গত দু’সপ্তাহ ধরে চুপচাপ আছি, বারাসতের কামদুনিতে কুড়ি বছরের ছাত্রীটির নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা বিষয়ে কিছুই বলিনি। তবে এই প্রচার-তাড়িত চিৎকৃত যুগে নীরবতাকে যে অবধারিত ভাবে দুর্বলতা ও আত্মরক্ষণের নামান্তর বলে ধরে নেওয়া হয়, সেও জানি। দুর্ভাগ্য! আসল কথা, এমন নয় যে আমার কিছু বলার নেই, কিন্তু ইতিমধ্যেই যা যা বলা হয়ে গিয়েছে, তার চেয়ে বোধহয় নতুন কিছু বলার নেই। ব্যক্তিগত ভাবেও ঘটনাটা বড় অশান্ত করে রেখেছে। ১৭ বছরের কন্যার পিতা আমি, যে কন্যা সম্ভবত তার বাকি জীবনটা এই পশ্চিমবঙ্গেই কাটাতে চলেছে: সুতরাং অশান্ত তো লাগবেই।
ধর্ষণ তো কেবল সংখ্যাতত্ত্ব নয়। ধর্ষণের অর্থ, অমানবিক নির্যাতন, জঘন্য অপরাধ, ভয়াবহ হিংসার প্রকাশ, যে হিংসার মধ্যে সামাজিক ক্ষমতাবৈষম্য ও লিঙ্গবৈষম্যের তীব্র প্রতিফলন ঘটে থাকে। প্রতিটি ধর্ষণের ঘটনাই আসলে অসংখ্য অপরাধের সমতুল্য। কোনও ‘যদি’ ‘তবে’-র স্থান নেই এখানে, ধর্ষণকারী কোন দলের লোক কিংবা কোন দলের নয়, এমন কোনও প্রশ্ন তোলার জায়গা নেই। এই মৌলিক সত্য অগ্রাহ্য বা অমান্য করার কোনও অবকাশ নেই। কামদুনির অপরাধের দায়ে আট ব্যক্তি গ্রেফতার হয়েছে। ধর্ষণ ও খুনের দায়ে চার্জশিট ১৫ দিনের মধ্যে দায়ের করা হবে, ফাস্ট-ট্র্যাক কোর্টে বিচার হবে। আশা, অপরাধীরা এক মাসের মধ্যে শাস্তি পাবে। ওই অঞ্চলে চারটি নতুন পুলিশ থানা তৈরি করার কথাও ঘোষণা করেছে সরকার। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সি আই ডি-কে বলা হয়েছে বারাসতের উপর নজর রাখার কথা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন ফাঁসিই অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি। প্রসঙ্গত, কেন্দ্রে সম্প্রতি ধর্ষণবিরোধী আইন তৈরি সত্ত্বেও এখনও তা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি, কিন্তু দলগত ভাবেও তৃণমূল কংগ্রেস ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডই চায়।
ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি, ধর্ষণের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের পক্ষে বিশেষ কিছু শাস্তিদানের ব্যবস্থা সম্ভব, যেমন পাসপোর্ট তৈরি বা সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে যে ধরনের পুলিশি ক্লিয়ারেন্স লাগে, সেটা আটকে দেওয়া সম্ভব। দেখতে-শুনতে ছোট হলেও এ সব শাস্তির কিন্তু একটা বড় প্রতীকী গুরুত্ব আছে। এ ভাবে বুঝিয়ে দেওয়া যায় যে সরকার এই ধরনের অপরাধকে ‘জিরো-টলারেন্স’ দৃষ্টিভঙ্গিতে গুরুত্বসহকারে বিচার করে।
তবে কি না, বৃহত্তর সমাজকেও একটা বড় দায়িত্ব পালন করতে হবে। শাস্তি বাড়িয়ে অপরাধের পথে একটা বাধা তৈরি করা যায় নিশ্চয়ই, কিন্তু সামাজিক সংবেদনশীলতা বাড়ানোর কাজটাও তার চেয়ে কম জরুরি নয়। প্রতিটি সংসার থেকে এই সংবেদনশীলতা তৈরির কাজ শুরু করতে হবে, আমাদের ঘরের ছেলেদের বলতে হবে যে আমাদের মেয়েরাও তাদের সমান, তাদের থেকে এক চুলও কম নয়। এই নাগরিক সংবেদনশীলতা ছড়িয়ে পড়া দরকার প্রতি দিনের বাস, ট্রাম, মেট্রো পর্যন্ত, যাতে অল্পবয়সী সাধারণ মেয়েরা পড়াশোনার কারণে, বা চাকরির কারণে, বা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য নিশ্চিন্তে নিরাপদে চলাচল করতে পারে।
