ব্যারাকপুরের মণিরামপুরের পরে এ বার দক্ষিণ দমদমের সাতগাছির বাপুজি কলোনি। ফের দু’টি গোষ্ঠীর সংঘর্ষে বিপর্যস্ত হল জনজীবন। এ ক্ষেত্রেও অভিযোগ, দু’টি গোষ্ঠীই তৃণমূলের।
পুলিশ জানায়, রবিবার রাতে প্রয়াত এক তৃণমূল নেতার নামে গালিগালাজ এবং তার প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের সংঘর্ষে রবিবার রাতে উত্তাল হয় সাতগাছির বাপুজি কলোনি। অভিযোগ, এলাকার যুবকদের মারধরের পাশাপাশি একাধিক বোমা ও গুলি ছুড়ে এলাকায় তাণ্ডব চালিয়েছে একদল দুষ্কৃতী। ছাড় পাননি এলাকার তৃণমূল নেত্রী, দক্ষিণ দমদম তৃণমূল মহিলা সমিতির সভানেত্রী কেয়া দাসও। তাঁর দুটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে, বাড়িতেও বোমা ফাটানোর অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। অভিযোগের তির তৃণমূলের দিকেই। এফআইআর-এ কেয়াদেবী স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর এবং এক তৃণমূল নেতার নামও বলেছেন।
পুলিশ জানায়, এই ঘটনায় একাধিক তৃণমূল কর্মী-সমর্থক আহত হয়েছেন। তার মধ্যে সঞ্জয় চন্দ নামে এক ব্যক্তির অবস্থা আশঙ্কাজনক। এই ঘটনায় অস্ত্রশস্ত্র-সহ জমায়েত, গোলমাল, হুমকি, মারধর ও খুনের চেষ্টার অভিযোগে ৩ জন দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার করেছে ব্যারাকপুর কমিশনারেটের পুলিশ। ধৃতদের নাম মাছ ভোলা, ঝানু ও অনিমেষ চক্রবর্তী। |
গোলমালের জেরে ভাঙচুর হওয়া গাড়ি। সোমবার। —নিজস্ব চিত্র |
পুলিশ জানায়, গত ডিসেম্বর মাসে উত্তর ২৪ পরগনা যুব তৃণমূলের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক দেবাশিস দাস ওরফে দেবার মৃত্যু হয়। সেই মৃত্যু ঘিরে উত্তাল হয়েছিল দমদম এলাকা। কেয়াদেবী ওই প্রয়াত তৃণমূল নেতার স্ত্রী। তিনি জানান, রবিবার রাতে এলাকার পরিচিত দুষ্কৃতীদের একটি দল তাঁর স্বামীর নামে গালিগালাজ করছিল। স্থানীয় তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা প্রতিবাদ করলে বচসা বাধে। দুষ্কৃতীরা পাড়া জুড়ে তাণ্ডব শুরু করে। সে সময়ে কেয়াদেবী বাড়িতেই ছিলেন। গোলমাল শুনে তিনি বাইরে বেরোতেই তাঁকে লক্ষ করে দুষ্কৃতীরা বোমা ও গুলি ছোড়ে বলে অভিযোগ। কোনও মতে তিনি বাড়িতে ঢুকে যান। দুষ্কৃতীরা তাঁর বাড়ির বারান্দায় পরপর কয়েকটি বোমা ফাটায় ও তাঁর দু’টি গাড়ি ভাঙচুর করে বলে অভিযোগ।
এ দিকে, কেয়াদেবীকে বাঁচাতে তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের একাংশ গেলে দুষ্কৃতীরা তাঁদেরও মারধর করে বলে অভিযোগ। এদের মধ্যে গুরুতর জখম সঞ্জয়কে ই এম বাইপাসের কাছে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ওই রাতেই দমদম থানায় অভিযোগ দায়ের করেন কেয়াদেবী। ব্যারাকপুর কমিশনারেটের এডিসিপি (বেলঘরিয়া) বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, “অভিযোগ পেয়ে ঘটনায় জড়িত তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের খোঁজে তল্লাশি শুরু হয়েছে।”
