কলকাতার আকাশে প্রমোদ-উড়ানের হেলিকপ্টারই যাত্রী বিমানের উড়ানপথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের অফিসারেরা। তাঁদের দাবি: মহানগরে প্রমোদ-উড়ানে অন্যতম দ্রষ্টব্য হিসেবে যেগুলি রাখা হয়েছে, সেই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, ময়দান, রাজভবন বা ইডেন গার্ডেন্সের আকাশে কপ্টার ঘুরে বেড়ানোটা যাত্রী বিমান চলাচলের পক্ষে আদৌ অনুকূল নয়।
যার কারণ হিসেবে ওঁরা জানাচ্ছেন, কলকাতায় যাত্রী বিমান ওঠা-নামার প্রক্রিয়া সুষ্ঠু ভাবে ও নিরাপদে পরিচালিত করতে আকাশের যে বিশেষ এলাকা চিহ্নিত রয়েছে, ভিক্টোরিয়া-ইডেনের আকাশ সেই ‘ফানেল’-এর মধ্যে পড়ছে।
ফানেল মানে কী? কলকাতা এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল (এটিসি)-সূত্রের ব্যাখ্যা: রানওয়েতে বিমান ওঠা-নামার সময় যতটা অঞ্চল একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট থাকা দরকার, আকাশের গায়ে কাল্পনিক সুড়ঙ্গ-পথের মতো সেই এলাকাটিকে বিমান পরিভাষায় ‘ফানেল’ বলে। সেখানে কোনও কিছু থাকলে, স্থির বা চলমান যা-ই হোক না কেন, তা যাত্রী-বিমানের পাইলটের দৃষ্টি-পথে বাধার সৃষ্টি করতে পারে। তাঁর মনঃসংযোগ বিঘ্নিত হতে পারে।
এবং সে ক্ষেত্রে মস্ত বিপদের সম্ভাবনা। এটিসি-অফিসারদের মতে, পাইলটের দৃষ্টি বা মনঃসংযোগ ব্যাহত হলে ফল হতে পারে মারাত্মক। মাত্র এক সেকেন্ডের এ দিক-ও দিক হলেই বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটার শঙ্কা। তাই বিমান ওঠা-নামার সময় ‘ফানেল’ একেবারে পরিষ্কার থাকা আবশ্যিক। যে কারণে তার মধ্যে বড় গাছ থাকলেও সেটি সঙ্গে সঙ্গে কেটে ফেলা দস্তুর।
সুতরাং কপ্টারের আমোদ-বিহার নিয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। এটিসি-সূত্রের বক্তব্য: কলকাতা বিমানবন্দরে নিয়মিত ব্যবহৃত মূল রানওয়েতে সল্টলেকের দিক থেকে বিমান নামার সময়ে যে ‘ফানেল’টি কার্যকর, ময়দান চত্বরের দ্রষ্টব্যগুলির আকাশ তার আওতায়। আবার ওড়ার সময়ে সল্টলেকের দিকের আকাশে ডানা মেলা বিমানের ফানেলেও তা উপস্থিত। তাই বিমানবন্দরের অফিসারদের দাবি, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল-ময়দান-রাজভবন-ইডেন গার্ডেন্সের মাথার উপর দিয়ে হেলিকপ্টার উড়লে তা বিমানবন্দরে ওঠা-নামা করা বিমানের পাইলটের মনঃসংযোগে বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
