অ্যাডভান্টেজ সাদা |
সাদা পোশাক মানেই একঘেয়ে নয়। সদ্য শুরু হওয়া উইম্বলডনের কোর্টে তা বারেবারেই
প্রমাণিত। বিতর্ক থেকে
যৌন আবেদন সবই রয়েছে ছোট্ট স্কার্টের কুচির ভাঁজে। আর
তা অনুপ্রেরণা
জোগাচ্ছে কেতাদুরস্তদের। লিখছেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত |
এক সময় উইম্বলডনের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার ইয়ান রিচি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, তাঁর চাকরির একটা অদ্ভুত দিক হল তাঁকে অফিসে বসে পার্সেল ঘেঁটে চেক করতে হয় যে খেলোয়াড়দের পোশাকের রং ঠিক আছে কি না! হঠাৎ হয়তো একটা পার্সেল এল ‘মারিয়া শারাপোভা’ নামে। আর সেটা উল্টে-পাল্টে দেখে নিতে হয় যে সেটা সম্পূর্ণ সাদা কি না!
তবে সাদা পোশাক মানেই বোরিং নয়। সেই ১৯৪৯য়ে ‘গর্জাস গেসি’ এতটাই ছোট স্কার্ট পরেছিলেন যে তখনকার অল ইংল্যান্ড ক্লাব কমিটি থেকে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল, তিনি টেনিসের দুনিয়ায় নিয়ে আনছেন ‘অশ্লীলতা আর পাপ’! এই ঘটনার ঠিক ন’বছর পরে ক্যারল ফাগেরসের সোনালি শর্টস আবার ঝড় তোলে। স্কার্টের তলায় এই শর্টস পরার জন্য তাঁকে ‘ব্যান’ করে দেওয়া হয়। ওই পোশাক পালটানোর পরেই তিনি আবার কোর্টে ফিরতে পারেন। ১৯৮৩তে মাঠে নামেন অ্যান হোয়াইট। অনেকেই বলেন তিনি নাকি তাঁর পদবিটা এতটাই সিরিয়াসলি নিয়ে ফেলেছিলেন যে কোর্টে নামেন একটি আঁটোসাঁটো ক্যাট স্যুট পরে। পোশাকে অশ্লীলতা ছিল না। তবে নেটের উল্টো দিকে প্যাম শ্রিভার নাকি এই পোশাকের জন্যই ‘ডিসট্র্যাক্টেড’ হয়ে হেরে যান! |
|
|
|
বেথানি ম্যাটেক স্যান্ড |
মারিয়া শারাপোভা |
স্টেফি গ্রাফ |
|
এই শতাব্দীতে উইম্বলডন ফ্যাশন শিরোনামে এসেছে আরও অন্যান্য কারণে। কখনও অ্যানা কুর্নিকোভার ‘মিড রিফ’ দেখানো ছোট শার্ট তো কখনও ফরাসি প্লেয়ার তাতিয়ানা গলোভিনের সাদা স্কার্টের তলায় পরা টকটকে লাল শর্টস। মারিয়া শারাপোভা ২০০৮ সালে টাক্সিডো স্টাইলের টপ পরে খেলতে নেমে বেশ চোখে পড়েন। সে বছরই সেরেনা কোর্টে ওয়ার্ম আপ করতে আসেন ট্রেঞ্চ কোট পরে!
তার ঠিক দু’বছর পর সেরেনা আবার স্টাইলগুরুদের নজরে। কারণ? টপ নয়। রুপোলি গ্লিটার লাগানো সাদা নেল পলিশ! ডান হাতের কড়ে আঙুলে আবার রুপোলি গ্লিটারের সঙ্গে লাল লাল ছিট ছিট ডিজাইনও করিয়েছিলেন তিনি। ‘তিনকাহন’য়ের পরিচালক বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায় সে বছর গিয়েছিলেন উইম্বলডন দেখতে। “আমি সেন্টার-কোর্টে ভেনাস উইলিয়ামসের খেলা দেখেছি। উনি পরে এসেছিলেন পপস্টার টিনা টার্নারের মতো একটা কুঁচি দেওয়া স্কার্ট। অনেককে দেখেছিলাম ভেনাসের এই ফ্যাশন স্টেটমেন্ট নিয়েই আলোচনা করতে। সেই একই বছর সেরেনা পরে আসেন লাল রঙের একটা শর্টস আর ম্যাচিং শু-লেস। অনুপ্রেরণা ছিল দু’বছর আগের তাতিনিয়ার সেই লাল শর্টস।”
তার পরের বছর আরেক পপস্টারের ফ্যাশন সেন্স হয়ে ওঠে বেথানি ম্যাটেক স্যান্ডের অনুপ্রেরণা। কোর্টে ঢোকার আগে ম্যাটেক পরে আসেন একটা লেডি গাগা স্টাইলের জ্যাকেট। যার ওপর লাগানো বেশ কয়েকটা সাদা টেনিস বল। খেলার আগে জ্যাকেট খুলে রাখেন তিনি। ততক্ষণে সবার চোখ চলে যায় তাঁর এক-স্লিভ বিহীন খোলা ড্রেস আর বিভিন্ন রঙের ট্যাটু করা ফোরআর্মের দিকে। তবে সেই একই বছর আরও বড় বিতর্ক সৃষ্টি করে ভেনাসের ‘টোগা পার্টি’ মার্কা পোশাক। ভেনাস নিজে বলেছেন ওটা নাকি ‘জাম্পার’। সামনের দিকে ছিল একটা ট্রেন্ডি জিপ। কিন্তু পিঠের কাছে সেটা ছিল স্টাইলিশলি কাটা। যাকে বলে লোভ দেখানো ‘পিক-আ-বু’ পোশাক। গত বছর নজর কাড়েন ইতালির ক্যামেলিয়া জিওর্জি। পরেছিলেন তাঁর মায়ের ডিজাইন করা তিন ধাপের টিউনিক!
