হুল্লোড়
কে বলেছে আমি কমেডি করতে করতে ক্লান্ত

এ বার তা হলে কৌতুকাভিনেতার ইমেজ ভেঙে বেরিয়ে আসবেন ঠিক করেছেন?

না। ঠিক তা নয়। আমি কমেডি অভিনয় ছাড়ব না। কিন্তু ছকে বাঁধা কমেডি ছবির অভিনয় থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করব। কমেডির পাশাপাশি সিরিয়াস চরিত্রে বারবার অভিনয়ের সুযোগ খুঁজব।

যেমন করলেন ‘মেঘে ঢাকা তারা’য়। যে-সে চরিত্রে নয়, নাট্যকার ও নাট্যকর্মী বিজন ভট্টাচার্যের চরিত্রে?
হ্যা।ঁ অনেকটা তাই। পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় যখন বললেন যে, ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে ছবি হচ্ছে, এবং আমাকে সেখানে বিজন ভট্টাচার্যের (ছবিতে নাম বিক্রম) চরিত্রে অভিনয় করতে হবে, আমি তা শুনে আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিলাম।

এই চরিত্র করার আগে বিজন ভট্টাচার্যের ছেলে নবারুণ ভট্টাচার্যের সঙ্গেও তো যোগাযোগ করেছিলেন। উনি কী টিপস দিয়েছিলেন?
নবারুণদা যেহেতু আমার ছবি ‘হারবার্ট’য়েরও লেখক ছিলেন, তাই ওঁকে অ্যাপ্রোচ করাও সহজ ছিল। আমি আর কমলেশ্বর দু’জনে মিলেই গিয়েছিলাম। নবারুণদা প্রথমে আমাকে বিভিন্ন সময়ে তোলা ওঁর বাবার কয়েকটা ছবি দেখালেন। তার পর হঠাৎই বললেন, “না তোকে কিছু বলব না। তুই ‘পদাতিক’ ছবিটা দ্যাখ। তা হলেই বুঝতে পারবি বাবা কেমন মানুষ ছিলেন।” ‘পদাতিক’ বারবার দেখতে দেখতেই বিজন ভট্টাচার্যের সম্পর্কে একটা ধারণা হয়। অসম্ভব আত্মবিশ্বাসী, আপসহীন একজন মানুষ। এ ছাড়া আমি কিছু বইপত্র পড়েছিলাম ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে। যা থেকে বুঝতে পারি, ঋত্বিক ঘটক সম্পর্কে বিজন ভট্টাচার্য খুবই স্নেহপ্রবণ ছিলেন।

পরিচালক কমলেশ্বরের কাছে কী ধরনের পরামর্শ পেয়েছিলেন?
পরামর্শের চেয়েও বড় ছিল ওর চিত্রনাট্য পড়ার স্টাইল। ওর স্ক্রিপ্ট রিডিং শুনতে শুনতেই চরিত্রটা চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল।
এক দিকে ‘হারবার্ট’ অন্য দিকে ‘মেঘে ঢাকা তারা’কোন ছবিতে কাজ করে কেমন লাগল?
দু’টো কাজ করেই যথেষ্ট আনন্দ পেয়েছি। তবে কৌতুকাভিনেতা থেকে সিরিয়াস রোলে প্রথম কাজ কিন্তু ‘হারবার্ট’ নয়। ‘শিল্পান্তর’ ছবিতে একটা দারুণ চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে অভিনয় করি। কিন্তু ‘হারবার্ট’ করার পর মানুষ আমার সিরিয়াস অভিনয়ের জায়গাটা জানল। ইন্ডাস্ট্রিও জানতে পারল আমিও সিরিয়াস অভিনয় করতে পারি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় একটাই যে, ‘হারবাটর্’ করারপর আমার কাছে অন্য ধরনের কাজ তেমন আসেনি।

ক্রমাগত কমেডি অভিনয় করতে করতে মনে হয় না আপনার প্রতিভার অপচয় হয়ে গিয়েছে?
না, একদমই মনে হয় না। আমি তো কাজ করছি। এর পরেও নানা রকম কাজ করব।
এখন তো পরপর সিরিয়াস রোলে অভিনয় করছেন। ‘দত্ত ভার্সেস দত্ত’, ‘মিসেস সেন’ এই সব ছবিতেই তো সিরিয়াস রোল।
বাংলা ছবির স্টাইল বদলেছে। সিরিয়াস চরিত্রে অভিনয় করারও সুযোগ পাচ্ছি। এর পর ‘খাসি কথা’, ‘কলকাতার কিং কোম্পানি’, ‘পেন্ডুলাম’, ‘আ পলিটিক্যাল মার্ডার’ এই সব ছবিতে আমার একেবারে অন্য ধরনের চরিত্র। শুধু তাই নয়। কৌতুকাভিনেতা থেকে একেবারে নেগেটিভ রোলে চলে এসেছিলাম সন্দীপ রায়ের ‘গোরস্থানে সাবধান’ এ।