এ হেন পরিস্থিতিতেই কিন্তু বেহালা ফ্লাইং ক্লাব থেকে হেলিকপ্টারে গগনবিহারের সূচনা হয়ে গিয়েছে বুধবার। সূচি অনুযায়ী রোজ বিকেলে দু’বার কপ্টারটি মহানগরের আকাশে আমোদ-সফরে বেরোবে। যদিও বুধবার বিকেলে খারাপ আবহাওয়ার দরুণ তা এক বার গঙ্গার উপরে চক্কর কেটে ফিরে যায়। বৃহস্পতিবার ওড়েইনি। রাজ্য পর্যটন দফতর জানাচ্ছে, এ বার প্রতি দিন বিকেল চারটে ও পাঁচটায় বেহালা থেকে নিয়মিত তা চালু থাকবে। এক-একটা উড়ান হবে দশ মিনিটের। কিছু সমস্যাও দেখা দিয়েছে। যেমন, কপ্টার-ভ্রমণের টিকিট জোগাড় করতে কিংবা বেহালা ফ্লাইং ক্লাবে পৌঁছাতে হ্যাপা পোয়াতে হচ্ছে বলে অনেকের অভিযোগ।
তার উপরে এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে ফানেলে অনুপ্রবেশের সমস্যা। কলকাতা বিমানবন্দরের জেনারেল ম্যানেজার (এয়ার ট্র্যাফিক ম্যানেজমেন্ট) চন্দন সেন পরিষ্কার বলছেন, “আকাশে যাত্রী বিমান থাকলে আমরা কপ্টারকে ফানেলের ধারে-কাছে আসার অনুমতি দেব না।” চন্দনবাবুর বিকল্প প্রস্তাব, “কখনও-সখনও একটানা মিনিট চার-পাঁচেকের জন্য বিমানবন্দরে যাত্রী বিমানের ওঠা-নামা থাকে না। ওই সময়ে চাইলে ময়দানের উপরে কপ্টার-চক্কর চলতে পারে। তা-ও চালাতে হবে আমাদের বলে দেওয়া উচ্চতায়।” তবে এটিও কতটা কার্যকর হবে, সে বিষয়ে বিমানবন্দরের কর্তাদের একাংশ যথেষ্ট সন্দিহান। “রানওয়ে গড়ে একটানা পাঁচ মিনিটও খালি থাকে না। হয় বিমান উঠছে, নয়তো নামছে। ওইটুকু সময়ের মধ্যে প্রমোদ-উড়ান কী ভাবে সম্ভব?” প্রশ্ন এক অফিসারের।
চন্দনবাবু জানিয়েছেন, প্রমোদ-উড়ানের পরিকল্পনা সম্পর্কে আগাম বিস্তারিত রিপোর্ট পেলে তাঁরা পরামর্শ দিতে পারতেন, শহরের অন্য কোথায় তা সম্ভব। তা যখন হয়নি, তখন আপাতত বেহালা থেকে উড়ে গঙ্গার পশ্চিম পাড় ঘেঁষে কিছুটা গিয়ে আবার বেহালায় ফিরে যাওয়া ছাড়া হেলিকপ্টারের উপায় নেই বলে বিমানবন্দর-সূত্রে জানানো হয়েছে। নগরদর্শনের কপ্টার-পরিষেবা নিয়ে এসেছে যারা, কেন্দ্রীয় সরকারে অধীনস্থ সেই উড়ানসংস্থা পবনহংসের বক্তব্যেও সমস্যা সুরাহার বিশেষ ইঙ্গিত মেলেনি। সংস্থার জেনারেল ম্যানেজার সঞ্জয়কুমার বলেছেন, “আপাতত পশ্চিমবঙ্গে একটা হেলিকপ্টার রাখা আমাদের উদ্দেশ্য। অন্য কোথাও নিয়মিত ভাড়া পেলে প্রমোদ-উড়ান চালানো হবে না।”
রাজ্য সরকারের কী অবস্থান?
রাজ্যের পর্যটন-সচিব বিক্রম সেন এ দিন বলেন, “অনুমতি যা নেওয়ার, পবনহংসকেই নিতে হবে। আমরা বলেছি, ওড়ার জন্য প্রয়োজনীয় সব অনুমতি যেন নেওয়া হয়।” বেহালার পরিবর্তে শহরের কেন্দ্রস্থলের কোথাও থেকে কপ্টার যাতে উড়তে পারে, তারও চিন্তা-ভাবনা চলছে বলে জানিয়েছেন বিক্রমবাবু।
|