এ বছর উইম্বলডন শুরু হতে না হতেই সাদা পোশাকের প্রতি আকর্ষণ মাঠের বাইরেও বেশ দেখা যাচ্ছে বিশ্ব জুড়ে। তা সে হলিউডের তারকা কেটি হোমস, সিয়েনা মিলার হন, বা ক্যামেরন ডিয়াজ কী এমা ওয়াটসন। পপস্টার রিহানা এই সে দিন পরেছিলেন একটা সাদা ব্লেজার। সঙ্গে সাদা পাম্প জুতো আর ম্যাচিং টেনিস স্কার্ট। হাঁটু থেকে সেটা প্রায় ছ’ ইঞ্চি উচু! |
|
|
|
গ্যাব্রিয়েলা সাবাতিনি |
ক্রিস এভার্ট |
ভিক্টোরিয়া অ্যাজারেঙ্কা |
|
নাইকি আর অ্যাডিডাসের মতো বড় কোম্পানিরা প্রত্যেক বছর উইম্বলডনের সব-সাদা নিয়ম মেনেই টেনিস তারকাদের পোশাক তৈরি করেন। এ বছর মারিয়া পছন্দ করে নিয়েছেন নাইকি উইমেন’স লন্ডন প্রিমিয়ার মারিয়া ফ্লোয়েন্স পোশাক। পোশাকে কোনও বাহুল্য নেই। একটা বেশ ফেমিনিন স্কার্ট, বোনা স্ট্র্যাপ দেওয়া টপ। আর তার সঙ্গে বিল্ট-ইন অন্তর্বাস। ফেব্রিকটা এমন যা কিনা ঘাম সহজেই শুষে নিতে পারে। সেরেনা পছন্দ করেছেন নাইকি উইমেন’স লন্ডন সেরেনা উইম্বি পোশাক। তাতে থাকছে একটা ভি-গলা ট্যাঙ্ক স্ট্র্যাপ, বিল্ট-ইন অন্তর্বাস আর পাওয়ার মেশ স্ট্র্যাপ। বাঁ-দিকের বুকের ওপর একটা ‘হিট-ট্র্যান্সফার শুশ’।
আশির দশকে স্টেফি গ্রাফ যখন উইম্বলডনে কোর্টে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন, তখন তাঁর র্যাপ-অ্যারাউন্ড শর্ট স্কার্ট আর কলার দেওয়া টি-শার্ট পরার আন্দাজটাও ছিল দারুণ স্মার্ট। কেউ কেউ মনে করেন, স্টেফির এই ক্লাসিক টু-পিস স্টাইলটা নাকি আবার ফেরত আসতে পারে এই মরসুমে। আর আছেন গ্যাব্রিয়েলা সাবাতিনি। মাঠের ভিতরে আর বাইরে বরাবরই তিনি স্টাইল আইকন। সতেরো রকমের পারফিউম রয়েছে তাঁর নামে। বৌদ্ধায়ন মনে করেন টেনিস কোর্টে যৌনতার উদ্রেক হয় সাবাতিনির হাত ধরে। বলছেন, “কে ভুলতে পারে ওঁর ভেজা টি-শার্ট পরা ছবি? কিন্তু স্টেফি একদম আলাদা। একটু ঢিলেঢালা পোশাক পরতেন উনি। কোর্টে আরামদায়ক পোশাক পরেও কী ভাবে স্টাইল আইকন হওয়া যায় সেটা স্টেফি শিখিয়ে গিয়েছেন। এঁদের আগে ছিলেন ক্রিস এভার্ট। কী অপরূপ সুন্দরী!” |
|
|
|
ভেনাস উইলিয়ামস |
ক্যামেলিয়া জিওর্জি |
সেরেনা উইলিয়ামস |
|
শুধু সেলিব্রিটি নয়, টেনিস কোর্টের ফ্যাশন অনেক ক্ষেত্রেই ক্যাজুয়াল ওয়্যারের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে। স্পোর্টসওয়্যারের দোকানে দেখা গিয়েছে সেরেনা উইলিয়ামসের কালেকশন, নাইকির মেয়েদের জন্য তৈরি মারিয়া স্লাম স্টেটমেন্ট পোশাক আর র্যাপ-নিট টেনিস জামা। অ্যাডিডাসের তৈরি লন অ্যাডিজিরো পোশাক (যেটা