কেয়াদেবী সহ স্থানীয় তৃণমূল কর্মীদের অভিযোগ, মাছ ভোলা, ঝানু সহ একাধিক পরিচিত দুষ্কৃতীরা এই ঘটনা ঘটিয়েছে। কিন্তু এফআইআরে কেয়াদেবী স্থানীয় ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কমল মণ্ডল, তৃণমূল নেতা বাপি মিত্রের নামও উল্লেখ করেছেন। কমল মণ্ডলের বাড়িতে গিয়ে এ দিন তাঁর দেখা মেলেনি। তাঁর স্ত্রী কণিকা মণ্ডল বলেন, “আমার স্বামী বাড়িতে নেই। এই ধরনের কিছু ঘটে থাকলে তা দুর্ভাগ্যজনক।”
কেন তৃণমূলেরই দু’টি দলের মধ্যে প্রকাশ্যে এই ধরনের ঘটনা ঘটল? স্থানীয় তৃণমূল কর্মীদের একাংশের অভিযোগ, সাতগাছির বাপুজি কলোনি-সহ দক্ষিণ দমদম পুর-এলাকায় আধিপত্য ছিল প্রয়াত তৃণমূল যুব নেতা দেবাশিস ওরফে দেবার। তাঁর মৃত্যুর পরে এলাকার দখল নেওয়ার জন্যই চেষ্টা চালাচ্ছিল একদল দুষ্কৃতী। দলেরই অপর এক পক্ষের মদতেই এমন ঘটনা ঘটল বলে অভিযোগ করেছেন তাঁরা।
সোমবারও আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট ছিল এলাকায়। পুলিশ পিকেট বসেছে। এলাকা থমথমে। সকালে শ’চারেক তৃণমূল কর্মী-সমর্থক ভিড় করেন কেয়াদেবীর বাড়ির সামনে। সেখানে হাজির ছিলেন নৈহাটির বিধায়ক তৃণমূলের পার্থ ভৌমিক। তিনি বলেন, “দমদমে একটা কাজে এসেছিলাম। ঘটনার কথা শুনেই চলে এসেছি।” তাঁর দাবি, “দেবা এলাকায় জনপ্রিয় ছিল। এলাকার দখল নিতে একদল দুষ্কৃতী এই ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে। দেবার স্ত্রী কেয়া যাতে রাজনৈতিক কাজকর্ম করতে না পারেন, সেটাই এদের লক্ষ। সেটা আমরা হতে দেব না। এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা হবে।”
স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর-সহ একাধিক নেতার নামে অভিযোগ দায়ের হয়েছে এই ঘটনায়। তৃণমূলের এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে বিধায়ক তথা শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু বক্তব্য, “ঘটনার সময় আমি এলাকায় ছিলাম না। সবিস্তার জানি না। এটি একটি অবাঞ্ছিত ঘটনা। যাদের নাম এফআইআরে আছে, তাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।”
চলতি মাসেই সংঘর্ষের ঘটনায় দু’জন সাংবাদিক আহত হয়েছিলেন। ওই ঘটনায় ধৃত তৃণমূল নেতা শিবুলাল যাদব পুলিশি হেফাজতে রয়েছেন। তার ১৬ দিনের মাথায় ফের ব্যারাকপুর কমিশনারেটে এমন ঘটল। ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসীরা। প্রশ্ন করেছেন, তাঁদের নিরাপত্তা কোথায়? পুলিশ কোথায় থাকে? গোষ্ঠী সংঘর্ষে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে বলে অভিযোগ তাঁদের। জবাবে ব্যারাকপুর কমিশনারেটের এক পুলিশ কর্তা বলেন, “শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।” |