তা সত্ত্বেও উন্নয়নের নামে লাগামছাড়া অত্যাচার চলেছে হিমালয়ের ওপর। আসলে পরিবেশ রক্ষার
সুফল
পেতে
অনেক সময় দিতে হয়, তুলনায় পরিবেশ ধ্বংসের অর্থনৈতিক লাভ পাওয়া যায় অনেক দ্রুত। জয়ন্ত বসু |
বাড়িটা কি এখনও আছে? সেই চার তলা বাড়িটা, যেটা হৃষিকেশে রামঝুলা ছাড়িয়ে লছমনঝুলা যাবার পথে রাস্তার বাঁকে প্রায় গঙ্গার ওপরই তৈরি হচ্ছিল? বড় ঝড়ঝঞ্ঝা, মেঘ ভেঙে পড়া বা আকস্মিক বান দূরে থাক, যাকে দেখে মনে হচ্ছিল, সামান্য জোরালো বাতাসই গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে যথেষ্ট! মাত্র মাস ছয়েক আগে ঝকঝকে রোদ্দুরের বিকালে নির্মীয়মাণ বাড়িটি দেখে মনে প্রশ্ন জেগেছিল, এই সব বাড়ি তৈরির অনুমতি কে বা কারা দেন? উলটো দিকের ছোট্ট দোকানে জিজ্ঞাসা করাতে মধ্যবয়সি স্থানীয় মানুষটি হেসেছিলেন, ‘কে জানে কে দেয়, তবে এখানে তো এটাই দস্তুর। এ-রকম কত আছে!’
‘কিন্তু কোনও বড় জলঝড় হলে এরা কি বাঁচবে?’
‘বাঁচবে কি না জানি না, তবে তেমন বড় কিছু হলে অন্তত প্রশাসন হয়তো নড়েচড়ে বসবে।’ উদাস গলায় বলেছিলেন ভদ্রলোক।
সেই ক্রান্তিকাল উপস্থিত। স্থানীয় প্রশাসন দূরে থাক, দিল্লি অবধি নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়েছে উত্তরাখণ্ড ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ধ্বংসলীলায়। উত্তরকাশীতে হলিউডি সিনেমার স্পেশাল এফেক্টসের কায়দায় চার তলা বাড়ির ধসে পড়া সোশাল মিডিয়ার কল্যাণে বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়লেও, ক্যামেরার আড়ালে ভেসে গেছে বহু বাড়ি, ধর্মশালা।এটা বহু-আলোচিত যে, পৃথিবীর যে যে অঞ্চলগুলি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য, পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য, সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বে তাদের মধ্যে হিমালয় রয়েছে। হিমালয়ের অজস্র হিমবাহের গলার গতি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তারা যে কমবেশি গলছেই, তাতে সন্দেহ নেই। বলা হচ্ছে, উত্তরাখণ্ডের পাশাপাশি হিমাচল প্রদেশ বা জম্মু-কাশ্মীরের কাছাকাছি প্রায় দুশোটি এমন হিমবাহ লেক রয়েছে যারা যে কোনও সময় ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে। বিশ্বব্যাংকও সম্প্রতি একটি রিপোর্টে জানিয়েছে, উষ্ণায়ন না কমাতে পারলে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণগুলি কমানোর বিষয়ে আশু সিদ্ধান্ত নিয়ে কার্যকর না করলে, উত্তরাখণ্ডের মতো ঘটনা বার বার ঘটবে। তাদের স্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী: এমন মাত্রার বিপদ যদি আগে এক শতাব্দীতে এক বার ঘটত তবে এখন তার সময়সীমা হতে পারে এক দশকে এক বার!
প্রবীণ পরিবেশকর্মী, পদ্মবিভূষণ, সুন্দরলাল বহুগুণা দুঃখ করেন, ‘কবে থেকে বলছি যে একটা কেন্দ্রীয় হিমালয় পরিকল্পনা আর গঙ্গা পরিকল্পনা না করলে এ দেশ বাঁচবে না, কিন্তু কে কার কথা শোনে!’ কিছু দিন আগেই এই প্রতিবেদকের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন নব্বই ছুঁইছুঁই প্রবাদপ্রতিম মানুষটি, যিনি বহু দিন আগে থেকেই বিপদ বুঝে তেহরি জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র নিয়ে প্রতিরোধে মুখর হয়েছেন। তাঁর বহু দিনের অনুগামী, হিমালয় বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় হিমালয়ের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে সন্দিহান থাকলেও স্পষ্ট বললেন, ‘হিমালয় পৃথিবীর অন্যতম অ-স্থিতিশীল অঞ্চল। বাঁধ দিয়ে বা জঙ্গল পরিষ্কার করে দ্রুত অর্থনীতির উন্নয়ন করতে গিয়ে যদি পরিবেশের ওপর তাদের প্রভাব ঠিক ভাবে বিচার করা না হয়, তবে হিতে বিপরীতই হবে।’
