রাজনীতির কারবারিদের যাতায়াতের বিরাম নেই। তবু শক্ত চোয়াল একটুও নরম হয়নি কামদুনির। যেমন শুক্রবার, জামাইষষ্ঠীর দিনেও কার্যত নিয়মরক্ষার বাইরে কোনও আনন্দ-উৎসব, খাওয়াদাওয়ার অনুষ্ঠান করেননি এলাকার মানুষ।
দ্বিতীয় বর্ষের কলেজছাত্রীকে গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পরে এক সপ্তাহ কেটে গিয়েছে। সাধারণত এই অবস্থায় নেতা-মন্ত্রী-বিদ্বজ্জনেরা গেলেই তাঁদের হাত ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাড়ির মানুষ, সহায় খোঁজেন। এ ক্ষেত্রে কিন্তু ছবিটা আদৌ সে-রকম নয়। রাজনীতির লোকজন আসছেন, কথা বলছেন। কিন্তু বাড়ির লোকজনের কোনও আবেদন-নিবেদন নেই। কখনও তাঁরা নিস্পৃহ হয়ে থাকছেন। কখনও শুধু দাবিটুকুই পেশ করছেন স্বল্প, কিন্তু কাটা কাটা কথায়।
এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, দোষীদের চরম শাস্তির দাবিতে এবং মহিলাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অটল কামদুনি। তাই বেশি কথা শোনা ও বলার পক্ষপাতী নন তাঁরা। কামদুনি শুধু সুবিচার আর সমুচিত প্রতিকারটুকুই নিশ্চিত করতে চাইছে। ঘটনার ঠিক সাত দিনের মাথায়, শুক্রবার কামদুনিতে আলাদা আলাদা ভাবে গিয়ে এলাকাবাসীর এই মনোভাবের আঁচ বিলক্ষণ পেয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী এবং বামপন্থী বিদ্বজ্জনেরা। কনভয় ছেড়ে এ দিন বিকেলে বারাসত-২ নম্বর ব্লক অফিস থেকে বৃষ্টি মাথায় করে হেঁটে ওই ছাত্রীর বাড়িতে যাওয়া অধীরবাবুকে রীতিমতো জোর করে লাগোয়া স্কুলমাঠে নিয়ে যান কামদুনির বাসিন্দারা। তাঁদের অধিকাংশই মহিলা। রীতিমতো ক্ষোভের সঙ্গে তাঁরা প্রশ্ন করেন, “শুনলাম, আপনি চার কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে এসেছেন। এই রাস্তায় কোনও আলো নেই। পুলিশ নেই। একের পর এক ঘটনা ঘটছে। অথচ কোথায় নিরাপত্তা? আপনারা নেতা-মন্ত্রীরা কী করছেন?” |
ক্ষোভের শেষ নয় এখানেই। অধীরবাবু যখন ওই ছাত্রীর বাড়িতে গিয়ে বলেন ‘দরকার হলে আমাকে বলবেন’, ছাত্রীর দাদা বলে ওঠেন, “দোষীদের শাস্তি এবং এলাকার মহিলাদের নিরাপত্তার জন্য আমরা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে চাই।” মন্ত্রী জানান, তিনি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী সকলের কাছেই তাঁদের নিয়ে যাবেন। ছাত্রীর বাবা বলেন, “শুধু আমরা নয়, গোটা এলাকার মানুষ যাবে।” তখন রেল প্রতিমন্ত্রীকে বলতে হয়, “ট্রেনে করে এলাকার যত জনকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব, সকলকেই নিয়ে যাব।”
অধীরবাবুর আগেই, দুপুরে ওই ছাত্রীর বাড়িতে যান বাম বিদ্বজ্জনেরা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব চন্দন সেন ও বাদশা মৈত্র, প্রাক্তন সাংসদ মালিনী ভট্টাচার্য, আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য প্রমুখ। ছাত্রীর পরিবারের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা জানান, দোষীদের ফাঁসি এবং এলাকার মহিলাদের নিরাপত্তা দিতে যত দূর যেতে হয়, তাঁরা যাবেন এবং তাঁরা ওই ছাত্রীর পরিবারের সঙ্গেই আছেন। পরে চন্দনবাবু বলেন, “এর চেয়ে জঘন্য কিছু হতে পারে না। বারাসতে একের পর এক ঘটনা ঘটছে। পুলিশ-প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। আমরা আন্দোলনে নামব।” বারাসতে পুলিশ সুপারকে স্মারকলিপিও দেন তাঁরা।
