আবার রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ-আন্দোলনে সামিল হলেন কামদুনির বাসিন্দারা। এ বার তাঁদের মিছিল এলাকার প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষককে ‘শো-কজ’ করার বিরুদ্ধে।
কলেজছাত্রীকে ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে এলাকার আবালবৃদ্ধবনিতা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখান। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিবাদী মহিলাদের কয়েক জনকে ‘মাওবাদী-সিপিএম’ তকমা দেওয়ায় ফের প্রতিবাদে সরব হয় কামদুনি।
এলাকার প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রদীপ মুখোপাধ্যায়। সেই জন্য জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ তাঁকে ‘শো-কজ’ করে। ওই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে সোমবার বেলা ৩টেয় পথে নামেন এলাকার বাসিন্দারা। মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন টুম্পা-মৌসুমী কয়ালের মতো মহিলারা। তাঁদের এ দিনের বিক্ষোভে সহমর্মিতা জানাতে কামদুনিতে এসেছিলেন রাজ্যের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য, কলেজের অধ্যক্ষ এবং শিক্ষকেরাও। বিক্ষোভের পরে ওই প্রধান শিক্ষক বলেন, “এত মানুষ প্রতিবাদে নেমেছেন। এর পরে আমাকে শিক্ষকতার চাকরি থেকে তাড়িয়ে দিলেও নিজের কাজের জন্য আমার কোনও দুঃখ থাকবে না।” |
কামদুনিতে এসে ১৫ দিনে চার্জশিট, ৩০ দিনের মধ্যে দোষীদের শাস্তির কথা বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে এখনও চার্জশিট দিতে পারেনি সিআইডি। ঘটনার ১৭ দিনের মাথায় বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, ওই প্রতিশ্রুতি থেকে নজর সরাতেই এলাকার এক-এক জনকে নতুন নতুন তকমা দেওয়া হচ্ছে। কামদুনির বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রধান শিক্ষককে শো-কজ করাটাও সেই পরিকল্পনার অঙ্গ। রবিবার রাতেই ঠিক হয়, এর মোকাবিলা করা হবে প্রতিবাদ-মিছিল করে। তবে ওই মিছিলে স্কুলের ছেলেমেয়েদের রাখা হবে না। মিছিলে হাঁটবেন স্কুলের প্রাক্তনী, অভিভাবক ও এলাকাবাসীরা। একজোট হয়েই।
কথা ছিল, সকালেই হবে মিছিল। কিন্তু নিহত ছাত্রীর দাদার বিএড পরীক্ষার ব্যবস্থা কামদুনির ওই স্কুলেই করেছিল শিক্ষা দফতর। পরীক্ষা দিতে গিয়ে মিছিলের জন্য তাঁর মানসিক সমস্যা হতে পারে। তাই সকালে ফের ঠিক হয়, মিছিল করা হবে বেলা ২টোয় পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরে। এ দিন বিএডের ‘জীবনশৈলী শিক্ষা’ বিষয়ক পরীক্ষা ছিল ধর্ষিতার দাদার। তাঁর নিরাপত্তার জন্য এলাকার প্রাথমিক স্কুলে পরীক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়। স্কুল ঘিরে রাখে প্রচুর পুলিশ। এক দিকে চলে স্কুলের ক্লাস, অন্য দিকের একটি ঘরে পরীক্ষা দেন ছাত্রটি। দু’দিকই সামলাতে থাকেন প্রধান শিক্ষক প্রদীপ মুখোপাধ্যায়।
পরীক্ষা শেষ হতেই নিহতের দাদাকে ঘিরে ধরে গ্রাম। পরীক্ষা কেমন হল? ছেলেটি জানায়, ‘‘ভাল।’’ তার পরেই শুরু হয়ে যায় মিছিলের প্রস্তুতি। মহিলারা আলতা দিয়ে পোস্টার লিখে আনেন। পোস্টার বলছিল, ‘শো-কজ প্রত্যাহার না-করলে আমরা আরও বড় আন্দোলনে নামব’। বেলা ৩টে নাগাদ রাস্তায় নামে মিছিল। স্কুল, এলাকা প্রদক্ষিণ করে। স্লোগান ওঠে, ‘আমাদের আরও কী বলবে?’ ‘আমাদের কত শাস্তি দেবে?’ ‘দোষীরা শাস্তি পাচ্ছে না কেন?’...
স্কুলের দুই সহশিক্ষক অলোকরঞ্জন ঘোষ ও মধুসূদন মণ্ডলকে অবশ্য ‘নিয়ম’ মোতাবেক ‘শো-কজ’ করা হয়নি। তাঁরা বলেন, ‘‘মিছিলে আমরাও ছিলাম। আমাদের স্কুলের মেয়েটির এমন নির্মম পরিণতির জন্য প্রতিবাদ তো করতেই হবে।’’ প্রদীপবাবু বলেন, ‘‘গ্রামের মেয়েরা অনেকে স্কুলে আসতে চায় না। মাঝপথে পড়া ছেড়ে দেয়। সেখানে ওই ছাত্রীটি ছিল আমাদের স্কুলের গর্ব। স্কুলের মেয়েদের বলতাম, ওকে দেখে শেখো। ওর বাবা দিনমজুর। কত কষ্ট করে হাইস্কুল পাশ করে কলেজে পড়ছে। তার এই পরিণতি আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। আবারও প্রতিবাদ করব।’’
এ দিন নিহত ছাত্রীর বাড়িতে যান পার্ক স্ট্রিটের ঘটনায় নির্যাতিতা মহিলাও। তাঁকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন ধর্ষিত ছাত্রীর মা। মহিলা তাঁকে সান্ত্বনা দেন। বলেন, “আইনে ভরসা রাখুন। দোষীরা উপযুক্ত শাস্তি পাবেই।” তার পরেই ওই ছাত্রীর বাড়ি এবং কামদুনি স্কুলে যান রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য, প্রাক্তন অধ্যক্ষ, কলেজের শিক্ষকেরাও। ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অশোকনাথ বসু, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়, স্বপন প্রামাণিক, বেসু-র প্রাক্তন উপাচার্য নিখিলরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, অমলজ্যোতি সেনগুপ্ত এবং এসএসসি-র প্রাক্তন চেয়ারম্যান রণজিৎ বসুর মতো অনেকেই। তাঁরা জানান, প্রধান শিক্ষককে যে-ভাবে শো-কজ করা হয়েছে, তা বেআইনি। সকলেই এর প্রতিবাদ জানাবেন।
এলাকার বাসিন্দারা বলেন, ‘‘নাগরিক সমাজের ডাকে আমরা কলকাতার রাজপথে হেঁটেছি। মাওবাদী তকমা ও মাস্টারমশাইয়ের শো-কজ না-তুললে আমরা আরও বড় আন্দোলনে নামব। তখন নাগরিক সমাজকেও ডাকব কামদুনিতে।” |