বাবা জ্ঞান দিয়োনা
শূন্য এ বুকে
কটা গল্প শোনাতে ভালবাসেন লীনা। অ্যামাজোনিয়ান-দের গল্প!
গ্রিক পুরাণে উল্লিখিত এক অত্যাশ্চর্য রাজ্য অ্যামাজোনিয়া। সেখানে বসবাসের অধিকার ছিল শুধু নারীদের। তাঁরা প্রত্যেকে যোদ্ধা, তাঁরাই অ্যামাজোনিয়ান। খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম শতকে তাঁদের অস্তিত্ব ছিল বলে জানিয়েছেন অনেক গবেষক। সেই রাজ্যে পুরুষদের দেশের বাইরে থাকতে হত। শুধু সন্তান উৎপাদনের জন্য বছরে কয়েকটা দিন তাঁদের প্রবেশাধিকার ছিল রাজ্যে। পুত্রসন্তানদের নিয়ে যেতেন বাবা-রা। কন্যাসন্তান থাকত মায়ের সঙ্গে। তাকে লালনের জন্য মেয়েরা নিজেদের একটি স্তন রক্ষা করতেন। আর ডান দিকের স্তনটি অনায়াসে কেটে ফেলতেন যুদ্ধের সুবিধার জন্য, যাতে সহজে ভারমুক্ত হয়ে ডান হাতে ধনুর্বাণ বা তলোয়ার চালাতে পারেন।
গল্পটা প্রতীকী। চুম্বকে লীনাদের বার্তার সারৎসার অযথা স্তনের সঙ্গে নারীত্বকে জড়িয়ে আবেগপ্রবণ হওয়া বোকামি। আর পাঁচটা দেহাংশের মতোই এটা একটা। মূলত সন্তানের জন্য এর প্রাকৃতিক অস্তিত্ব। ‘সেকেন্ডারি সেক্স অর্গান’ শিরোপা পুরোপুরি মিথ, চাপিয়ে দেওয়া। হাত-পা বাদ গেলে তো এক জন মহিলার নারীত্ব চ্যালেঞ্জের সামনে পড়ে না। তা হলে কোনও কারণে স্তন বাদ দিতে হলে কেন নিজেদের যৌনতা বা আবেদন নিয়ে তাঁরা অনিশ্চয়তার মুখে পড়বেন?
জোকা-র লীনা মুখোপাধ্যায়, চুঁচুড়ার সবিতা বারুই, কাটজুনগরের রিঙ্কু চৌধুরী বা সল্টলেকের বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের মতো অনেকেই কিন্তু ‘ম্যাসটেকটমি’ (ক্যানসারের জন্য স্তন কেটে বাদ দেওয়া)-র পরে এতটুকু হীনমন্যতায় না ভুগে আকণ্ঠ জীবন উপভোগ করছেন। দাপটে বাঁচছেন, আর নিজেদের জীবনের উদাহরণে অনেক মহিলার শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে দিচ্ছেন মাথা উঁচু করে বাঁচার খিদে। ভরপুর নারীত্বে বসবাস করার জন্য স্তনের থাকা না-থাকার উপর নির্ভর করতে হয়নি এই মহিলাদের। যুগযুগান্ত ধরে যৌনতা, সৌন্দর্যতত্ত্বের সংজ্ঞার সঙ্গে স্তনকে মিলিয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। সেই সংজ্ঞা অগ্রাহ্য করে তাঁরা বিশ্বাস রেখেছেন আমিত্বের উপর। আর এই জায়গাতেই হলিউড তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলিকে পিছনে ফেলে দিয়েছেন তাঁরা।
অ্যাঞ্জেলিনা জোলি। এখনও যাঁর কাছে নারীত্বের সংজ্ঞা হয়তো স্তনের সৌন্দর্য
স্তন ক্যানসারের জিন শরীরে বহন করছিলেন বলে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসাবে নিজের দু’টি স্তন অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বাদ দিয়েছেন অ্যাঞ্জেলিনা। গোটা বিশ্বের সংবাদমাধ্যম যখন সেই খবর চেটেপুটে খাচ্ছে তত দিনে কিন্তু দুই স্তন প্রতিস্থাপন হয়ে গিয়েছে তাঁর। অর্থাৎ কৃত্রিম স্তন তৈরি করে নিয়েছেন। বহিরঙ্গের সৌন্দর্য এতটুকু টাল খায়নি । যুক্তিযোগ্য ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, বিনা স্তনে পৃথিবীর মুখোমুখি হওয়ার সাহসটাই তো দেখাতে পারলেন না হলিউডের নায়িকা। সেই আটকে রইলেন স্তন-কেন্দ্রিক সৌন্দর্য চেতনা, যৌন আবেদনের জালে। তা হলে কেন তাঁর সিদ্ধান্তকে মাথায় তুলে এত বাহবা দেওয়া?
