টাকা টালমাটাল, প্রায় ষাট ছুঁল ডলারের দাম
লালমোহন গাঙ্গুলি নির্ঘাৎ বলতেন, টাকা টালমাটাল!
বেশ কিছু দিন ধরেই প্রায় প্রতি দিন ডলারের সাপেক্ষে নিয়ম করে পড়ছে টাকার দাম। বৃহস্পতিবার তা নেমে গিয়েছে রেকর্ড তলানিতে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হিসেব অনুযায়ী এ দিন ডলারের দর দাঁড়িয়েছে ৫৯.৭০ টাকা। তার মানে, গত বছরের মার্চ মাসেও যেখানে এক ডলার কিনতে টাকা পঞ্চাশেক লাগছিল, এখন তার জন্য খরচ করতে হবে প্রায় ৬০ টাকা।
রক্তচাপ বাড়িয়ে এক ধাক্কায় ৫২৬ পয়েন্ট খুইয়েছে বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক সেনসেক্সও। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, টাকা নিয়ে আতঙ্ক এমনই ছড়িয়েছে, যে তার পাশে বামন দেখাচ্ছে শেয়ার বাজারের পতন নিয়ে আশঙ্কাকে। কেন্দ্রের অবশ্য দাবি, এ নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই।
টাকার এই ‘অধঃপতনে’ কেন্দ্রের মাথায় হাত। কারণ, এর ফলে বিদেশ থেকে তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ইত্যাদি ডলারে কেনার খরচ বাড়বে বহু গুণ। তা সামাল দিতে হয় বাড়তি ঘাটতির বোঝা ঘাড়ে নিয়ে আরও ভর্তুকি গুনতে হবে, নইলে ভোটের মুখে নিতে হবে দাম বাড়ানোর ঝুঁকি।
সাধারণ মানুষের ঝক্কিই বা কম কীসে? কারও ছেলে হয়তো বিদেশে পড়তে যাবেন, তার খরচ বাড়বে বিপুল। ডিজেল বা গ্যাসের দাম বাড়লে, তার আঁচ পড়বে হেঁশেলে। অধিকাংশ যন্ত্রাংশ মূলত আমদানি-নির্ভর হওয়ায় দাম বাড়বে টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিনের মতো বিভিন্ন গেরস্থালী বৈদ্যুতিন পণ্যের।
একই রকম বেহাল দশা শিল্পেরও। দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার তলানিতে (৫%)। ধুঁকছে শিল্পোৎপাদন। বাজারে চাহিদাও সুবিধার নয়। এই পরিস্থিতিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দিকে প্রায় চাতক পাখির মতো তাকিয়েছিল তারা। আশা ছিল, সম্প্রতি মূল্যবৃদ্ধির হার গত সাড়ে তিন বছরে সব থেকে নীচে নেমে আসায় সুদ কমাবে শীষর্র্ ব্যাঙ্ক। বাড়াবে নগদের জোগানও। ফলে চাহিদা বাড়বে। চাঙ্গা হবে বাজার। গতি ফিরবে শিল্প তথা অর্থনীতির চাকায়।
কিন্তু এর কোনওটাই হয়নি। সুদ না-কমিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বরং জানিয়ে দিয়েছে, মূল্যবৃদ্ধি এখন কমলেও ডলারের সঙ্গে ‘লড়াইয়ে’ টাকা যে ভাবে জমি হারাচ্ছে, তাতে সম্ভাবনা ফের মূল্যস্ফীতির দৈত্য ফিরে আসার!
সুতরাং সব মিলিয়ে যেন একটা দুষ্ট চক্রের মধ্যে আটকে গিয়েছে দেশের অর্থনীতি। যিনি কোনও কালে ব্যবসা-বাণিজ্যের খবর রাখেন না, তিনিও পথে-ঘাটে জিজ্ঞাসা করছেন টাকার এমন দুরবস্থার কারণ কী?
