দু’বছর আগে-পরের দু’টি ঘটনা। তাঁদের প্রিয় মুখ্যমন্ত্রীকে হাতের কাছে পেয়ে অতি উৎসাহে কোলে তুলে নিতে গিয়েছিলেন এক দঙ্গল মহিলা! বারাসতে। সেটা ছিল ভালবাসার অত্যাচার। দু’বছর পরে সেই বারাসতেরই কামদুনি গ্রামে মহিলাদের প্রশ্নের মুখে মেজাজ হারিয়ে ফিরে আসতে হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীকে!
এই পরিবর্তন একটা বার্তা পরিষ্কার করে দিচ্ছে। দু’বছর আগে দু’হাত তুলে যাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমর্থন করেছিলেন, তাঁরা এখন প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। ধীরে ধীরে পথে নামছেন। কিন্তু মানুষ যা বুঝছেন, যা বোঝাতে চাইছেন, মুখ্যমন্ত্রী বুঝছেন না! তিনি বিরোধী দল এবং সংবাদমাধ্যমের চক্রান্ত খুঁজতে ব্যস্ত! কামদুনিতে দিনে-দুপুরে কলেজ-ফেরতা ছাত্রীকে যে ভাবে ধর্ষণ করে নৃশংস খুন করা হয়েছে, তাতে সমাজের সব অংশে প্রতিক্রিয়া হতে বাধ্য। ঘটনার দশ দিন পরে মুখ্যমন্ত্রী নির্যাতিতার বাড়ি গেলেন বুড়ি ছোঁওয়ার মতো। গ্রামের বাসিন্দা মহিলারা কিছু জানাতে চেয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের ধমক দিয়ে চুপ করাতে চাইলেন। মহিলারা নাছোড় দেখে ফিরেও এলেন। এক বারও খেয়াল করলেন না, ওই মহিলারা তাঁকে ‘দিদি’ বলেই ডাকছিলেন। পরে অম্লানবদনে মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের সিপিএম এবং মাওবাদী বলে দিলেন! ওই গ্রামে কোথায় সিপিএম? ওই মহিলারা মাওবাদী? যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই তাঁরা সব সিপিএমেরই, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তাঁদের বিচার চাওয়ার, প্রশ্ন করার কোনও অধিকার নেই? মুখ্যমন্ত্রী কি শুধু তৃণমূলের?
এ বারের পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন-পর্ব মিটে যেতে ওখানে তৃণমূল বাহিনীর বিজয় উৎসব হয়েছিল, কে না জানে? ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় ধৃত আনসারের সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্কের কথা ওখানে কে না জানে? কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বিরোধীদের চক্রান্ত খুঁজে পেলেন! |
প্রতিবাদী সাহস। (বাঁ দিক থেকে) মৌসুমী ও টুম্পা কয়াল। ছবি: সুদীপ ঘোষ |
মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে শাসক দলের নেতা-নেত্রীরা কামদুনির ঘটনা সামনে রেখে বলতে শুরু করেছেন, এই ধরনের অপরাধের প্রতি সরকার ‘জিরো টলারেন্স’-এর নীতি নিয়েছে। এ দাবি বিশ্বাসযোগ্য? যদি অপরাধীদের প্রতি সহিষ্ণুতা না-ই দেখাবেন, তা হলে তদন্ত করে পার্ক স্ট্রিটে ধর্ষণ প্রমাণ করার পরে দময়ন্তী সেনকে কলকাতার গোয়েন্দা-প্রধান পদ থেকে সরতে হল কেন? কেন মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, পার্ক স্ট্রিটের ব্যাপারটা ‘সাজানো ঘটনা’? কাটোয়া, আহমেদপুরে ধর্ষণের পরে কেন সিপিএমের চক্রান্ত বলেছিলেন? কেন পার্ক স্ট্রিটের নির্যাতিতাকে এখন প্রকাশ্যে এসে যন্ত্রণার কথা, অবিচারের কথা বলতে হচ্ছে? ঠিকই, কামদুনির ঘটনায় বেশ ক’জন গ্রেফতার হয়েছে। কিন্তু যা হয়েছে, চাপের মুখে। বিরোধীদের চাপ, জনমতের চাপ, মিডিয়ার চাপে সরকার কিছু ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছে। চাপের মুখেও ভাল কাজ হলে ভাল। কিন্তু পাশাপাশি কী হচ্ছে? এলাকায় অপরাধের অবসান চাইছেন বলে, বিচার চাইছেন বলে গ্রামবাসীদের চোখ রাঙাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী! সত্যিই ‘জিরো টলারেন্স’! তৃণমূল দলটাই দাঁড়িয়ে আছে ‘বামফ্রন্টের ৩৪ বছর’-এর কাহিনির উপরে। প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, বাম আমলে কি কামদুনির মতো ঘটনা ঘটেনি? ঘটেছে। বানতলা হয়েছে, ফুলবাগান হয়েছে, আরও কিছু ঘটেছে। কিন্তু অন্যায়কে কেউ অন্যায় নয় বলে চালানোর চেষ্টা করেনি। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু তখন বলেছেন, একটা বা দু’টো ঘটনা দিয়ে বলা যায় না যে, রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। তা নিয়ে তখনকার বিরোধীরা হইচই করেছেন। কিন্তু জ্যোতিবাবু কখনও ও রকম কোনও ঘটনার পরে বলেননি, এ সব ‘সাজানো’, বিরোধীদের ‘চক্রান্ত’! বানতলাতেই তো অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পুলিশ চার্জশিট দেওয়ার পরে আদালতে সকলের সাজা হয়েছে।
শুধু ধর্ষণ বা নারী নিগ্রহই কেন, সব রকমের অপরাধ দু’বছরে বেড়েছে। কলেজে ঢুকে অধ্যক্ষকে পেটানো হচ্ছে, সাংবাদিকদের ঘরে আটকে গায়ে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা হয়েছে! কেউ কোথাও বলছে না, এ রাজ্যে সমাজবিরোধীরা সব গত দু’বছরে জন্মেছে! তারা আগেও ছিল। কিন্তু তাদের মাথায় হাত রাখার মতো এমন একটি সরকার তারা আগে পায়নি। অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য হয়েছে এখন! পুলিশের একটা অংশ শাসক দলের তাঁবেদারি করছে, আর একটা অংশ হতাশায় নিষ্ক্রিয়। বারাসতে গিয়ে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীই বলে এসেছেন, বাংলাদেশের দুষ্কৃতীরা অপরাধ করে পালিয়ে যাচ্ছে। তার মানে কি বিদেশি অপরাধীরাও ভরসা পেয়েছে বেশ?