কিছু দিন আগে দেখলাম, কলকাতার মেট্রোয় একটি মেয়েকে বিরক্ত করছে এক ব্যক্তি। মেয়েটি হইচই বাধিয়ে দিল, সহযাত্রীদের সাহায্যে তাকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিল। দেখে ভরসা হল। আমাদের মেয়েরা বোনেরা বিপন্ন হতে থাকবে, আর আমরা নিশ্চেষ্ট দর্শক হয়ে থাকব, এমন যেন কিছুতেই না হয় সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে, সরকারকেও, সমাজকেও।
এই সূত্রে প্রচারমাধ্যমকে একটা কথা বলার আছে। এই অপরাধ-ঘটনাগুলির রিপোর্টিং কী ভাবে হওয়া উচিত, সেটা কিন্তু আর একটু ভেবে দেখা দরকার। প্রশাসনের তরফে গাফিলতি থাকলে সেটা ধরিয়ে দিতে হবে, সমালোচনা করতে হবে, কোন পথে সমাধান সম্ভব, তার আলোচনা করতে হবে। কিন্তু এই কাজগুলো করার সময় নিজেদের প্রবৃত্তিগুলিকেও একটু সংযত করতে হবে, হিস্টিরিয়া লাগিয়ে ঝগড়া বাধিয়ে জনপ্রিয়তার যুদ্ধে মেতে ওঠা থেকে যত দূর সম্ভব বিরত হতে হবে। কোনটা ঠিক? রেটিং-দৌড়ের প্রতিযোগিতায় নেমে সমস্যাটা আরও খানিক বাড়িয়ে তোলা? না কি সত্যিই সমাধানের পথে এগোনো?
রাজ্যে অনেক সমস্যা রয়েছে যেগুলি সত্যিই উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। কলকাতার প্রত্যন্তের এই সব অনিরাপদ অঞ্চলগুলির সমস্যাও তার মধ্যে অন্যতম। সুতরাং এই লেখা যখন লিখছি, আমার পক্ষে খুবই সহজ কাজ হতে পারত পূর্বতন সরকারের উপর, গত পঁয়ত্রিশ বছরের দুঃস্বপ্নের নৈরাজ্যের উপর সব দোষ চাপিয়ে দেওয়া। কিন্তু আমি তা করতে চাই না। আমি কেবল একটি ঘটনার কথা, এবং এক জন পৃথক ঘরানার মুখ্যমন্ত্রীর কথা উল্লেখ করব। ১৯৯০ সালের ৩০ মে গোসাবা রাঙাবেলিয়া থেকে কলকাতা আসছিল একটি সরকারি গাড়ি, তাতে ছিলেন তিন ভদ্রমহিলা: নয়া দিল্লির ইউনিসেফ-এর অফিসার রেণু ঘোষ, আর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের পরিবার কল্যাণ দফতরের কর্মী অনিতা দেওয়ান ও উমা ঘোষ। বানতলা রোডের সি পি আই (এম) অফিস পার হওয়ার সময়, চার-পাঁচ জন যুবক গাড়িটিকে থামায়, গাড়ি থেকে তাঁদের হিঁচড়ে বার করে আনে। পাঁচ ঘণ্টা পর, মৃতদেহগুলি হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। অবর্ণনীয় যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তাঁরা নিহত হওয়ার আগে। ঠিক কলকাতার উপকণ্ঠে। অথচ ত্রাস সে দিন এমনই সর্বব্যাপী ছিল যে পরের দিন কোনও সংবাদপত্রে এই ঘটনার বিবরণ বেরোয়নি, কেউ গ্রেফতার হয়নি। ঘটনাটি বিষয়ে প্রশ্ন করায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নাকি বলেছিলেন: “এ রকম তো কতই হয়। সমাজবিরোধী কাজ, ডাকাতি, মারধর। এতে রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয়েছে বলতে হবে কেন?” সেই সিনিসিজম-এর যুগ ছাড়িয়ে আমাদের রাজ্য আজ অনেকটা পথ হেঁটে এসেছে। কামদুনির মেয়েটি আমাদের মনে করিয়ে দিল, আরও অনেক, অনেক দূর যেতে হবে। আমাদের এগোনোর অনুপ্রেরণা হোক ওর স্মৃতি।
|