|
|
|
|
|
|
|
পরিচয় ২... |
|
আরও দাও প্রাণ |
পরদায় ভিলেন। আসলে মানুষটি তার বিপরীত মেরুর।
প্রাণের সঙ্গে বন্ধুতার গল্প বললেন ললিতা চট্টোপাধ্যায় |
তিরানব্বই বছর! এত বয়স হয়ে গেল প্রাণজি’র!
দিন কয়েক আগে দাদা সাহেব ফালকে যখন হাতে নিলেন, টিভিতে দেখলাম বহু বছর পর।
তখনই প্রথম লক্ষ করলাম। আমার চেয়ে বছর কুড়িরও বেশি বড় উনি। অথচ সামনাসামনি দেখে তো বোঝার উপায় ছিল না!
ষাটের দশকের মাঝামাঝি। আমি তখন মুম্বইতে। আমার প্রথম হিন্দি ছবি ‘রাত আন্ধেরি থি’র শ্যুটিং করছি। ফিরোজ খানের সঙ্গে। তখনই প্রাণজি’র সঙ্গে আলাপ। সুদর্শন। ধোপদুরস্ত। শৌখিন তো বটেই।
মুম্বই গেলে তখন যেখানে যেখানে উঠতাম, তার একটা জুহু বিচের একটা হোটেল। আমার খুব পছন্দের জায়গা। হোটেলটায় পাশাপাশি আলাদা আলাদা অনেকগুলো বাড়ি। বাড়ি না বলে সেগুলোকে কুটির বলাই ভাল। এক তলা। একটু দূরে দূরে। দোতলা বলে কোথাও কিছু নেই।
সে বার আমি যে ঘরে উঠেছিলাম, তার পাশেই ছিলেন রাজ সোনি নামের এক ব্যবসায়ী। প্রায় দিন সন্ধেবেলা ওঁর ঘরে আড্ডা বসত। অনেকেই আসতেন সেখানে। পরিচালক অসিত সেন, প্রযোজক-পরিচালক ও পি রালহান, গায়ক মুকেশ, অভিনেতাদের মধ্যে প্রদীপকুমার, ধর্মেন্দ্র, রাজেশ খন্না...।
ওই আড্ডাতেই প্রথম কাছ থেকে প্রাণজিকে দেখি। রাজ সোনি আলাপ করিয়ে দিলেন। উনি উঠে দাঁড়িয়ে আমায় অভ্যর্থনা করলেন। একটু বাদেই বুঝলাম, পরদায় ভিলেন প্রাণের একেবারে উলটো মেরুর মানুষ ইনি। শিক্ষিত, মার্জিত। ‘সেন্স অব হিউমার’ প্রচণ্ড। আর খুব আড্ডাবাজ। ফলে বন্ধুত্ব হতে বেশি সময় লাগল না।
খুব ছেলেবেলার গল্প করতে ভালবাসতেন প্রাণজি। ওঁর বাবা কেওয়াল কৃষেন সিকান্দ, মা রামেশ্বরীর গল্প। ওঁরা ছিলেন বর্ধিষ্ণু পঞ্জাবি। আর বিশেষ করে বলতেন নিজের চোখে দেখা দাঙ্গার গল্প।
প্রাণজি দেশভাগের আগে যে কোথায় ঠিক ছিলেন, বলেছিলেন। কিন্তু জায়গাটার নাম এখন আর ঠিক মনে পড়ে না। বোধহয় লাহৌর। দাঙ্গার স্মৃতি ছিল ওঁর ভয়ঙ্কর দগদগে। মারামারি, কাটাকাটি, রক্তারক্তির। প্রায় ভিটেমাটি হারিয়ে, সর্বস্ব খুইয়ে ওঁকে চলে আসতে হয় হিন্দুস্থানে। বেশ কিছু দিন পর আকাশবাণীতে একটা কাজ পেয়ে যান, তাই কিছুটা সামলাতে পেরেছিলেন। |
|
মেয়ের সঙ্গে প্রাণ |
প্রাণজিরা চার ভাই, তিন বোন। ওঁর বাবা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। রাস্তাঘাট, ব্রিজ তৈরির কাজ করতেন। নানা জায়গায় পোস্টিং হত ওঁর। যে জন্য প্রাণজিকে বিভিন্ন স্কুলে পড়তে হয়েছে। দেরাদুন, কপূরথালা, মিরাট ...।
ছেলেবেলায় নাকি অঙ্কে খুব ভাল ছিলেন। কিন্তু খুব ইচ্ছে ছিল পেশাদার ফোটোগ্রাফার হবেন। যে জন্য শিমলায় একটা চাকরিও নেন। কিন্তু অভিনয় জগতে আসাটা বোধ হয় ওঁর ভবিতব্যই ছিল। সিমলা গিয়েও ‘রামলীলা’য় একবার নাকি সীতা হয়েছিলেন প্রাণজি। আর রাম হয়েছিলেন যিনি, পরবর্তী কালে তিনিও বিখ্যাত অভিনেতা মদন পুরী।
