প্রবন্ধ ১...
এখনও সময় আছে সংযত হওয়ার
ত্তরাখণ্ডের সাম্প্রতিক জলপ্রলয়কে যে ভাবে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলে বর্ণনা করা হচ্ছে, সেটা বিভ্রান্তিকর। ক্ষতিকরও। মৃতের প্রকৃত সংখ্যা পাঁচ হাজার না তার অনেক বেশি, কত ভয়ংকর অভিজ্ঞতা পেরিয়েছেন বেঁচে ফেরা লোকেরা, কত ক্ষয়ক্ষতি হল রাস্তার, কী অসাধারণ সাহস ও ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দল এ সব নিয়ে অনেক আলোচনা, আত্মার শান্তিকামনা, দুর্গতদের সাহায্য-প্রচেষ্টা, সবই নিশ্চয়ই চলতে থাকবে, চলারই কথা। কিন্তু ‘বিপর্যয়’ শব্দটির মধ্যে কোথাও আকস্মিকতার অর্থ নিহিত থাকে। উত্তরাখণ্ডে যা ঘটেছে, তাকে আকস্মিক বলা যাবে না। একটা বহুতল বাড়ির বেসমেন্টে আগুন লাগিয়ে দিয়ে দশতলার মানুষদের মৃত্যুকে ‘আকস্মিক’ বলাটা কি সঙ্গত?
ধস ও জলোচ্ছ্বাসের অঞ্চলটির দিকে খেয়াল করলেই অনেকটা পরিষ্কার হবে যে, পাহাড়ের এই চূড়ান্ত দুর্যোগ অবশ্যম্ভাবী ছিল। যে ক্লাউডবার্স্ট বা মেঘভাঙা-র কথা বলা হচ্ছে, তা হিমালয়ে কুমারসম্ভবের কাল থেকে হয়ে আসছে। কিন্তু গঙ্গা ও তার প্রধান দুই উপনদী মন্দাকিনী ও অলকানন্দা, এই ত্রিভুজ অববাহিকা গত পনেরো-কুড়ি বছরে যে যথেচ্ছাচারের শিকার হয়েছে তা হিসাববিহীন। জানা যাচ্ছে, কুড়ি বছর আগে এই অঞ্চলের রাস্তায় গাড়ি চলত দৈনিক হাজার থেকে দেড় হাজার। এখন সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছে ষাট-সত্তর হাজার। বেশি অর্থবান মানুষরা যাতে কম সময়ে বিনা পরিশ্রমে যথেষ্ট পুণ্য করে আসতে পারেন, তাই হেলিকপ্টারের চক্কর চলে দৈনিক ৬০০ থেকে ৭০০ বার। এই জ্বালানি নির্গত কার্বনের কী প্রভাব পড়ে ওই সূক্ষ্ম ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্রের ওপর? অন্তত হাজার বছর ধরে লোকজন ওই পাহাড়ে, নদীর কিনারে ছোট-ছোট গ্রামে বাস করেন। সমতল থেকে শত শত বছর ধরে সন্ন্যাসী বা তীর্থযাত্রীরা হিমালয়ের পথে পথে ভ্রমণ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁরাই আবিষ্কার করছেন প্রকৃতির এক একটি পরমাশ্চর্য, তা-ই হয়ে উঠেছে দেবস্থান। তীর্থ। কখনও তা হিমবাহের কিনারে উষ্ণ প্রস্রবণ, কখনও বিজন উচ্চতার গুহার মধ্যে বরফের শিব লিঙ্গপ্রায় অবিনির্মাণ, কোথাও তুষারশিখরের আড়ালে আশ্চর্য ফুলের বন আর নদী।
পরিণাম। উত্তরাখণ্ড, ২৩ জুন, ২০১৩। ছবি: রয়টার্স।
হিমালয়ের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক তীর্থ কোনও না কোনও ভাবে নদীর সঙ্গে সম্পর্ক ধরে থাকে। একভাবে বলা যায়, এখানকার বাসিন্দারা এবং বাইরে থেকে যাওয়া মানুষরাও প্রাকৃতিক এই পরমাশ্চর্য সংস্থানের গুরুত্ব এত বেশি বুঝতেন, যে তাঁদের কাছে সমগ্র অঞ্চলটিই ছিল পবিত্র। সযত্নে সসম্ভ্রমে রক্ষা করার। এমনকী পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত গাড়োয়াল কুমায়ুনে যে সব রাস্তা তৈরি হয়েছে, পাহাড়ের ভঙ্গুরতা খেয়াল রেখে সেখানে ব্যবহৃত হয়েছে গাঁইতি-শাবল।