পরিবেশ রক্ষায় সামগ্রিক ব্যর্থতা, না কি জলবায়ুর পরিবর্তন, কার দায়িত্ব বেশি সেই বিতর্কে না ঢুকে যুগলবন্দিকেই দায়ী করছেন সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট-এর ডিরেক্টর জেনারেল সুনীতা নারায়ণ। ‘নিশ্চয়ই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আছে, তা না হলে এমন ব্যতিক্রমী আকাশভাঙা বৃষ্টি এত দ্রুত হয় না। কিন্তু বিপদকে বিপর্যয় বানিয়েছে লাগামছাড়া বাড়ি, বাঁধ ও রাস্তা তৈরি। অনেক ক্ষেত্রেই যাবতীয় পরিবেশ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে নদীর গায়েই বাড়ি তৈরি হয়েছে। হিমালয় নীতি তৈরি না করলে এমন ঘটনা বার বার ঘটবে।’
এত কিছুর পরে সরকারের ভূমিকা কী? ২০০৮ সালে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা করা ‘ন্যাশনাল ক্লাইমেট অ্যাকশন প্ল্যান’-এর গোড়াতেই হিমালয়ের ওপর তার প্রভাব নিয়ে কাজের কথা থাকলেও গত পাঁচ বছরে মাঠে নেমে কোনও কাজ হয়নি। যেটা হয়েছে তা হল উন্নয়নের নামে হিমালয়ের ওপর লাগামছাড়া অত্যাচার: হোটেল তৈরির নামে, পর্যটনকে উত্সাহ দিতে রাস্তা তৈরির নামে, একের পর এক জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র তৈরির নামে, জঙ্গল ধ্বংসের নামে। ২০০৫-০৬ সালে উত্তরাখণ্ডে মোট গাড়ির সংখ্যা ছিল ৮৩ হাজার, তা আজ ১ লাখ ৮৩ হাজার; ২০১২-১৩ সালেই নথিভুক্ত হয়েছে ৪০,০০০ গাড়ি। শুধু উত্তরাখণ্ড জুড়েই ৯০০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুত্ তৈরির পরিকল্পনা হচ্ছে, গঙ্গা ও তার শাখাপ্রশাখাগুলির ওপর। প্রায় সত্তরটি জলবিদ্যুত্ কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত পাকা। ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে ষোলোটি। প্রসঙ্গত, উত্তরাখণ্ডের নিজেরই তৈরি ‘রাজ্য ক্লাইমেট অ্যাকশন প্ল্যান’-এ কিন্তু এ সব বিষয়ে সাবধান করা হয়েছিল।
নোবেল শান্তি পুরস্কারে সম্মানিত সংস্থা ‘ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ’ (সংক্ষেপে আই পি সি সি)-এর প্রধান রাজেন্দ্র পচৌরিও বহু আগে থেকে বার বারই বলছিলেন, এমন বিপদ যে কোনও সময় আসবে। ২০১২ সালের গোড়ায়, ডারবান জলবায়ু সম্মেলনের অব্যবহিত পরে এই প্রতিবেদককে পচৌরি অসহায়ের মতো বলেছিলেন, ‘আমি জানি না ওরা কী করতে চাইছে!’ তার ঠিক আগেই শেষ হওয়া ডারবান সম্মেলনে ভারত সমেত সব বড় দেশের প্রতিনিধিদের নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থ বজায় রাখতে এমন চুক্তি করা হয়, যেখানে বৈজ্ঞানিকদের গবেষণাপ্রসূত ভবিষ্যদ্বাণী ও প্রস্তাবকে বিন্দুমাত্র আমল দেওয়া হয়নি। পরবর্তী কালে ডারবানের মতো দোহাতেও চোখের সামনে দেখা কেমন করে বিজ্ঞানী-বিদ্বজ্জনদের মতো সমাজ, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এমনকী বিশ্বব্যাংকের মতো লগ্নিকারী সংস্থা এক রকম দাবি করছে আর রাজনীতির চাপানউতোর অন্য পথে চলছে।
মূল সমস্যাটা সরকারি মানসিকতার। পরিবেশ সম্পর্কে যথার্থ সচেতনতা সেখানে যদি কিছু থাকে, তবে সেটা সযত্নে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। শুধু উত্তরাখণ্ডের ক্ষেত্রে নয়, গোটা দেশেই এই সচেতনতার অভাব প্রকট, হয়তো তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে লোভ এবং দুর্নীতিও। উদাহরণ, শুধুমাত্র কয়লা উত্তোলনের জন্য ২০১১ ও ২০১২ সালে যে পরিমাণ জঙ্গল কাটার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, ২০১৩ সালের ছ’মাসেই তার বেশি পরিমাণ জঙ্গল সাফ করার অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ দফতর, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতর জানুয়ারি মাসে ‘উদ্যোগ’ নেওয়ার পর! আসলে পরিবেশ রক্ষার সুফল পেতে অনেক সময় দিতে হয়, তুলনায় পরিবেশ ধ্বংসের অর্থনৈতিক লাভ পাওয়া যায় অনেক দ্রুত নিয়মের মধ্যে ও বাইরে, দুই ক্ষেত্রেই। আর নির্বাচনের মুখে তো পরিবেশ ধ্বংসের অর্থনীতি বাঙ্ময় হয়ে উঠবেই!
উত্তরাখণ্ডের বিপর্যয়ও যে সেই ফর্মুলায় আদৌ কোনও প্রভাব ফেলতে পারবে, তার ভরসা কম। |
ঋণ: সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (সি এস ই)
ক্লাইমেট সিকিয়োরিটি, পারসেপশন্, চ্যালেঞ্জেস অ্যান্ড বিয়ন্ড, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ প্রকাশিত |