বর্ষার হাত ধরে জলবিদ্যুৎ ঢুকে পড়ল পশ্চিমবঙ্গে। তার ঠেলায় সাগরদিঘি ও কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের তিন-তিনটে ইউনিট আপাতত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিল রাজ্য সরকার।
রাজ্য বিদ্যুৎ দফতরের দাবি: দেশের যে গোটাকয় রাজ্যে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ভাল, সেই তালিকার প্রথম তিনের মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। এক কথায়, রাজ্যে বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত। কিন্তু বাড়তি বিদ্যুৎ কেনার মতো যথেষ্ট বড় গ্রাহক না-থাকায় রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা বিলক্ষণ সঙ্কটে পড়েছে, উৎপাদনক্ষম ইউনিট বসিয়ে রাখার সিদ্ধান্তে যার সম্যক প্রতিচ্ছবি দেখছে বিদ্যুৎ-শিল্প মহল। এমনকী, ভবিষ্যতে গ্রাহকদের গায়েও এর আঁচ লাগার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। সঙ্কটটা কী রকম?
দফতর-সূত্রের ব্যাখ্যা: চাহিদা বাড়বে ধরে নিয়ে গত ক’বছরে এ রাজ্যে নিজস্ব তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাইরে থেকে সস্তায় বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি হয়েছে। অথচ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়ন কার্যত থমকে থাকায় বিদ্যুতের চাহিদা সে ভাবে বাড়েনি। আবার জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বেচতে গিয়েও খদ্দের মিলছে না। কারণ অধিকাংশ রাজ্যের সরকারি বিদ্যুৎসংস্থাগুলোর ঘাড়ে কোটি কোটি টাকা ঋণের বোঝা। নগদে বিদ্যুৎ কেনার সামর্থ্য তাদের নেই। ফলে এত তোড়জোড় করে যে বাড়তি বিদ্যুতের সংস্থান, নিজেদের যাবতীয় চাহিদা মিটিয়েও তা উদ্বৃত্ত থেকে যাচ্ছে। এ দিকে বর্ষা নামতেই চুক্তি মেনে সিকিম-ভুটান-হিমাচলপ্রদেশ থেকে জলবিদ্যুৎ আসতে শুরু করেছে রাজ্যের গ্রিডে। তাতে উদ্বৃত্তের বোঝা ভারী হয়েছে। কিছুটা হলেও সেই ভার লাঘব করতে সাগরদিঘির ৩০০ মেগাওয়াটের দু’টো ও কোলাঘাটের ২১০ মেগাওয়াটের একটা ইউনিট বসিয়ে রাখা হয়েছে (অর্থাৎ বন্ধ রয়েছে মোট ৮১০ মেগাওয়াট উৎপাদন)। রাজ্য সরকারের এক মুখপাত্র জানাচ্ছেন, ভরা বর্ষায় আরও বেশি জলবিদ্যুৎ আসতে শুরু করলে ভারসাম্য রাখতে বিভিন্ন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের আরও কিছু ইউনিট বন্ধ করে দেওয়া হবে।
এতেই অশনি সঙ্কেত দেখছেন সরকার ও বিদ্যুৎ-শিল্প মহলের একাংশ। তাঁদের যুক্তি: ইউনিট বন্ধ থাকায় কয়লা কম পুড়ছে বটে, তবে আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচ থাকছেই। যেমন, কর্মী-বেতন, জলের দাম ইত্যাদি। অন্য দিকে উৎপাদন বন্ধ থাকায় ইউনিটপিছু খরচ বাড়ছে, যার বোঝা গ্রাহকদের ঘাড়ে চাপতে পারে। বস্তুত অদূর ভবিষ্যতে রাজ্যের শিল্প-পরিস্থিতির উন্নতি না-হলে গৃহস্থের বিলে এর প্রতিফলন পড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে বলে এই মহলের দাবি। কিন্তু হাতে উদ্বৃত্ত থাকতেও বাইরের জলবিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে কেন?
এক বিদ্যুৎ-কর্তার ব্যাখ্যা: বর্ষায় এমনিতেই কয়লার জোগানে টান পড়ে। পাশাপাশি, কয়লা ভেজা থাকায় তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনে সমস্যা হয়। তাই আগাম সতর্কতা হিসেবে বিভিন্ন জলবিদ্যুৎ সংস্থার সঙ্গে বণ্টন সংস্থা চুক্তি করে রেখেছে। এ ছাড়া জলবিদ্যুতের দামও পড়ে বেশ কম, তাতে গড় মাসুল নিয়ন্ত্রণে রাখতে সুবিধা হয়। চুক্তি মোতাবেক, বর্ষার মরসুমে শুধু সিকিম-ভুটান থেকে দৈনিক গড়ে ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসে (ভুটান থেকে ৫৪০, সিকিম থেকে ২১০)। উপরন্তু হিমাচলপ্রদেশ, জম্মু-কাশ্মীর ও কেন্দ্রীয় সংস্থা এনএইচপিসি (ন্যাশনাল হাইড্রো পাওয়ার কর্পোরেশন)-র কাছ থেকেও জলবিদ্যুৎ কেনা হয়। সব মিলিয়ে বর্ষাকালে বণ্টন সংস্থা গড়ে দৈনিক ১১০০-১২০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ খরিদ করে থাকে। বর্ষার গোড়ায় এখনই রোজ গড়ে চারশো-পাঁচশো মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ আসতে শুরু করেছে। এবং চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইউনিট বসিয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকছে না। “এই পরিস্থিতি বহাল থাকলে ফি বর্ষায় দু’টো ইউনিট বসিয়ে রাখলেও জোগানে ঘাটতি হবে না।” —মন্তব্য এক বিদ্যুৎ-কর্তার। এর বিপদের দিকটা মেনে নিয়েও তাঁর দাবি, “উন্নত দেশগুলোয় যেমন চাহিদার তুলনায় বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকাঠামো তৈরি থাকে, পশ্চিমবঙ্গের অবস্থাও এখন অনেকটা তা-ই। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহে কোনও অসুবিধে নেই!” |