হিম্মত বরং দেখিয়েছেন একেবারে সাদামাঠা এই বাঙালি মহিলারা। যাঁদের সেই অর্থে সামাজিক ভাবে সমালোচনায় বিদ্ধ করা সহজ। স্তনকে যৌবন আর যৌনতার অভিজ্ঞান প্রমাণ করে এঁদের মধ্যেই তো স্তনহীনতা নিয়ে একরাশ আত্মবিশ্বাসহীনতা ঢোকানো যেত মসৃণ ভাবে। কিন্তু সব হিসাব উল্টে দিয়েছেন এঁরা।
লীনা মুখোপাধ্যায়ের কথা দিয়ে শুরু করা যাক। পনেরো বছর আগে স্তন ক্যানসার ধরা পড়ে তাঁর। তখন তাঁর বয়স মাত্র তেতাল্লিশ। বাদ দিতে হয় একটি স্তন। তার পর দু’বছর বাদে দ্বিতীয় স্তনেও ক্যানসার হয়। সেটিও বাদ যায় ৪৫ বছর বয়সে। স্তন প্রতিস্থাপন করার আর্থিক সামর্থ্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তিনি প্রয়োজন বোধ করেননি। বছর পাঁচেক আগে বড় মেয়ে মাত্র ২৯ বছর বয়সে মারা গিয়েছেন সেই স্তন ক্যানসারেই। তা-ও জীবন হার মানাতে পারেনি লীনাকে। যে সব মহিলা ম্যাসটেকটমি-র পর অবসাদে ভোগেন তাঁদের কাউন্সেলিং করেন তিনি। বোঝান, নিজের অস্তিত্বকে এত দেহনির্ভর ভাবাটা নিজেকে অপমান করা। লীনার কথায়, “যৌনতা বা আকর্ষণের সঙ্গে স্তনের সম্পর্কটা পুরোটাই একটা ধারণা। স্বামী বা বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে সম্পর্ক যদি স্তনের থাকা বা না-থাকার উপর নির্ভর করে তবে ওই ঠুনকো সম্পর্ক ভাঙাই ভাল।”
গত বছর এপ্রিলে ক্যানসারের জন্য একটি স্তন বাদ দিতে হয়েছে কাটজুনগরের বছর ঊনপঞ্চাশের রিঙ্কু চৌধুরীর। রিঙ্কুর সোজাসাপ্টা বক্তব্য, “আমার নারীত্ব আমার কাছে। স্বামীর সঙ্গে এত দিনের সম্পর্ক কখনও স্তন থাকা বা না-থাকা দিয়ে মাপা যায় নাকি? স্তন অপারেশনের পর আমি বিশেষ ব্রা পরি। আর কিছু দরকার নেই।”
ম্যাসটেকটমির পরে অনেক মহিলার কাউন্সেলিংয়ের দায়িত্ব সামলান নূপুর চক্রবর্তী। মূলত স্তন ক্যানসার সার্ভাইভারদের নিয়ে তৈরি ‘হিতৈষিণী’ নামে সংস্থার সচিব তিনি। তাঁর অভিজ্ঞতায় অধিকাংশ পুরুষ, তা সে যে অর্থনৈতিক বা সামাজিক স্তরের বাসিন্দাই হোন না কেন, তাঁদের কাছে স্তন বাদ যাওয়া মানে নারীর যাবতীয় যৌন আকর্ষণ নষ্ট হয়ে যাওয়া। আসলে যুগান্ত পার করে ইতিহাস, কাব্য, সাহিত্য, দর্শন, চিত্রকলা, ভাস্কর্য সর্বত্রই স্তনের যৌন আকর্ষণের স্তুতি দেখতে দেখতে কখন যেন ধারণাটা আমাদের জিনে ঢুকে পড়েছে। নারী মানেই দেহসর্বস্ব। পুরুষের নর্ম্যসহচরী। তাঁর সঙ্গে মানসিক বা আত্মিক সম্পর্কটা অগুরুত্বপূর্ণ।