সারদা কেলেঙ্কারিতে এতগুলো মানুষের সারা জীবনের সঞ্চয় ভেসে গেল। শাসক দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের খাতিরেই সারদা গোষ্ঠী দাপিয়ে বেড়িয়েছে। কী তদন্ত হয়েছে? ক’জনের শাস্তির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে? প্রতারকদের সঙ্গে শাসক দলের নেতাদের সম্পর্ক নিরপেক্ষ তদন্ত করে বার করবে এ রাজ্যের পুলিশ, এমনটা কেউ আশা করেন?
এ সব দেখেও বিরোধীরা সরব হবেন না? পথে নামবেন না? পরিবর্তনের রাজ্যে নতুন ধারার চল হয়েছে, প্রতিবাদ করলেই বিরোধীদের নামে মানহানির মামলা করো! পুলিশের নোটিস পাঠাও! রাজনৈতিক বিরোধিতা মোকাবিলার এই পথ উদ্ভাবন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বামফ্রন্টের বিরোধীরা কখনও এই অভিযোগ করতে পেরেছেন বাম জমানায়? জ্যোতিবাবু বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে ভাষণ দিয়েছেন বলে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে, এমন হয়েছে কখনও? দু’বছর আগের পরিবর্তনে যাঁদের ভূমিকা ছিল, পরিবর্তনের চেহারা দেখে তাঁরা একে একে ‘দিদি’র পাশ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। বিদ্বজ্জনদের মধ্যে যাঁরা বিবেক বিসর্জন দেননি, তাঁরা পথে নামছেন। মিডিয়া ভুল ধরিয়ে দিচ্ছে। বদলে জুটছে খুনের চক্রান্তকারীর তকমা! বাম আমলে মূল ধারার একটা সংবাদপত্রও বামফ্রন্টের পক্ষে ছিল না। জ্যোতিবাবু নিয়ম করে জনসভায় বলতেন: এই কয়েকটা কাগজ আমাদের ভাল দেখতে পারে না; ওরা ওদের কাজ করছে, আমাদের কাজ আমাদের করতে হবে। কিন্তু কখনও বলেননি: অমুক কাগজ আমাকে খুন করার চেষ্টা করছে! জ্যোতিবাবুকে খুন করার চেষ্টা সত্যিই হয়েছিল। পটনা রেল স্টেশনে, ১৯৭০ সালে। তিনি তখন মুখ্যমন্ত্রী নন, বামেরাও কোথাও সরকারে নেই। সেই গুলিচালনা কাদের কাজ ছিল, প্রশাসনিক রিপোর্টে সেটা বলা হয়েছিল। তার পরেও জ্যোতিবাবু তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কখনও বলতে যাননি, অমুক দল আমাকে খুন করার চেষ্টা করেছে! মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনভয়ের পথে মাওবাদীরা মাইন ফাটিয়েছিল। বুদ্ধবাবু কি বলে বেড়িয়েছিলেন, তৃণমূল আমাকে খুন করতে চাইছে? কেন বলবেন? কিন্তু এখন এ সবই বলা হচ্ছে। সবাই খুনের চক্রান্ত করতে ব্যস্ত!
দেখেশুনে ছোটবেলায় শোনা সেই গল্পটা মনে পড়ছে। গরু হারিয়ে এক গ্রামবাসী পড়েছিলেন বেজায় চিন্তায়। বিস্তর গরু-খোঁজা খুঁজেও কিছু মেলেনি। বাড়ি ফিরেছেন হা-ক্লান্ত হয়ে। গিন্নিকে দেখে বললেন, মা, এক গেলাস জল দেবে? গিন্নি বললেন, এ কী গো! আমায় মা বলছ যে? কর্তা বলেছিলেন, গরু হারালে ওই রকমই হয়! তুমি কী বুঝবে?
আজকের পশ্চিমবঙ্গে বুঝছেন এক জন! |