স্কুলপাঠ্য বইয়েও লেখা থাকে যে, হিমালয় পৃথিবীর নবীনতম পর্বত, এখনও তা সুস্থিতিশীল হয়ে ওঠেনি। তা সত্ত্বেও গত কুড়ি-তিরিশ বছরে এ দেশের অন্যান্য দুর্লভ প্রাকৃতিক সম্পদের মতোই হিমালয়কেও মাঝ-বাজারে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত হল। এবং তা হল স্থানীয় মানুষদের বিরোধিতায়, দেশের ও রাজ্য সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। ভারতের ভূ-তত্ত্বে, প্রাকৃতিক অবস্থানে, জলবায়ুর স্বভাব নির্ধারণে হিমালয় পর্বত ও তার নদী-সংসারের উপস্থিতি যে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে, সেই গুরুত্বকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে এই পর্বতমালাকে তাত্‌ক্ষণিক খুচরো লাভের জন্য বেচা শুরু হল। বন্যার বিবরণে জানা যাচ্ছে, অন্তত ১২০০ জায়গায় রাস্তা ভেঙে গেছে, ভেসে গেছে অন্তত ১৪৮টি সেতু। ঘোর বর্ষাকালে ৫৫ হাজার থেকে ১ লক্ষ লোক ছিলেন সমস্ত এলাকাটিতে। এক-একটি ভ্রমণ সংস্থা ৫০-৬০ জন সত্তরোর্ধ্ব মানুষকে নিয়ে এসেছে। এঁরা কিন্তু সে রকম মানুষ নন, যাঁরা লাঠি-হাতে পদব্রজে পাহাড়ের রাস্তায় হাঁটতে পারেন। এই লক্ষ লক্ষ পর্যটক, যাঁরা এই বিশাল দেশের যে-কোনও জায়গায় বেড়াতে যেতে পারতেন তাঁদের সকলকে কেন আনতেই হবে ‘বিনা আয়াসে চারধাম’ ভ্রমণ করাতে? ট্যুরিজম’কে ‘ইন্ডাস্ট্রি’ করে তুলতে হবে সেই সব অঞ্চলেরও জন্য, যেখানকার ভূ-প্রকৃতি এত ধকল সহ্য করতে পারবে না, সেখানেও? যেখানকার শান্ত স্থিতিশীল সমাজ ট্যুরিজমের আলগা টাকা প্রার্থনা করেনি, সেখানেও? গাড়োয়াল হিমালয়ের বিপুল নদী-অবতরণকে স্থাপকতা দিয়ে ভূস্খলন প্রতিরোধ করত এখানকার গভীর অরণ্যানী। রাস্তা, বাঁধ, হোটেল, রিসর্ট, বহুতল ধর্মশালা তৈরির জন্য যথেচ্ছ বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে এই ধর্মপ্রবণ অঞ্চলে। স্থানীয় লোকেদের উন্নয়নের নামে ধ্বংস হয়েছে তাঁদের জীবনযাপন পদ্ধতি। ২০১০ সালের গ্রীষ্মে মাইলের পর মাইল জুড়ে রুদ্রপ্রয়াগ থেকে পৌরি, ল্যান্সডাউন পর্যন্ত আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে অরণ্যে। অসংখ্য বিস্ফোরণে আপাদমস্তক পাহাড় কাঁপিয়ে তৈরি হয়েছে পাকা রাস্তা। গৌরীকুণ্ড, গঙ্গোত্রী, হরশিল, জানকীচটি প্রতিটি সংকীর্ণ ভঙ্গুর গিরিপ্রস্থে তৈরি হয়েছে ছ’তলা, আটতলা বিশাল সব হর্ম্য। একসঙ্গে হাজার আরামে থাকার জায়গা। এই ট্যুরিজম শিল্পের অনিয়ন্ত্রিত অপরিণামদর্শী বিস্তারের পরিণামে ধ্বংস হয়ে গেল বহু জায়গায় পাহাড়ের স্বাভাবিক ঢাল, জঙ্গল। এখনও বলা যাবে না, কী পরিবর্তন হতে পারে ছোট-মাঝারি জলধারাগুলির গতিপথে। যে দ্রষ্টব্যকে দেখবার জন্য এত আকর্ষণ, আয়োজনের চাপে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল সেই গৌরীকুণ্ড-কেদারনাথের পথ। সঙ্গে গেল মানস সরোবর যাওয়ার রাস্তাও। ধ্বংস হয়ে গেল কত যে ধাপ-খেত, যা এখানকার মানুষদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অভ্যস্ত ফসলভাণ্ডার। যে-সব ধাপ-খেত তৈরি করতে এক-দুই প্রজন্মের পরিশ্রম লাগে। হিমালয়ে শত শত বছর ধরে বহু মানুষ স্বয়ংভর ভাবে বাস করে এসেছেন, পালন করে এসেছেন সহস্র সাধুসন্ন্যাসীকে, আতিথ্য দিয়েছেন সাধারণ তীর্থযাত্রীদের। দায়িত্বজ্ঞানহীন ‘ভ্রমণশিল্প’ সেখানে উদ্যোক্তাদের কিছু-দিন কিছু আর্থিক সুবিধা দিলেও অঞ্চলের ভৌগোলিক ও সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থার অত্যন্ত ক্ষতি করে।