অর্থনীতিবিদদের মতে, এর অনেক কারণ রয়েছে। তবে মূল কারণ অন্তত স্বল্প মেয়াদে ‘আমেরিকার পৌষ মাস, টাকার সর্বনাশ’ গোছের। তাঁদের মতে, ২০০৮ সালে লেম্যান ব্রাদার্সের পতন এবং তার পর মার্কিন মুলুক সমেত সারা বিশ্বে মন্দা শুরুর পর উন্নত দেশগুলির শেয়ার বাজারের প্রতি লগ্নিকারীদের আস্থা তলানিতে ঠেকেছিল। ফলে সেই বিনিয়োগ সরে এসেছিল ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিতে। এখানেই টাকা ঢালছিল বিদেশি আর্থিক সংস্থাগুলি। আবার আমেরিকার অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ায়, শক্তি খুইয়েছিল সে দেশের মুদ্রা ডলারও।
কিন্তু হালে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে মার্কিন অর্থনীতি। সম্প্রতি বেকারত্ব কমছে বারাক ওবামার দেশে। পালে হাওয়া লাগতে শুরু করেছে শিল্পেরও। ফলে উন্নতির আভাস পেয়ে লগ্নি চলে যাচ্ছে সেখানেই। লগ্নির জায়গা হিসেবে কদর বাড়ছে ডলারেরও। আর ডলার যত শক্তিশালী হচ্ছে, ততই মুখ থুবড়ে পড়ছে টাকা।
এই প্রভাব যে কতটা জোরালো, তা স্পষ্ট এ দিনের ওঠা-নামাতেই। বুধবার মধ্যরাতে (ভারতীয় সময় অনুযায়ী) মার্কিন শীর্ষ ব্যাঙ্ক ফেডারেল রিজার্ভ জানিয়েছে, অর্থনীতির হাল ফিরতে শুরু করায় এ বার ধীরে ধীরে ত্রাণ প্রকল্প গোটাতে শুরু করবে তারা। বাজার অমনি আরও নিশ্চিত হয়েছে যে, তার মানে দ্রুত গতি বাড়াচ্ছে আমেরিকার অর্থনীতির ইঞ্জিন। সুতরাং, আগামী দিনে ডলার আরও চাঙ্গা হওয়ার সম্ভাবনা। ব্যস, এই আশাতে ভর করেই ষাটের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে ডলার।
অনেকেই মনে করছেন, উল্টো দিকে যদি ভারতীয় অর্থনীতিও মজবুত থাকত, তা হলে এত দুর্দশা হত না টাকার। কারণ সে ক্ষেত্রে এখানকার বাজারেও টাকা ঢালতে স্বচ্ছন্দ বোধ করত বিদেশি আর্থিক লগ্নি সংস্থাগুলি। কিন্তু এ দেশের অর্থনীতির অবস্থাও তো তথৈবচ। বৃদ্ধি থমকে। বিদেশি লগ্নি প্রায় নেই। দুর্নীতি আর রাজনৈতিক টানাপোড়েনে সরকার বিপর্যস্ত। দেশে ডলার আসার তুলনায় তা বেরিয়ে যাচ্ছে অনেক বেশি। কমছে গাড়ি বিক্রি। ধুঁকছে শিল্প। এই অবস্থায় বাজারে চাহিদা বাড়িয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সুদ কমানোর দাওয়াইয়ের কথা বার বার বলছে কেন্দ্র। সেই সঙ্গে শিল্পমহল আর্জি জানিয়েছে নগদ জমার অনুপাত (ব্যাঙ্কগুলির যে টাকা বিনা সুদে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে গচ্ছিত থাকে) কমানোর। যাতে বাজারে নগদের জোগান বাড়ে। বেশি টাকা থাকে মানুষের হাতে। আর তা দিয়ে বেশি-বেশি জিনিস কেনেন তাঁরা।
কিন্তু অন্তত সাম্প্রতিক ঋণনীতিতে সে কথায় কান দেয়নি শীর্ষ ব্যাঙ্ক। তাদের যুক্তি, মূল্যবৃদ্ধি টানা দু’মাস পাঁচ শতাংশের নীচে নেমে গিয়েছে ঠিকই। কিন্তু যে ভাবে টাকার দাম পড়ছে, তাতে কত দিন তা থাকবে, তা বলা শক্ত। কারণ, ডলারের দর যত বাড়বে, তত বেশি টাকা গচ্চা দিতে হবে তেল-গ্যাসের আমদানিতে। ফলে তার অদূর ভবিষ্যতে তার দাম বাড়ার সম্ভাবনা। আর কে না জানে যে, ডিজেল, গ্যাসের দর বাড়লে, দাম চড়ে প্রায় সব জিনিসেরই। অনেক অর্থনীতিবিদের মতে, শীর্ষ ব্যাঙ্কের এই যুক্তি ফেলে দেওয়ার নয়। কারণ, মূল্যবৃদ্ধির হার চড়া হলে, সাধারণ মানুষের ভোগান্তি তো হয়ই, ধাক্কা খায় লগ্নির পরিবেশও। কারণ, কোনও ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোনও শিল্প সংস্থাকে ধার দেয় সুদের বিনিময়ে। তারা আশা করে, সুদ সমেত যে টাকা তারা মেয়াদ শেষে ফেরত পাবে, তাতে সম্ভব হবে লাভের মুখ দেখা। কিন্তু টাকার দাম যদি খুব বেশি পড়ে, তা হলে তো ওই সুদ সমেত টাকাও তাদের কাছে অর্থহীন। তাই মূল্যস্ফীতি খুব বেশি হলে, ধার দেওয়া থেকে পিছিয়ে যাবে তারা। লগ্নির নগদ না-পেয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে শিল্পই।
তবে অর্থ মন্ত্রকের তরফে আজও বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে যে, পরিস্থিতি উদ্বেগের নয়। অর্থমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা রঘুরাম রাজন বলেন, সরকারের হাতে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার অস্ত্র রয়েছে। যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়ারও যুক্তি, শুধু ভারতের নয়। এটা বহু উন্নয়নশীল দেশের মুদ্রারই সমস্যা। এ দিন এই আশ্বাসে চিঁড়ে ভেজেনি। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর বিমল জালানও মনে করছেন, পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।
বেগতিক বুঝে সম্প্রতি দেশে ডলার আনতে বিশেষ ঋণপত্র (বন্ড) ছেড়েছে কেন্দ্র। প্রতিরক্ষা, খুচরো ব্যবসা থেকে টেলি যোগাযোগ বিদেশি লগ্নির ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানোর চিন্তা-ভাবনা চলছে প্রায় সব ক্ষেত্রেই। অবশেষে ওই পথে ডলার আসবে কি না, বাজার এখন তাকিয়ে সে দিকেই।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.