শান্তিপুর কলেজের পুস্তিকায় সংগঠনের ব্যানার ও নেতাদের কেতাদুরস্ত ছবি থাকায় বিতর্কে জড়িয়েছিল শাসক দলের ছাত্র সংগঠন। সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই এ বার ওই কলেজে ভর্তির ভুয়ো ফর্ম তৈরি করে বিলির অভিযোগ উঠল তৃণমূল ছাত্র পরিষদের বিরুদ্ধে।
কলেজের ছাত্র সংসদের ‘দাদা’দের কাছ থেকে তোলা সেই ফর্ম অবশ্য বাতিল করে দিয়েছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। এ ব্যাপারে বৃহস্পতিবার কলেজে নোটিশও টাঙিয়ে দিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ৫০০০ উপরে নম্বর রয়েছে এমন কোনও ফর্ম কলেজ কর্তৃপক্ষ গ্রাহ্য করবে না। এই ফর্মগুলি ভুয়ো বলেই মনে করছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।
ভুয়ো ফর্ম বাজারে ছড়িয়ে পড়ায় আপাতত ভর্তি প্রক্রিয়াই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে কলেজে। সেই সঙ্গে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ওই কলেজে ভর্তি হতে গেলে এখন থেকে কলেজেই ৪০ টাকা দিয়ে ‘ডাউনলোড’ করিয়ে ফর্ম জমা দিতে হবে।কলেজের এক শিক্ষক জানান, ভুয়ো ফর্ম রুখতে এ ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না।
চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই শান্তিপুর কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তির জন্য শুরু হয়েছে ফর্ম দেওয়া। এ জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ পাঁচ হাজার ফর্ম ছাপিয়েছিলেন। কিন্তু ফর্ম জমা নেওয়ার সময় কর্তৃপক্ষের নজরে আসে, অনেক ফর্মের সিরিয়াল নম্বর পাঁচ হাজারের উপরে। প্রথম দিকে ভুলবশত সেই সব ফর্মও কয়েকটি জমা নিয়ে নিয়েছিল কলেজ। কিন্তু পরে ভুল বুঝতে পেরে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। |
শান্তিপুরের যে ছাপাখানা থেকে ফর্ম ছাপানো হয়েছিল, শাসকদলের সমর্থকেরা প্রথমে সেখানেই চড়াও হয়ে ফর্ম দাবি করেছিল বলে দাবি করেছে বিরোধী এসএফআই। ছাপাখানা সূত্রে সে কথা মেনে নেওয়া হয়েছে। তবে তাঁরা জানান, “যারা ফর্ম চাইতে এসেছিল তাদের রাজনৈতিক পরিচয় অবশ্য আমরা জানি না।”
ওই ছাপখানার মালিক শিশির পাল বলেন, “চার যুবক আমার কাছে দু’হাজার ফর্ম নিতে এসেছিল। না পেয়ে চলেও যায়। তবে তারা কোন দলের বলতে পারব না।”
এ ব্যাপারে কলেজে খোঁজ নিতে গেলে এ দিন সাংবাদিকদের উপরে চড়াও হন স্থানীয় তৃণমূলের কর্মীরা। হাতে পাকানো ফর্মের দিস্তা নিয়েই তাদের কলেজ চত্বরের আশপাশে ঘোরাঘুরিও করতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু সে ব্যাপারে প্রশ্ন করতেই সাংবাদিকদের একরকম গলা ধাক্কা দিয়েই বের করে দেন ওই তৃণমূল সমর্থকেরা।
শান্তিপুরেরই এক ছাত্রী দিন কয়েক আগে ওই কলেজে ফর্ম তুলতে এসেছিলেন। দীর্ঘ লাইন, তার উপর মুষলধারে বৃষ্টি। তিনি জানান, হঠাৎ পরিত্রাতার ভূমিকায় উদয় হন এক ‘দাদা’। লাইনে দাঁড়ানোর ঝক্কি না নিয়ে সটান তাঁর কাছ থেকেই ফর্ম কিনে নেন ওই ছাত্রী। কিন্তু ফর্ম জমা দেওয়ার সময় ফ্যাসাদে পড়েন তিনি। কলেজ কর্তৃপক্ষ সটান জানিয়ে দেন, ফর্মের সিরিয়াল নম্বর পাঁচ হাজারের ঊর্দ্ধে। এ ফর্ম কর্তৃপক্ষ ছাপেনি।