দীর্ঘ দিন ধরে কমেডির কাজ করছেন। ক্লান্ত লাগে না?
কে বলেছে কমেডি করতে করতে আমি ক্লান্ত? কমেডি আমাকে মানুষের কাছে নিয়ে গিয়েছে। বরং বলা যায় কমেডির হাস্যরস থেকে ক্রমশ গভীর জীবনবোধে যেতে চাইছি। তাই অন্য রকম কাজ করার খিদেটা সব সময়ই পেটের ভেতর মোচড় দেয়।

তাই যদি বলেন ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’য়ের মতো হাসির ছবিতে আপনাকে দেখা গেল না কেন?
আমি ডেট দিতে পারিনি বলে। আমাকে মুসলমান বাবুর্চির রোলটা করার কথা পরিচালক বলেছিলেন। সময়দিতে পারলাম না। তবে অনীক দত্তের সঙ্গে আমি আগে বিজ্ঞাপনে কাজ করেছি। ওঁর সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা আমার আছে।

কমেডি শিল্পী হিসেবে আপনার জীবনের আদর্শ বা গুরু কে?
আমি বড় হয়েছি উত্তর কলকাতায়। পেশাদার নাটক দেখতে দেখতে। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়,রবি ঘোষ- অনুপকুমাররা তখন কমার্শিয়াল থিয়েটার মাত করে রাখতেন। এঁদের সকলের কাছ থেকেই কিছু না কিছু শিখেছি।
তা ছাড়া চার্লস স্পেনসর চ্যাপলিন তিনিও তো আমাকে কত কাজে, কত ভাবে অনুপ্রাণিত করে আসছেন।

কমেডিটা যে আপনি ভাল পারবেন এটা বুঝলেন কী করে?
বুঝলাম দর্শক যখন আমার অভিনয় দেখে হাসতে শুরু করলেন তখনই। টেলিভিশনে ‘বিবাহ অভিযান’ সিরিয়ালে অভিনয়ের সময় থেকেই কমেডির প্রতি আমার ঝোঁক যায়।

কমেডিতে যে টাইমিং সেন্সের ব্যাপার আছে, সেটা আয়ত্ত করলেন কী ভাবে?
এটা ভেতরে থাকে। কোথাও কারও কাছে শিখে আয়ত্ত করা যায় না।
‘মেঘে ঢাকা তারা’র একটি দৃশ্যে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় ও শুভাশিস মুখোপাধ্যায়

আপনার স্ত্রী ঈশিতা মুখোপাধ্যায় তো এই সময়কার বিখ্যাত নাট্য পরিচালক। শুনেছি উনিই আপনাকে চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে বলে নিজেই সংসারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন?

হ্যাঁ, আজ আমি যা হয়েছি, তার প্রায় পুরোটাই আমার স্ত্রীর জন্য। আমি চাকরি ছেড়ে অভিনয়ে মন দিলাম। তখন কম কাজ আসত। আমার স্বল্প রোজগার, আর ঈশিতার আয়ে সংসার চলত। চাকরি করতে গিয়ে ঈশিতাকে বহু বছরের জন্য নাটকের চর্চাটাও বন্ধ রাখতে হয়েছিল।

সিনেমায় জায়গা করে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রসেনজিতের ভূমিকা কতটা?
অনেকটাই। আমার সিনেমা জীবনে দু’জন মানুষের অবদান অনস্বীকার্য। এক জন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, অন্য জন স্বপন সাহা। স্বপন সাহার বাহান্নটা ছবিতে অভিনয় করেছি আমি। বহু ছবিতে প্রসেনজিৎ আর আমি দুই বন্ধু হিসেবে কাজ করতে করতে প্রায় জুটির মতো হয়ে গিয়েছিলাম। নায়কের বন্ধুর রোলে বারবার আমাকে নেওয়ার জন্য প্রসেনজিতের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। স্বপন সাহার ছবির বাইরে অন্য সব পরিচালকের ছবিতেও বন্ধুর চরিত্রে আমাকে নিয়ে কাজ করেছেন প্রসেনজিৎ। কাজ পেতে সাহায্য করেছেন বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়ও।

