আস্থা ভোটে বিরোধিতার বদলে সভাকক্ষ ত্যাগ করে নীতীশ কুমারকে পরোক্ষ সমর্থনের বার্তা দিলেন বিজেপি নেতৃত্ব। নীতীশও আজ কংগ্রেসের সমর্থনে সরকার বাঁচালেও বিজেপি-র জন্য দরজা পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে চাইলেন না।
এ বারের লোকসভা নির্বাচনে দিল্লির মসনদ দখল করতে হলে এনডিএ-র বিস্তারই যে একমাত্র মন্ত্র, দলের অন্দরে তা অনেক দিন ধরেই বলে আসছেন বিজেপি-র প্রবীণ নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী। নীতীশের সঙ্গে সমঝোতা করে কোনও ভাবে যাতে তাঁর সঙ্গে জোট টিকিয়ে রাখা যায়, সেই চেষ্টাও করে গিয়েছেন তিনি। কিন্তু জোট ভাঙার পর আজ আস্থা ভোটের সময় বিহার বিধানসভায় দাঁড়িয়ে নীতীশ সেই কথাগুলিই প্রকাশ্যে বললেন, যা আডবাণীর মনের কথা। বিজেপি-তে নরেন্দ্র মোদী জমানা শুরু হওয়ার সন্ধিক্ষণে নীতীশ তাঁর প্রাক্তন সঙ্গীকে এই বার্তাই দিলেন, বিজেপি ফের পুরনো স্রোতে ফিরে এলে তাঁরও আবার জোটে ফিরতে আপত্তি নেই।
কিন্তু বিজেপি কেন ওয়াকআউট করে সুবিধে করে দিল নীতীশের?
বিজেপির মোদী-পন্থী অংশের বক্তব্য, নীতীশ তাঁদের দলের কিছু বিধায়ককে ভাঙিয়ে নিতে পেরেছিলেন। আস্থা ভোটে যোগ দিলে সেটা ধরা পড়ার সম্ভাবনা ছিল। তাই কক্ষত্যাগের কৌশল নেওয়া হয়েছে।
কিন্তু সেটাই কি একমাত্র কারণ? বিজেপির আর একটি অংশের বক্তব্য, তা নয়। আসলে তাদের দরজা যে এখনও নীতীশের জন্য খোলা রয়েছে, বিশেষ করে ২০১৪ সালের দিকে তাকিয়ে, সেটা বোঝাতেই বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ভোট দিতে চাননি বিজেপি নেতারা।
মোদী-পন্থী নেতারা অবশ্য আরও বলেছেন, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর জনপ্রিয়তায় ভয় পাচ্ছেন নীতীশ। তাই জোট ভেঙেও জোট রাখার বার্তা দিচ্ছেন। উল্টো দিকে, নীতীশেরও বক্তব্য, তাঁর এনডিএ-তে ফেরার পথে মূল বাধা নরেন্দ্র মোদীই। সে কথা আজ নীতীশ স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন। ক’দিন আগে জেডিইউ নেতা শরদ যাদবও ঠিক সে কথাই বলেছিলেন। জানিয়েছিলেন, বিজেপি-তে আডবাণী গুরুত্ব ফিরে পেলে আবার জোটে ফিরতে পারে জেডিইউ। নীতীশ দলের সেই মনোভাবকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিলেন আজ। বিধানসভায় তিনি অটলবিহারী বাজপেয়ী-লালকৃষ্ণ আডবাণীদের তারিফ করে ছত্রে ছত্রে বিঁধলেন মোদীকে। বারেবারে তুলে ধরলেন বাজপেয়ী মডেলের কথা। নীতীশের কথায়, “অটল-আডবাণীর জমানায় যখন অভিন্ন কর্মসূচির ভিত্তিতে জোটের সঙ্গী হয়েছিলাম, তখন সবাইকে সম্মান দেওয়া হত। সকলকে নিয়ে চলা হত। আর এখন অটল-আডবাণীদের মতো প্রবীণদের সম্মান দেওয়া হয় না। বিহারে আমরা সবাইকে নিয়ে চলার চেষ্টা করি। দেশের নেতা এমন হওয়া উচিত যিনি সবাইকে নিয়ে চলতে পারেন।”
