তাই নাকি!
শুক্কুরবার বারবেলায় অফিসে-অফিসে রটে গেল বার্তা জামাইষষ্ঠী উপলক্ষে ছুটি ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। অর্ধদিবস। দু’টোর পরে অফিসছুটির সেই সংবাদ বেলা বারোটা নাগাদ ‘সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার’ (সার্কুলারে তাই লেখা) ভিত্তিতে ফ্যাক্স-রেডিওগ্রাম মারফত পৌঁছে গেল জেলায়-জেলায় সরকারি অফিসে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের তৈরি বাৎসরিক ছুটির ক্যালেন্ডারে ঢুকে পড়ল বাঙালির জামাইবরণও।
শুনে ফিক করে হেসে ফেললেন বর্ণালী বসু। সকাল থেকে টিপটিপ বৃষ্টিতে এমনিতেই অফিস যেতে ইচ্ছে করছিল না মধ্য চল্লিশের ওই মহিলার। নিতান্ত অনিচ্ছায় এসেছিলেন। “সাড়ে বারোটা নাগাদ খবরটা শুনে প্রথমে বিশ্বাসই হচ্ছিল না! জামাইষষ্ঠীর জন্য ছুটি!” সন্ধেতেও বর্ণালীদেবীর গলায় ঝরে পড়ছে বিস্ময়।
এই বিস্ময় নিয়েই দুপুরটা কাটিয়ে দিল মহাকরণ। দু’দিনের উইক-এন্ডের আগে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো হাফবেলা ছুটি পেয়ে অধিকাংশের মধ্যে ফেরার তোড়জোড়। অনেকের সে তাগিদ নেই, তাঁরা বসে পড়লেন আড্ডায়। কেউ বললেন, ‘বাড়াবাড়ি।’ কারও কটাক্ষ, ‘পরিবর্তনের সরকার! একটু নতুনত্ব তো থাকবেই!’ কেউ আবার কোনও মারপ্যাঁচে না-গিয়ে বললেন, ‘ছুটি মানে বিন্দাস থাকার ছাড়পত্র। অত ভেবে লাভ কী?’সরকারি জামাইদের একটা বড় অংশ অবশ্য এ দিন সকালেই শ্বশুরবাড়ি রওনা দিয়েছেন। বাকিরা রাতে যাবেন। তাঁদের এক জন গজগজ করছিলেন, ‘‘সেই তো আসতেই হল! কাল যদি জানিয়ে দিত...।” তাঁর মুখের কথা কেড়ে আর এক ভ্রমণবিলাসীর আক্ষেপ, “আগাম জানালে তো একটা প্ল্যান করে বেরিয়ে পড়তাম!” |
সরকারি অফিস-কাছারিতে এ দিন এমনিতেও হাজিরা ছিল কম। অনেক জামাই যেমন আগে থেকে ছুটি নিয়েছেন, তেমন অফিসারদের একটা অংশ পঞ্চায়েত ভোটের পর্যবেক্ষক হয়ে জেলায়-জেলায় ঘুরছেন। আবার বৃষ্টি কিছু লোককে বাড়িতে আটকে দিয়েছে। যাঁরা এসেছিলেন, হাফ ডে’র আমেজ নিয়ে তাঁদের অনেকে বেলাবেলি মহাকরণের সরকারি দোকান থেকে চিকেন, চিকেন নাগেট্স, চিকেন সসেজ ইত্যাদি কিনে বাড়ির পথ ধরলেন।
পরিবর্তনের সরকারের আমলে এ হেন অবাক-ছুটি অবশ্য নতুন কিছু নয়। দশকের পর দশক ধরে বহাল থাকা সরকারি অফিস বন্ধের তালিকায় এ বছর জুড়েছে ফতেয়া-দোয়াজ-দহম, জন্মাষ্টমী, ভাইফোঁটা। এ বারের দুর্গাপুজোয় টানা দশ দিন ছুটি দিতে একাদশী-ত্রয়োদশীতেও ছুটি ঘোষণা হয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রদায় বিচারে ছুটি-তালিকায় ঢুকে পড়েছে মহাবীর জয়ন্তী, ইস্টার স্যাটারডে, বুদ্ধ পূর্ণিমা, সব-এ-বরাত, কর্মপুজা ও ছটপুজা। মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যে জানিয়ে রেখেছেন, আগামী বছরের ১ জানুয়ারি, অর্থাৎ ইংরেজি নববর্ষের দিনও ছুটি পাবেন রাজ্য সরকারি কর্মীরা। তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন: জামাইষষ্ঠীর হাফ ডে।
এখানেই প্রশ্ন তুলেছেন সরকারি বিভিন্ন কর্মী সংগঠনের একাংশ। তাঁদের অভিযোগ: কেউ বন্ধ ডাকলে এই সরকার কর্মীদের অফিসে আসতে বাধ্য করে। না-এলে বেতন কাটে। প্রশাসন বুক বাজিয়ে জানায়, গত দু’বছরে কত কম শ্রম দিবস নষ্ট হয়েছে। অথচ সেই সরকারই যে কোনও উপলক্ষে ছুটি ঘোষণা করছে! “২৮% ডিএ বকেয়া থাকায় কর্মীরা ক্ষুব্ধ। ক্ষোভে প্রলেপ দিতেই সস্তার ছুটি-রাজনীতি।” তোপ এক কর্মী-নেতার।
বস্তুত জামাইষষ্ঠীতে অর্ধদিবস ছুটি দিয়ে সরকার কর্মীদের কতটা খুশি করতে পারল, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও একে ঘিরে সমাজের বিভিন্ন অংশে বিতর্কের আবহটা নজর কাড়ার মতো। কী রকম?