প্লাস্টিক সার্জন মণীশমুকুল ঘোষ তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা বলছিলেন। তাঁর কাছে ম্যাসটেকটমির পর অধিকাংশ মহিলা আসেন অসম্ভব ডিপ্রেশন নিয়ে। তাঁদের নিজেদের বিকলাঙ্গ মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে স্বামী বা পুরুষবন্ধুর কাছে মূল্য কমে গিয়েছে, তাঁরা যে কোনও সময় ছেড়ে চলে যেতে পারেন। মণীশের কথায়, “অদ্ভুত ভাবে অধিকাংশকেই স্তন প্রতিস্থাপনের জন্য নিয়ে আসেন তাঁদের স্বামীরা। অতএব ধরে নেওয়া যেতে পারে তাঁদের এ ব্যাপারে ইচ্ছা বা সম্মতি রয়েছে। তাঁরা কেউ নিশ্চয়ই ওই মহিলাদের বলেননি যে, “স্তন না থাকলেও তুমি আমার কাছে একই রকম কাম্য বা অপরিহার্য।”
এই জায়গাটাকেই শোধরাতে চান সবিতা, বিজয়ারা। সচেতন করতে চান ওই মেয়েদের ও তাঁদের পরিবারকেও। ক্যানসারের জন্য সল্টলেকের বাসিন্দা বিজয়াদেবীর একটি স্তন বাদ যায় নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। প্রথম দিকে একটা অসহায়তা কাজ করত। নিজেকে অসম্পূর্ণ মনে হত। সব সময় শাল বা চাদর গায়ে জড়িয়ে থাকতেন। ঝুঁকে হাঁটাচলা করতেন। তার পর ভাবলেন, এই ভাবে মুখ গুঁজে থাকবেন না। মুম্বই গিয়ে বিশেষ প্যাডেড ব্রা নিয়ে এলেন। এ হেন বিজয়া এখন অন্য রোগিণীদের বোঝান, “একটা স্তন তোমার পরিচয় হতে পারে না। স্তন গেল তো কী হল? তার পরেও তুমি সম্পূর্ণ এক নারী।”
চুঁচুড়ার সবিতা বারুই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপিকা। স্বামীর মৃত্যু হয়েছিল ২০০৬ সালে প্রস্টেট ক্যানসারে। তার পাঁচ বছর পর স্তন ক্যানসার হল সবিতার। ২০১১ সালে ডান দিকের স্তন বাদ দিতে হল। প্রথম-প্রথম পিঠের-হাতের মাংসপেশিতে খুব ব্যথা হত। বুকে টান লাগত, চড়চড় করত। মনে হত শরীরটা এক দিকে কাত হয়ে যাচ্ছে। তার পর বিশেষ ভাবে বানানো প্যাডেড ব্রা পরতে লাগলেন। কিছু ব্যায়াম নিয়মিত করতে হয়। রোজ কলেজ যাচ্ছেন, পড়াচ্ছেন, বাড়ি সামলাচ্ছেন। বলেন, “স্তন থাকা বা না-থাকা কোনও মেয়ের অস্তিত্বে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারে না।”
ক্যানসারের সঙ্গে লড়াইয়ে এঁরা জয়ী। সেই জয়ের উদ্যাপনে একটি উপাঙ্গ হারানোর আফশোসের কোনও জায়গা নেই। অ্যাঞ্জেলিনা থাকুন তাঁর বিশ্বাস নিয়ে তাঁর দুনিয়ায়। সবিতা, বিজয়া, লীনা-রা বলছেন, দেহসর্বস্বতা ঝেড়ে ফেলে এ বার ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এসেছে মেয়েদের।

সাহসিনী যাঁরা
স্তন তোমার পরিচয় হতে পারে না। গেল তো কী হল?
তার পরেও তুমি সম্পূর্ণ এক নারী
বিজয়া মুখোপাধ্যায়

যৌনতা বা আকর্ষণের সঙ্গে স্তনের সম্পর্কটা
পুরোটাই একটা ধারণা মাত্র
লীনা মুখোপাধ্যায়

আমার নারীত্ব আমার কাছে। স্বামীর সঙ্গে এত দিনের
সম্পর্ক স্তন থাকা বা না-থাকা দিয়ে মাপা যায় নাকি?
রিঙ্কু চৌধুরী



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.