সিনেমার আগে নাটকে অভিনয় করেছেন। এমনকী জার্মান নাটকের রূপান্তরেও। নাটকটা কি ছোটবেলা থেকেই করছেন?
সে তো ক্লাস ফোর থেকেই অভিনয় করছি। স্কটিশ চার্চ কলেজে ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় বাংলার মাস্টারমশাই গৌরচন্দ্র সাহার নাটকের দল ‘সপ্তর্ষি’তে যোগ দিই। আর হাতিবাগানের পেশাদার থিয়েটারে আমার যোগ দেওয়া ‘শ্যামলী’ নাটক দিয়ে। এই নাটকে একদা নায়কের রোলে অভিনয় করতেন উত্তমকুমার। আমি যে চরিত্রটা অভিনয় করতাম সেটা করতেন অনুপকুমার।
আর জার্মান নাটক করতাম ম্যাক্সমুলার ভবনে। জার্মানি থেকে অলকরঞ্জন দাশগুপ্ত বিভিন্ন জার্মান নাট্যব্যক্তিত্বদের জীবনী নিয়ে বাংলা নাটক লিখে পাঠাতেন। নাটকের পাণ্ডুলিপির ওপরে লেখা থাকত “মূল চরিত্রে অভিনয় করবে শুভাশিস’।


প্রথম ছবি তো পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী’। তাঁর কাছে পৌঁছলেন কী ভাবে?
সেটা তো ১৯৮১ সালের কথা। আমি সেই সময় ‘বিবিধ ভারতী’তে নাটক করি। রেকর্ডিং হত হ্যারিংটন স্ট্রিটে। শ্রাবন্তী মজুমদারের একটা স্টুডিয়ো ছিলনাম ‘লিভিং সাউন্ড’। সেইখানেই কোনও এক জনের কাছে জানতে পারি পূর্ণেন্দুবাবু ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী’ করছেন। ছুটতে ছুটতে গিয়েছিলাম আনন্দবাজারের অফিসে। দেখা হতে উনি বললেন ছবিটা কিন্তু পলিটিক্যাল। সঙ্গে সঙ্গে আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। আমতা আমতা করে আবার ‘লিভিং সাউন্ড’-এর অফিসে। সেখানে বসেছিলেন নাট্যশিল্পী গৌতম চক্রবতী ও শ্রাবন্তীদি। ওঁদেরকে বললাম ঘটনাটা। ওঁরা সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘সে কি? এত ভয় পাওয়ার কী আছে? পলিটিক্যাল ছবি মানে পলিটিক্স করা তো নয়।’ আমি আবার দৌড়তে দৌড়তে ফিরে গেলাম পূর্ণেন্দুবাবুর কাছে। রাজি হয়ে গেলাম ছবিটা করতে। শুরু হল আমার সিনেমার কাজ। সিনেমাই বা কেন? আমি তো যাত্রা, ওয়ান ওয়ালেও কাজ করে চলেছি। এখনও আকাশবাণীতে অভিনয় করি। অভিনয়ের সব মাধ্যমেই আমার সমান যাতায়াত।

বিজন ভট্টাচার্যের মতো রাজনীতি সচেতন চরিত্রে অভিনয় করলেন। কখনও রাজনীতিতে যাওয়ার কথা ভেবেছেন? আজকাল তো টলিউডের অনেক শিল্পী রাজনীতিতে আগ্রহী।
না, আমি শুধু অভিনেতাই থাকতে চাই। রাজনৈতিক মত জানাব ব্যালট বক্সে।

মানে মিটিং মিছিলে যাবেন না?

না। মিছিলে যাব না। মিছিলে গেলে দর্শক ধরে নেবে আমি অমুক পার্টির সমর্থক। হয়তো তিনি সেই পার্টিকে সমর্থন করেন না। ব্যস, অমনি আমার ছবি দেখা বন্ধ করে দেবেন। এমন তো হতেই পারে। মিছিলে গিয়ে দর্শক হারাতে চাই না। আমি ইস্টবেঙ্গল না মোহনবাগান সেটাও জানাতে চাই না। যদি কোনও ছবির চরিত্রে রাজনৈতিক ইস্যু প্রতিফলিত হয়, আমি নিশ্চয়ই সেই চরিত্রে অভিনয় করব। আমার প্রতিবাদ থাকবে ছবির মাধ্যমে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.