মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি বলেননি। কিন্তু বুধবার মহাকরণে তাঁর সঙ্গে কথা বলে কামদুনির বাসিন্দারা ধরে নিয়েছিলেন, বৃহস্পতিবারেই তাঁদের এলাকায় যাবেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই আশায় সারা দিন অপেক্ষা করে থেকে হতাশ হলেন তাঁরা। মুখ্যমন্ত্রী যাননি।
শুধু হতাশাই নয়, আতঙ্ক যেন এখনও যেন চেপে বসে রয়েছে কামদুনির বুকে। এলাকার মেয়েটির উপরে নৃশংস অত্যাচারের স্মৃতি এখনও টাটকা। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত আনসার আলির হুমকি। এক গ্রামবাসী বলেন, “পুলিশ যখন পাকড়াও করে নিয়ে যাচ্ছিল, তখনও আনসার হুমকি দেয়, ‘ফিরে এসে সবাইকে দেখে নেব’।”
মুখ্যমন্ত্রীকে পেলে কামদুনির গলায় চেপে বসা ব্যথা ও আতঙ্কের সাঁড়াশি হয়তো একটু আলগা হত। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যাননি। তবে আনসার ও অন্য অভিযুক্তদের শাস্তির ব্যাপারে গ্রামবাসীদের দাবি মেনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সেটা কী?
বুধবার ধর্ষিতার দুই ভাই-সহ বাসিন্দারা মহাকরণে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, সরকারি সাহায্য নয়, অপরাধীদের ফাঁসিই চান তাঁরা। এ দিন সরকারের তরফে জানানো হয়, ধর্ষণের সঙ্গে হত্যার অভিযোগ যুক্ত হওয়ায় আদালতে বিশেষত মূল অপরাধীদের ফাঁসির আর্জিই জানানো হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা জানান, মূল অভিযুক্তেরা জেরার মুখে সব অভিযোগ স্বীকার করেছে। ফলে পুলিশের কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে গিয়েছে। তবে এক অভিযুক্ত অধরা। |
মুখ্যমন্ত্রী চান, অভিযুক্তেরা জেলে থাকাকালীনই তিন মাসের মধ্যে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে কামদুনি মামলার নিষ্পত্তি হোক। সেই অনুসারে তৎপরতাও শুরু হয়ে গিয়েছে। সরকার মনে করে, এই ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক একটি নির্দেশও ফাঁসির দাবিকে জোরালো করবে।
ধর্ষিতা কলেজছাত্রীর দু’ভাই জানান, বুধবার মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর কথা শুনে তাঁদের মনে হয়েছিল, তিনি বৃহস্পতিবারেই কামদুনিতে আসতে পারেন। তাই সকাল থেকেই কামদুনির সব আন্দোলন স্থগিত হয়ে যায়। ঠিক ছিল, মুখ্যমন্ত্রী এলে তাঁকে ওই ছাত্রীর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানেই তাঁর কাছে মেয়ের খুনিদের শাস্তির দাবি জানাবেন ওই ছাত্রীর বাবা-মা। দাবি জানাবেন এলাকাবাসীরাও। কিন্তু সেই আশা এ দিন পূরণ হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী না-এলে ফের আন্দোলন শুরু হবে বলে জানান বাসিন্দারা।
মুখ্যমন্ত্রী তো দূর অস্ৎ, অফিস থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে ওই ছাত্রীর বাড়িতে যাননি স্থানীয় বিডিও দেবদুলাল পাত্রও। ঘটনার ছ’দিন পরেও। দেবদুলালবাবু অবশ্য বলছেন, “পঞ্চায়েত নির্বাচনের কাজে ব্যস্ত থাকায় যেতে পারিনি।” যদিও বাসিন্দাদের বক্তব্য, প্রথম দফার মনোনয়নপত্র পেশের শেষ দিন ছিল ৫ জুন। আর ধর্ষণ-খুনের ঘটনা ঘটেছে ৭ তারিখে। এর মধ্যে বিডিও এলাকায় আসার সময় পেলেন না!
মহাকরণে তো মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়েছে। তার পরেও তাঁর এলাকায় আসার বিষয়টির উপরে কেন এত জোর দিচ্ছেন এলাকাবাসী?
নিহত ছাত্রীর দাদা বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী বাবা-মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন। বলেছিলাম, আপনি এসে কথা বলুন। উনি এলে বাবা-মা মেয়ের খুনিদের ফাঁসিই চাইতেন।”
তা হলে কি মহাকরণে দেখা করে বাসিন্দারা পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন?
সন্তুষ্ট যে নন, তার আঁচ মিলল এ দিন বিকেলে গ্রামে ঢুকেই। আতঙ্কে, শোকে থমথম করছে ওই জনপদ। কোলে একটি বাচ্চা নিয়ে এক কিশোরের সঙ্গে দেখা হল রাস্তায়। কথা বলে জানা গেল, সে ধর্ষিতা ছাত্রীর ছোট
ভাই। সে-ই নিয়ে গেল পড়শির বাড়িতে থাকা মায়ের কাছে। মেয়ে-হারা মা শুধু বললেন, “যা বলার, বড় ছেলেই বলবে।”
ওই ছাত্রীর বাড়ির দাওয়ায় বসে ছিলেন তাঁর দাদা। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই চোখ গেল ঘরে আধো-অন্ধকারে বসে থাকা ছাত্রীর বাবার দিকে। যেন পাথরের মূর্তি!
থমথমে পরিবেশের মধ্যেও আশার কথা শুনিয়েছেন মেয়েরা। রাস্তার একটি পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল এক কিশোরী। বলল, “ভয় তো আছেই। কিন্তু পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে হবে।’’
ভয় কীসের? এবং কেন?
ভয় অন্ধকারের। সব অর্থেই অন্ধকার। ত্রাসের অন্ধকার। আলোর অভাবেও অন্ধকার। ধর্ষণ-খুনের পরে মন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও কামদুনি-বিডিও অফিস সড়কে আলোর ব্যবস্থা হয়নি। রাজারহাট থেকে যথেষ্ট গাড়ি যোগাযোগ ব্যবস্থাও গড়া যায়নি।
সরকারি সূত্রের খবর, কামদুনির ঘটনার পরে বারাসত থানা ভেঙে চারটি থানা গড়ার সিদ্ধান্ত রূপায়ণে প্রশাসনিক তৎপরতা শুরু হয়েছে। এ দিন সংশ্লিষ্ট ফাইল অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে অর্থ দফতরে। এক মুখপাত্র জানান, বারাসতে একাধিক থানা তৈরির সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছিল সরকার। কিন্তু তখন অর্থ দফতর তাতে অনুমোদন দেয়নি। তাঁর মন্তব্য, “পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করে আশা করা যায়, এ বার দ্রুত ফাইলের অনুমোদন দেবে অর্থ দফতর।”
শুধু প্রশাসনের বিরুদ্ধে নয়, ক্ষোভ রয়েছে রাজনৈতিক নেতা এবং বিশিষ্টজনেদের নিয়েও। এলাকাবাসী বলছেন, দলে দলে নেতারা এলেও সমাধানের পথ বার করছেন না।
আর বিশিষ্টদের তো আসার সময়ই হচ্ছে না! “হয়তো আমরা গ্রামবাসী বলেই শহুরে বিশিষ্টরা গুরুত্ব দিচ্ছেন না” মন্তব্য এক বাসিন্দার।
|