কামদুনির মলিনা কয়াল, মৌসুমী কয়াল, সীমা ঘোষেদের কিন্তু সাফ কথা, “সবাই এসে একই কথা জিজ্ঞেস করছে। কেন একই কথা সবাই শুনছে, বুঝতে পারছি না। একই কথা বলতে বলতে আমাদের মুখ দিয়ে রক্ত উঠে গেল।” মৌসুমী বলেন, “এত কী জানার আছে? একটাই তো ব্যাপার। কয়েকটা পশুর হাতে মেয়েটা শেষ হয়ে গেল। ওদের প্রত্যেককে ধরে ফাঁসি দিতে হবে, আমাদের সকলের নিরাপত্তা দিতে হবে।”
পুলিশ-প্রশাসনের একটি অংশ থেকে কামদুনির মানুষের কাছে বারবার বলা হচ্ছে, অভিযুক্তদের প্রায় সকলেই তো ধরা পড়ে গিয়েছে। তাদের শাস্তির ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। তার পরেও কেন রোষ কমছে না? এলাকাবাসী জানান, খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এক দিনের মধ্যে আলোর ব্যবস্থা হয়ে যাবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও কামদুনি-মধ্যমগ্রাম বিডিও অফিস সড়কে বিদ্যুতের একটা খুঁটিও বসেনি। তৈরি হয়নি স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পও। তাঁদের অভিযোগ, শাসন-খড়িবাড়ি এলাকায় এখনও চোলাইয়ের ঠেক চলছে। গ্রামবাসীদের আশঙ্কা, তাঁরা চুপ করে গেলে ঘটনাটা আস্তে আস্তে ধামাচাপা পড়ে যাবে ও দুষ্কৃতীরা ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। কত দিন আন্দোলন চালিয়ে যাবে কামদুনি? এলাকাবাসীরা জানান, সরকার সুবিচার না-করলে, নিরাপত্তা না-দিলে তাঁরা প্রয়োজনে কলকাতা অচল করে দেবেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অধীরবাবু অবশ্য এলাকার মহিলাদের উদ্দেশে বলেন, “কোনও নেতা-মন্ত্রী কিছু করবে না। দুর্বৃত্তদের মোকাবিলা করতে হবে দা, বল্লম, টাঙ্গি নিয়ে। এ-সব নিয়ে নিজেরাই তৈরি থাকুন।” মহিলারা প্রশ্ন তোলেন, “আমরা কি স্কুলে-কলেজে, কাজের জায়গায় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাব?” অধীরবাবু বলেন, “প্রয়োজনে সেটাই করতে হবে। আপনারা এত দিন প্রতিবাদ করেননি বলেই পরপর এমন ঘটেছে। আপনারা যত লজ্জা আর ভয় পেয়েছেন, ততই অপরাধ করার সাহস দেখিয়েছে দুষ্কৃতীরা।” |
অধীরবাবু নিজের কেন্দ্র মুর্শিদাবাদ থেকে ইট, বালি, সুরকি এনেছিলেন কামদুনিতে। সেখানে, ঘটনাস্থলের কাছেই এ দিন শুরু হয়েছে ওই ছাত্রীর স্মারক বেদি তৈরির কাজ। শোক আর ক্ষোভের পাথর বুকে নিয়ে এলাকাবাসী সেই কাজ দেখেছেন। জামাইষষ্ঠীতে বাইরে থেকে মেয়ে-জামাই এসেছেন কামদুনির অনেক ঘরে। কিন্তু জামাইষষ্ঠীর আসল উৎসব আনন্দ করে খাওয়াদাওয়া হয়নি কোনও বাড়িতেই। ৭ জুনের পর সেই মনের অবস্থা নেই প্রায় কারও। এ ছিল নিয়মরক্ষার জামাইষষ্ঠী।
|