এ বারের বিধ্বংস যে অবশ্যম্ভাবী ছিল, তার সাক্ষ্য দেবে ২০১২ সালের ৩-৪ মে উত্তরকাশীর বিরাট ধস। জনপদের অর্ধেকটা ভেঙে নেমে গিয়েছিল। গত বছর ১৩-১৪ সেপ্টেম্বর উখিমঠে ধস ও জলোচ্ছ্বাসে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৬৯ জন। তা সত্ত্বেও এ বার, এই পাহাড়ি বর্ষার দিনে, সেই ধসপ্রবণ অঞ্চলে গঙ্গোত্রী হরশিল গাঙনানি উত্তরকাশী রুদ্রপ্রয়াগ গোবিন্দঘাট গৌরীকুণ্ডের মতো পলকা জায়গায় ছ’তলা আটতলা আশ্রম-ভবনে হোটেলে ধর্মশালায় ৬ ২৪টি বাঁধের নির্মাণ বন্ধ করার যে পরামর্শ দিয়েছিল, তাও সরকারের জলবিদ্যুত্‌ মন্ত্রক কারণ না দেখিয়েই অগ্রাহ্য করেছে। সমস্ত অঞ্চলটির স্থিতিস্থাপকতার দিকে লক্ষ্যমাত্রা না-করে কেবল নির্মাণ ও অন্য কয়েকটি সংশ্লিষ্ট লবির জোরেই গাড়োয়াল হিমালয়কে সর্বনাশের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন, বিশেষত যখন দেখা যায় অসিগঙ্গা, বিরহীগঙ্গা, ধৌলিগঙ্গার মতো ধারাগুলির ওপর নির্মিত বাঁধের বিদ্যুত্‌ উত্‌পাদনের লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে চার মেগাওয়াট, সাত মেগাওয়াট, পাঁচ মেগাওয়াট ইত্যাদি, যে বিদ্যুত্‌ সরবরাহ করতে গিয়েই খরচ হয়ে যায় এক-তৃতীয়াংশ (ট্রান্সমিশন লস)।
প্রকৃতি স্বয়ং আপত্তি ব্যক্ত করলেন এই অবিমৃশ্যকারী ঔদ্ধত্য সম্পর্কে। ধৌলিগঙ্গা প্রজেক্ট ডুবে গেছে। বদ্রীনাথের কাছে কালীগঙ্গা প্রজেক্ট ভেঙেছে। ভেঙেছে মন্দাকিনীর ওপর ফাটা প্রজেক্ট। শ্রীনগর শহরের অর্ধাংশ কাদায় ডুবিয়ে ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অলকানন্দার বাঁধ। ওই এলাকায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ কমপক্ষে ১২টি। এ-সব বাঁধ নির্মাণ নিয়ে কিন্তু কংগ্রেস ও বিজেপির কোনও মতানৈক্য দেখি না। যে নরেন্দ্র মোদী স্পর্ধাভরে কেদার মন্দির সংস্কারের টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করেন, গঙ্গা রক্ষার বিষয়ে তাঁর মুখে একটি শব্দও শোনা যায় না। মনে পড়ে, বাজপেয়ী সরকার যখন আপার গঙ্গা বেসিনের বাঁধগুলিকে অনুমোদন দেয়, কংগ্রেস ‘চোখ বুজে কোন কোকিলের দিকে’ কান ফিরিয়ে রেখেছিল। সরকার ও বাজারের এই সংবেদনশূন্য ঔদ্ধত্যই হরিদ্বারের গঙ্গার মাঝখানে বিকট শিবমূর্তির স্পর্ধা বানিয়ে তোলে হিমালয়ের নদী-অরণ্যের সম্ভ্রম ধ্বংস করে। কিন্তু যথেচ্ছ নিয়মভঙ্গের শাস্তি পেতে হয়। প্রাকৃতিক নিয়মের শক্তি অহঙ্কৃত স্পর্ধায় প্রকাশমান নয়, কিন্তু দুর্বলও নয় তা। বদ্রীনাথ থেকে ৫২টি ধারা জড়ো করে নেমে আসা অলকানন্দা, মন্দাকিনী, শত শত ধারায় অবতীর্ণা হিমালয়নন্দিনীরা অমোঘ শক্তি ধরে। ক্রমাগত বেনিয়মের উদ্ধত আঘাত নিজেই প্রত্যাঘাত আহ্বান করে এনেছে। ১৫-১৬ জুনও বিপদসংকেত মাত্র। ক্ষমতাপক্ষের প্রতি। হয়তো এখনও সময় আছে সংযত, স্বাভাবিক হওয়ার।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.