আগের বার উইম্বলডনে পরেছিলেন অ্যানা ইভানোভিচ) সেটাও জনপ্রিয় হয়েছে। তবে দেশের ডিজাইনাররা বলছেন পোশাক নিয়ে দুঃসাহসিক পরীক্ষা করাটা কখনওই ট্রেন্ড হবে না। ডিজাইনার অনিকেত সাতান কিছু মাস আগে লঞ্চ করেছেন স্পোর্টসওয়্যার কালেকশন। বলছেন, “আমি মারিয়া শারাপোভার ফ্যাশন সেন্সে অনুপ্রাণিত। ওঁর পোশাকের কাটের মধ্যে ঔদ্ধত্য নেই। আছে একটা ফেমিনিন টাচ। আর পুরোদস্তুর খেলোয়াড়ের অ্যাটিটিউড।”
এখানকার আবহাওয়ার কথা মাথায় রাখলে সব-সাদা স্পোর্টসওয়্যার ডিজাইন করা হয়তো ঝামেলার। আমাদের সেলিব্রিটিরাও যে পার্টি-প্রিমিয়ারে রিহানা-ক্যামেরনের মতো শ্বেত-বসনা হয়ে যাবেন, তাও জোর গলায় দাবি করা যায় না। তবে এটুকু বলা যেতে পারে যে অনেক স্টাইলিশ মেয়েই এই মরসুমে হয়ে উঠতে পারেন টেনিস-অনুপ্রাণিত। সাদা ক্যাট স্যুট বা জাম্পার না-ই বা থাকল ওয়ার্ডরোবে। কিন্তু তাই বলে স্টেফি-সাবাতিনি-সেরেনা-শারাপোভা-ভিক্টোরিয়ার ফ্যাশন সেন্সের নির্যাসটা ব্যবহার করতে বাধা কোথায়? |
সময়ের তালে |
খেলার নিয়মে পরতে হবে সাদা পোশাক। তাতে কী! প্রথম উইম্বলডন থেকে আজকে, ফ্যাশন থেমে থাকেনি।
১৮৮৪-এর গোড়ালি ঢাকা পোশাক থেকে ১৯৪৯-এর ছোট ঝুলের স্কার্ট, কেমন সেই ফ্যাশন-সফর? |
|
১৮৮৪-র প্রথম মহিলা উইম্বলডন চ্যাম্পিয়নশিপ
ফাইনালে মড ওয়াটসন (বাঁ দিকে) হারান তাঁর
বোন লিলিয়ানকে (ডান দিকে)। সাদা রঙের
পোশাক পরারকারণ ছিল যাতে খেলার
সময় বেশি ঘাম না হয় |
|
|
|
|
১৮৯০-এর উইম্বলডনের মহিলা বিভাগে জয়ী হন পনেরো
বছরের ব্রিটিশ টেনিস তারকা লটি ডড। তিনি ‘কাফ লেন্থ
স্কার্ট’ পরে খেলেছিলেন, কারণ উইম্বলডনে স্কুলপড়ুয়া
মেয়েদের এই দৈর্ঘ্যের স্কার্ট পরায় কোনও আপত্তি ছিল না |
|
|
আমেরিকান টেনিস তারকা অ্যালিস মার্বেল উইম্বলডনে
আমদানি করেন ফ্লানেল শর্টস আর ক্রু নেক টি-শার্ট।
কার্যত তাঁর হাত ধরেই ১৯৩৭-এর উইম্বলডন সাক্ষী
থাকল মহিলা টেনিস দুনিয়ায় পুরুষ পোশাকের প্রবেশ |
|
|
|
|
১৯২৬-এর চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণকারী ফরাসি সুজান
লেঙ্গলেন প্রকৃত অর্থেই বিপ্লবী। মহিলা টেনিস প্লেয়ারদের
মধ্যে তিনিই প্রথম কাফ লেন্থ স্কার্ট পরা শুরু করেন।
করসেটের বদলে পরেন ছোট হাতার পোশাক |
|
|
আমেরিকার টেনিস প্লেয়ার গারট্রুড মোরান বা ‘গর্জাস গেসি’র
পোশাক ছিল টেনিস ফ্যাশন গুরু টেড টিংলিং-এর তৈরি।
১৯৪৯-এর চ্যাম্পিয়নশিপে তাঁর সাদা সাটিনের পোশাকের
নীচে মাঝেমাঝেই দেখা যেত লেসের নিকার্স |
|
|
তথ্য: ইন্টারনেট |
|