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনরত ‘বনাধিকার রক্ষা মঞ্চ’-এর নেতা সন্তোষ রানার কথায়, “আদিবাসী-মূলবাসীরা পেটের জন্য জঙ্গলের উপর নির্ভর করেন। তাঁরা বনজ সম্পদ ব্যবহার করেন। কিন্তু ব্যাপক হারে জঙ্গল ধ্বংস করেন না। অথচ বনবাসীদের অধিকার নিয়ে বর্তমান সরকার কিছুই বলছে না।” |
এলাকা |
পাট্টার দাবিদার |
পাট্টা প্রাপক |
ঝাড়গ্রাম মহকুমা |
৪০ হাজার পরিবার |
৩৩৫৫ পরিবার |
গোপীবল্লভপুর ১ ব্লক |
৭ হাজার পরিবার |
৬২১টি পরিবার |
বেলপাহাড়ি ব্লক |
২৬১৮টি পরিবার |
২৪৭টি পরিবার |
|
মাওবাদীরাও বনবাসীদের অধিকারের দাবিতে সরব হয়েছিল। এই বিষয়টি তাদের জনভিত্তির ক্ষেত্রেও সহায়ক হয়েছিল। অনেকের মতে, অরণ্যের অধিকার আইনের যথাযথ প্রয়োগ মাওবাদীদের জনবিচ্ছিন্ন করতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। এই আইন অনুযায়ী, বংশ পরম্পরায় বনাঞ্চলে বসবাসকারীরা আদিবাসী ও মূলবাসীরা বনভূমির পাট্টা পাবেন, সমষ্টিগত ভাবে (কমিউনিটি-পাট্টা) বনজ সম্পদ ব্যবহারের অধিকার পাবেন। অসম, মণিপুরের মতো রাজ্যগুলি আংশিক ভাবে এই আইন বলবৎ করলেও এ রাজ্যে তার যথাযথ প্রয়োগ হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের একজনও সমষ্টিগত পাট্টা পাননি। এই পাট্টা দেওয়ার কাজ বাম আমলে শুরু হয় রাজ্যে পালাবদলের পরে পাট্টা বিলির কাজ চলছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ঢিমেতালে কাজ হচ্ছে। ফলে, পাট্টার জন্য অনেকে আবেদন করলেও, সকলে তা পাচ্ছেন না।
সন্তোষবাবুরা জানান, ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ঝাড়গ্রাম মহকুমায় প্রায় ৪০ হাজার পরিবার পাট্টা চেয়ে আবেদন করেছে। কিন্তু পাট্টা দেওয়া হয়েছে ৩,৩৫৫টি পরিবারকে। মহকুমার বিভিন্ন ব্লকেও এক ছবি। এই অবস্থা কেন? এক প্রশাসনিক কর্তার বক্তব্য, “অনেক ভুয়ো আবেদন জমা পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে আবার উপযুক্ত তথ্য প্রমাণের অভাবে পাট্টা দেওয়া যাচ্ছে না।” পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন মন্ত্রী সুকুমার হাঁসদার অবশ্য দাবি, “আমাদের সরকার ক্ষমতায় আসার পরেই বনভূমির পাট্টা দেওয়ার কাজ শুরু করেছে।”
বন দফতরের উদ্যোগে প্রতিটি রেঞ্জ (বনাঞ্চল) এলাকায় গ্রামবাসীদের নিয়ে যে বন সুরক্ষা কমিটি (এফপিসি) গড়া হয়, তাঁদেরকে সমষ্টিগত পাট্টা দেওয়ার দাবিও জানিয়েছে ‘বনাধিকার রক্ষা মঞ্চ’। এই কমিটি সারা বছর জঙ্গল রক্ষা করে। বিনিময়ে বনজ সম্পদ বিক্রির লভ্যাংশের ২৫ শতাংশ টাকা কমিটির সদস্যদের ভাগ করে দেওয়া হয়। মঞ্চের তরফে উপাংশু মাহাতো বলেন, “যে সব গ্রামবাসী জঙ্গল রক্ষা করছেন তাঁদের সমষ্টিগত পাট্টা দিতে হবে। যতদিন না তা দেওয়া হচ্ছে, ততদিন বনজ সম্পদ বিক্রির ৫০ শতাংশ টাকা বন সুরক্ষা কমিটিগুলিকে দিতে হবে।” |
|
|
|
|
|