প্রাণজির সঙ্গে অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই খুব হৃদ্যতা হয়ে গিয়েছিল আমার। একটা কথা প্রায়ই বলতেন, “আমি না তোমার মতো মেয়ে দেখিনি। তোমার জন্যই বার বার জুহুর আড্ডায় ছুটে আসি।” কী জানি, কেন বলতেন, কোনও দিন জিজ্ঞেসও করিনি। কিন্তু উনি বলতেন প্রায়ই। আমাকে অনেক প্রযোজকের কাছে নিয়ে যেতেন। অনেকের সঙ্গে আলাপও করিয়ে দিতেন। অসম্ভব পরোপকারী। দিলদরিয়া। আর হয়তো কিছুটা অভিমানীও। সেই অভিমান থেকেই নিজের জীবনীগ্রন্থের নাম দিয়েছেন ‘...অ্যান্ড প্রাণ’। একজন আপাদমস্তক ভদ্রলোক, সারা জীবন শুধুই ভিলেনের চরিত্র করে গেলেন বাধ্য হয়ে। কাস্টিংয়ে নাম আসত সবার শেষে। মেনে নিতে পারতেন না মনে মনে। গল্পে-আড্ডায়, সেই অভিমান বেরিয়ে পড়ত মাঝেসাঝেই। ‘চাণক্য’ করার খুব ইচ্ছে ছিল তখন থেকেই। ওঁর স্বপ্নের চরিত্র।
একবার মনে আছে, ওঁর সঙ্গে কোথায় একটা যাচ্ছি। হঠাৎ মাঝপথে ড্রাইভারকে গাড়ি থামিয়ে দিতে বললেন। তার পর দেখি, উলটো দিক থেকে আসা
যৌবনে ললিতা |
একটা গাড়ি আমাদের পাশে এসে থেমে গেল। তার দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন দিলীপকুমার। আমরাও নামলাম রাস্তায়। আমাকে দিলীপকুমারের সঙ্গে পরিচয় করালেন প্রাণজি। রাস্তায় ভিড়ে ভিড়। বিপদ বুঝে পালালাম আমরা।
কাকা, মানে রাজেশ খন্নার সঙ্গে আমি একবার কোনও একটা পার্টিতে গিয়েছি। তখন তো মোবাইলের যুগ নয়। কিন্তু কী ভাবে যেন প্রাণজি আমাদের খবর পাঠালেন, উনি জুহু হোটেলে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। আমরা যেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসি। এ দিকে পার্টিতে গিয়ে কাকা আর আমি দু’জনেই ভুলে গিয়েছি সে কথা। একেবারে ফেরার পথে মনে পড়েছে। তখন সত্যিই খুব খারাপ লাগছিল।
কাকা বলল, “শোনো, বলবে ফ্ল্যাট টায়ার হয়েছিল।” ফিরে কাঁচুমাচু হয়ে প্রাণজিকে তাই-ই বললাম। শুনে অদ্ভুত একটা মুখ করে কাকার দিকে চেয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, “বুঝলাম। ইদানীং দেখছি, কাকার গাড়িতে ঘনঘনই ফ্ল্যাট টায়ার হচ্ছে।”
জুহুর হোটেলটা ছিল সমুদ্রের একেবারে ধারে। পিছনের দরজা দিয়ে বেরলেই সাগর। বর্ষার সময় সাগরপারে খুব ভুট্টাওয়ালা আসত। ওদের দেখলেই প্রাণজি দলবল নিয়ে চলে যেতেন সাগরের ধারে। ভুট্টা খেতে খেতে আমরা আড্ডা দিতাম।
মুম্বইতে ওঁর বাড়িও গিয়েছি। যত দূর মনে পড়ে পালি হিলসে ছিল বাড়িটা। বাংলো টাইপের। প্রচুর গাছপালা। ওঁর মেয়ের নামটা আজও মনে আছে, পিঙ্কি। প্রাণজির দুই ছেলে সুনীল আর অরবিন্দ। পিঙ্কির নামের সঙ্গে মিলিয়ে ওর ঘরের রংটা ‘পিংক’ করে দিয়েছিলেন প্রাণজি।