যেমন, দলীয় রং মাখা রাজনীতির সমীকরণ কিংবা আর্থিক পাওনাগন্ডাজনিত ক্ষোভ-বিক্ষোভের বাইরে গিয়ে সম্পূর্ণ অন্য অভিযোগ তুলছেন রাধিকানাথ মল্লিক। ‘পীড়িত পুরুষ পতি পরিষদ’-এর প্রধান রাধিকাবাবু বলছেন, “এক দিকে নানা আইনকে হাতিয়ার করে জামাইদের (পুরুষদের) হেনস্থা করছে ঘরের মহিলারা। আবার এই দিনে তাঁদেরই জামাই আদর করে খাওয়ানো হচ্ছে। এবং এই দ্বিচারিতার কথা জেনেও সরকার জামাইষষ্ঠীতে ছুটি দিচ্ছে! একেবারেই মানা যায় না।”
সমাজকর্মী শাশ্বতী ঘোষ আবার সরকারি সিদ্ধান্তে বাজারি সংস্কৃতির অবাঞ্ছিত প্রতিফলন দেখছেন। “জামাইষষ্ঠীর এখন বাণিজ্যকরণ হয়েছে। সোনার দোকান থেকে মাল্টিপ্লেক্স প্রত্যেকে একে টার্গেট করছে, বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। আমরা সেই তালে নাচছি। ছুটি ঘোষণা করে নৈবেদ্যের উপরে কলা দেওয়ার কাজটা নিপুণ ভাবে সেরে ফেলল সরকার।” মন্তব্য শাশ্বতীদেবীর। তাঁর আক্ষেপ, “এমনিতেই জামাইষষ্ঠীর দিনে বিকেলের পরে অফিস-কাছারি, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক খুঁজে পাওয়া ভার। ড্রাইভার ছুটিতে, রান্নার লোক ছুটিতে, মিস্ত্রিরা ছুটিতে। এখন সরকারের এক ঘোষণায় সব বৈধতা পেয়ে গেল!”
অন্য দিকে জামাইষষ্ঠী প্রথাটিকেই বিতর্কিত বলে মনে করেন সমাজকর্মী অঞ্চিতা ঘটক। তাঁর দাবি: ছেলেদের একটা দিন আলাদা ভাবে খাতির করার যুক্তি নেই। “কেন বাপু? মেয়েরা কী দোষ করল? তা ছাড়া একটা বিশেষ প্রথাকে কে কী ভাবে পালন করবে, তা তো ব্যক্তিগত ব্যাপার। সরকার এর মধ্যে ঢুকবে কেন?” মন্তব্য অঞ্চিতাদেবীর। তাঁর প্রশ্ন, “যাঁরা ছুটি পেলেন, তাঁদের সবাই কি জামাই? নাকি সবার বাড়িতে জামাইষষ্ঠীর রেওয়াজ রয়েছে? শুধু শুধু কাজের সময় নষ্ট করে কী লাভ?”
প্রতি ধর্ম-সম্প্রদায়ের এমন খুচরো-খাচরা প্রথা বা আচারে ছুটি দেওয়া শুরু হলে ভবিষ্যতে কাজের দিন খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর হবে বলে আশঙ্কা করছেন অঞ্চিতাদেবীর মতো অনেকে।
|
উনিশ শতকের পাঁজিতে জামাইষষ্ঠীর উল্লেখ নেই। ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র জানাচ্ছেন, প্রথম উল্লেখ মিলছে ১৯১০-এর পাঁজিতে, সঙ্গে উডকাট ছবিও। তাঁর মতে, মধ্যযুগের লৌকিক জামাই যেন শিব। সে নেশাভাঙ করে। কিন্তু যে জামাই অফিস ছুটি নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যায়, তার যোগ মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের সঙ্গে। সংস্কৃতের প্রবীণ শিক্ষক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর বক্তব্য, আগে গ্রামে মিষ্টি খাওয়াতে গেলে ভিয়েন বসাতে হতো। কিন্তু এই সময়টা আম-কাঁঠালের মরসুম বলে তা দিয়ে মেয়ে-জামাইকে আপ্যায়ন করাটা সহজ ছিল। সেটাই রেওয়াজে দাঁড়ায়। |