বার্তা স্পষ্ট, বিজেপি-তে মোদীর ক্ষমতা খর্ব করে ফের যদি আডবাণীরা বলীয়ান হন, তা হলে জোটে ফিরতে কোনও আপত্তি নেই নীতীশদের। দলের মধ্যে আডবাণীরাও সেই কথা বলে আসছেন। আরএসএস-প্রধান মোহন ভাগবত এখন দিল্লিতে। তিনি আগামিকাল আডবাণীর ঘনিষ্ঠ নেত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে দেখা করবেন। বৈঠক হতে পারে আডবাণীর সঙ্গেও। যদিও অসুস্থতার কথা জানিয়ে আডবাণী আজ ভাগবতের সঙ্গে সম্ভাব্য বৈঠক বাতিল করেছেন। যাননি উমা ভারতীর একটি অনুষ্ঠানেও। দলের অনেকের ধারণা, রুষ্ট আডবাণী চাপ বাড়াতেই বৈঠক পিছোচ্ছেন। তবে এই বৈঠকের আগেই নীতীশ কার্যত আডবাণীদের হয়েই এনডিএ প্রসারের সূত্রটি বাতলে দিলেন।
আডবাণী ও নীতীশের এই মনোভাব বুঝেই জোটের রাস্তা খোলা রাখতে চান বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিংহরাও। তাঁদেরই নির্দেশে দলের বিধায়করা আস্থা ভোটে বিরোধিতার অবস্থান থেকে সরে এসে আজ সভাকক্ষ ত্যাগ করার কৌশল নিলেন। আডবাণীরাও এটাই চাইছিলেন। জোট টিকিয়ে রাখার দোহাই দিয়ে তাঁরা আসলে মোদীকেই রুখতে চাইছেন। তাই আডবাণীর ঘনিষ্ঠ সুধীন্দ্র কুলকার্নি নিবন্ধ লিখে একাধারে মোদী-রাজনাথ অক্ষকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করেছেন। মোদীকে ‘একনায়ক’ বলেও কটাক্ষ করেছেন কুলকার্নি।
যদিও রাজনাথ শিবিরের বক্তব্য, নীতীশের জন্য দরজা খোলা রাখলেও মোদীর প্রশ্নে এখন পিছু হটা সম্ভব নয়। কারণ, শুধু এনডিএ-র বিস্তার নয়, বিজেপি-র নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির কথাও ভাবতে হবে দলকে। এ ক্ষেত্রে বিজেপি-র কাছে একমাত্র মুখ মোদীই। কিন্তু তাঁকে কটাক্ষ করেই নীতীশ আজ বলেছেন, “যে মোদী-মোদী হাওয়া উঠেছে, তা দিবাস্বপ্ন। কিন্তু অচিরেই স্বপ্নভঙ্গ হবে। উন্নত এলাকার উন্নয়ন আসল নয়, পিছিয়ে পড়ার এলাকার উন্নয়নই আসল উন্নয়ন।”
মোদীকে আরও তির্যক আক্রমণ করে নীতীশ বলেন, “শুধু অনগ্রসর শ্রেণির পরিবারে জন্ম নিলেই হবে না, তাঁদের জন্য লড়াই করেই তাঁদের নেতা হওয়া যায়। কর্পোরেটের তৈরি নেতার হাওয়ায় দেশ চলে না। আর আরএসএস তো ঘোষণাই করেছে, তারা হিন্দুত্বের পথেই চলবে।” মোদীরও কৌশল হল, শরিকরা থাকুন বা না-ই থাকুন, বিজেপি-কে সর্বশক্তি দিয়ে আসন বাড়াতে হবে। বিজেপি একা দু’শোর কাছাকাছি আসন নিয়ে এলে শরিক এমনিতেই জুটে যাবে।
|