প্রাণজির বাড়ির একটা ব্যাপার আমার মারাত্মক ভয়ের ছিল। সেটা হল ওঁর পোষা কুকুরের ঘরগুলো। অনেকগুলো অ্যালসেশিয়ান ছিল ওঁর। দিনের বেলায় তারা থাকত ঘরের ভেতরে। তালাবন্ধ। রাতে ওরা রাজ করত গোটা বাংলোয়। ওঁর যে কী অসম্ভব কুকুরপ্রীতি ছিল! বলতেন, “এ আমার বাবার কাছ থেকে পাওয়া। বাবাও খুব কুকুর-ভক্ত ছিলেন। পুষ্যি ছাড়া শুধু একটা দিন কাটিয়েছি।” কোন দিন? “যে দিন দাঙ্গার সময় বাধ্য হয়ে বাড়িছাড়া হলাম।”
আমি তো দিনের বেলায় যেতাম ওঁর বাড়ি। একদিন কোত্থেকে একটা কুকুর ছাড়া পেয়ে একেবারে আমার সামনে। আমি তখন ভয়ে পাথর। একটু দূরেই প্রাণজি দাঁড়িয়ে। পিছন ফিরে। ফলে উনিও প্রথমে বুঝতে পারেননি। হঠাৎ ফিরে তাকাতেই দেখেন, ওই অবস্থা। প্রায় লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে আমাকে জাপটে ধরে উদ্ধার করলেন উনি। তার পর তো প্রাণজি লজ্জার একশেষ। ‘ইয়াদগার’ ছবিতে আমি আর প্রাণজি একসঙ্গে কাজ করেছি। সে সময় রাজস্থানের বেশ কয়েকটা জায়গায় আমাদের অনেক দিন করে কাটাতে হয়েছিল। বিকানিরে আমরা সার্কিট হাউসে থাকতাম। প্রাণজি ছাড়া ওই সার্কিট হাউসে তখন ছিলেন মনোজকুমার, নূতন, প্রেম চোপড়া, মদন পুরী....। কাজের পর সন্ধেগুলো খুব মজার ছিল। ওঁরা পঞ্জাবি গান শোনাতেন। আমাকে বলতেন বাংলা শোনাতে। আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতাম। ভাষা ওঁদের বোঝার কথা নয়, বুঝতেনও না। কিন্তু প্রাণজি কেমন একমনে শুনতেন!
প্রাণজির একটা গুণ খুব খেয়াল করতাম। সব ব্যাপারে দেখতাম, অদ্ভুত একটা আগ্রহ। ‘ইয়াদগার’য়ের শ্যুটিংয়ের সময় উদয়পুরের লেক প্যালেসে আমরা টানা এক মাস ছিলাম। ওঁকে দেখতাম একটা মন্দিরও বোধহয় বাকি নেই, যেখানে যাননি। না, শুধু ভক্তির কারণে নয়, অসম্ভব খুঁটিয়ে দেখতেন মন্দিরের কারুকাজ। রাজস্থানের পুতুলনাচ খুব বিখ্যাত। সেই নাচ দেখার জন্যও ছিলেন পাগল। ইন্টারেস্টিং চরিত্রই বলুন, এমনকী কোনও ফোটোগ্রাফ, একবার দেখতেন কী, মনে গেঁথে নিতেন। এমন করেই ওঁর ‘লুক’য়ে এক এক সময় উঠে এসেছে পরিচিত মুখের আদল। ‘ইয়াদগার’য়ের পর যোগাযোগ কমে এসেছিল। একদিন দিল্লিতে একটা কাজে গিয়েছি। ইম্পিরিয়াল হোটেলের ডাইনিং হলে হঠাৎ দেখি প্রাণজি। সে দিন অবশ্য বেশিক্ষণ কথা হয়নি। দুজনেই খুব ব্যস্ত ছিলাম। এর পর একদিন ওঁর তলব। পালি হিলসে একটা নতুন ছবির শ্যুটিং। আমার কাজের সম্ভাবনা ছিল। উনি তাই ডেকে পাঠালেন। ওটাই এখনও অবধি ওঁকে শেষ বার দেখা।
তার পর বহু বছর কেটে গিয়েছে। ধীরে ধীরে সময়ও ফুরিয়ে আসছে আমাদের। এই তো সে দিন রাজেশ চলে গেল। মাঝে মাঝে প্রাণজির খবর পাই। শুনেছি ইদানীং বিশেষ কিছু মনে রাখতে পারেন না। তবু আছেন তো... এটকুই ভাবি... পুরনো কথাগুলো কেমন ভিড় করে আসে ...সে সব কিছুই তো আর ফিরে পাওয়ার নয়...! |
|
|
|
|
|