শুধু শান্তিপুরের ওই ছাত্রীই নন। কলেজ সূত্রের খবর, প্রায় শ’পাঁচেক ফর্ম বাতিল হয়েছে। শান্তিপুর কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ চয়ন ভট্টাচার্য বলেন, “আমরা পাঁচ হাজার ফর্ম ছাপিয়েছিলাম। কিন্তু অনেক পড়ুয়া পাঁচ হাজারের বেশি সিরিয়াল নম্বরের ফর্ম জমা দিতে এসেছিলেন। তাঁদের পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে, ওই ফর্ম ভুয়ো।”
অধ্যক্ষ জানান, কলেজের নিজস্ব ওয়েবসাইট থেকে ‘ডাউনলোড’ করতে হবে ফর্ম। আর এখানেই হদ্দ গ্রামের ইন্টারনেটের ব্যবহার না জানা পড়ুয়াদের দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছেন ‘স্বেচ্ছাসেবক’ দাদারা। তারা ছাত্র-ছাত্রীদের মগজ ধোলাই করে দিব্যি গছিয়ে দিচ্ছে ‘জাল’ ফর্ম। বৃহস্পতিবার দুপুর নাগাদ কলেজে গিয়ে নজরে পড়ল দুই আঙুলের ফাঁকে নায়কোচিত ভঙ্গিতে সিগারেট হাতে বছর তিরিশের এক যুবককে। আশপাশে ঘুরতে থাকা ফর্ম প্রত্যাশী পড়ুয়াদের কাছে গিয়ে নিজেকে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতা বলে পরিচয় দিচ্ছেন তিনি।
তিনি এই প্রতিবেদককেও প্রথমে বলেন, “ফর্ম লাগবে? কিছু বেশি লাগবে। এখানে পাওয়া যাচ্ছে। পূরণ করে দেওয়াও আমাদের দায়িত্ব। তবে একটাই শর্ত: ভোটটা কিন্তু দিতে হবে আমাদের।” সরল বিশ্বাসে পড়ুয়ারা সেই ফর্ম কিনছেনও। তারপরেই শুরু হচ্ছে হয়রানি। প্রতারিত ছাত্র-ছাত্রীরা অনেকেই জানিয়েছেন, “ভর্তির আগেই দাদাদের কাছ থেকে এ ভাবে ঠকতে হবে স্বপ্নেও ভাবিনি।”
এসএফআই-এর বক্তব্য, ওই কলেজের ছাত্র সংসদে ক্ষমতাসীন তৃণমূল ছাত্র পরিষদই এই ভুয়ো ফর্ম তৈরির সঙ্গে যুক্ত। সংগঠনের জেলা সভাপতি কৌশিক দত্ত বলেন, “শাসক দলের ছাত্র সংগঠনই এই জাল ফর্ম বিলির হোতা। এই ভাবে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে।” স্থানীয় বিধায়ক তথা ওই কলেজের গর্ভনিং বডির প্রাক্তন সভাপতি অজয় দে বলেন, “ওই কলেজে শাসক দল দলতন্ত্র কায়েম করতে মরিয়া। আমি পদত্যাগ করার পর থেকেই তৃণমূল ছাত্র পরিষদ অসদুপায়ে অর্থের বিনিময়ে ছাত্র ভর্তি করার তোড়জোড় শুরু করেছে।”
ওই কলেজের ছাত্র সংগঠনের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক তুষার প্রামাণিক বলেন, “পাড়ার অলিতে গলিতেও মিলছে এই জাল ফর্ম। এর সঙ্গে নিশ্চিতভাবেই তৃণমূল ছাত্র পরিষদ জড়িয়ে রয়েছে। ওদের সন্ত্রাসের ভয়ে বিরোধীরা কলেজ চত্বরে পা দিতেই পারছে না।” ঘটনার কথা স্বীকার করেছেন কলেজের কলেজের গর্ভনিং বডির সভাপতি তথা রানাঘাট উত্তর-পশ্চিম কেন্দ্রের বিধায়ক তৃণমূলের পার্থসারথী বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “এই ঘটনায় যুক্তদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে।”
তৃণমূল ছাত্র পরিষদের জেলা সভাপতি জয়ন্ত পাল বলেন, “তৃণমূল ছাত্র পরিষদের যদি কেউ যুক্ত থাকে, তাহলে প্রশাসন তাকে শাস্তি দিক। আমরা প্রশাসনের সঙ্গে রয়েছি।’’
|