|
|
|
|
|
|
|
পরিচয় ১... |
|
প্রাণতপস্যা |
গালিব ওঁর পছন্দের। ফুটবল ক্লাবও ছিল তাঁর। কিন্তু অভিনয়টা তাঁর অন্তরাত্মায়। তিরানব্বই
বছরে আজও তিনি শের খান! দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রাণ সিকন্দ।
তাঁর কথায় মনোজকুমার। শুনলেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত |
গুজরা হুয়া জমানে কা
অব্ তজকিরা হী ক্যায়া,
আচ্ছা গুজর গ্যয়া, বহুত আচ্ছা গুজর গ্যয়া
এই দু’টো লাইন লিখেই তাঁর জীবনী ‘... অ্যান্ড প্রাণ’ শেষ করেছিলেন তিনি।
তিনি, মানে প্রাণ সিকন্দ।
প্রায় এক মাস হল দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার পেয়েছেন।
কিন্তু অনেকেরই ধারণা, পুরস্কারটি তাঁর অনেক আগেই পাওয়া উচিত ছিল।
পুরস্কার সব সময় তো শুধুমাত্র অভিনয়ের জন্য নয়। প্রাণ মানে জীবন, আর জীবনে কী ভাবে চলতে হয়, নিজের কর্মক্ষেত্রে ও তার বাইরে এ সব তো জীবন দিয়ে শিখিয়েছেন তিনি।
আর এটাই তো বারবার মনে করিয়ে দিতে চান তাঁর বহু দিনের সহকর্মী আর বন্ধু অভিনেতা মনোজকুমার।
ছাত্রাবস্থা থেকেই মনোজকুমার ছিলেন প্রাণের ভক্ত। ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে করতে উনি প্রাণের কাছে হয়ে ওঠেন তাঁর প্রিয় ‘পণ্ডিতজি’। বলিউডে কম করে তেরোটি ছবিতে দু’জনে একসঙ্গে কাজ করেছেন। ‘গুমনাম’, ‘শহিদ’, ‘দো বদন’, ‘সাওয়ন কি ঘটা’, ‘পত্থর কে সনম’, ‘উপকার’, থেকে ‘আদমি’, ‘পুরব অউর পশ্চিম’, ‘ইয়াদগার’, ‘বেইমান’, ‘সন্ন্যাসী’, ‘দশ নম্বরি’ আর ‘জয় হিন্দ’ পর্যন্ত।
তবু মনোজ নির্দ্বিধায় বলেন যে, এত দিনের বন্ধুত্বের পরেও আজও যদি একটি বাক্যে প্রাণকে ব্যাখ্যা করতে বলা হয়, তবে সেটা দুঃসাধ্য একটা কাজ হবে। “ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে প্রাণ সাব হলেন সব চেয়ে বড় অলরাউন্ডার। আর এর সঙ্গে আর একটা কথা যোগ করব। ওর মতো এ রকম ভদ্রলোক আমি খুব কম দেখেছি,” বলেন মনোজকুমার। |
|
এত প্রযোজকের কাছে কাজ করেছেন প্রাণ, তবু একজনের মুখেও কোনও দিন ওঁকে নিয়ে কোনও ক্ষোভ শোনেননি তিনি।
আর তা হবে নাই’বা কেন? এমন একজন অভিনেতার জুড়ি মেলা ভার, যিনি তাঁর বোনের মৃত্যুর পরেও কাউকে বুঝতে না দিয়ে মুখ বুজে শ্যুটিং করে গিয়েছেন সারাদিন। শুধুমাত্র এই ভেবে যে বোনের মৃত্যুর জন্য শ্যুটিং বাতিল করলে তো বোন ফিরে আসবে না, কিন্তু প্রযোজকের অনেক ক্ষতি হবে!
আজও এই ঘটনাটা মনে করতে গিয়ে খানিকটা বিহ্বল হয়ে পড়েন মনোজকুমার। ঘটনাটি ঘটে ছিল ‘উপকার’য়ে একটা মারামারির দৃশ্য শ্যুটিঙের সময়।
মালাং চাচার ভূমিকায় প্রাণ। “কাজের ফাঁকে লক্ষ করেছিলাম যে প্রাণ সাব যেন কেমন একটা আনমনা হয়ে বসে আছেন। শট দিচ্ছেন, তার পর একটা কোনায় গিয়ে বসে সিগারেট ধরাচ্ছেন। কিছু হয়েছে কি না জিজ্ঞেস করার পরেও কিছু বলেননি। তা শুনে আমি ভেবেছিলাম যে উনি হয়তো একটু টায়ার্ড বলে চুপচাপ থাকছেন,” মনোজ বলেন। কিন্তু সেটা আদৌ ঠিক কারণ ছিল না। একই মেক আপ রুম ছিল দু’জনের। সে দিন শ্যুটিং শেষ হয় রাত সাড়ে দশটার কাছাকাছি। তখনও প্রাণ চুপচাপ। মনোজ কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন, খুব পরিশ্রান্ত নাকি? “হঠাৎ দেখি গোটা শরীরটা কেঁপে উঠল ওঁর। অনেকটা হেঁচকি তোলার মতো করে বললেন: ‘গতকাল এগারোটার পরে প্যাক-আপ হয়েছিল। বাড়িতে ফিরে শুনি কলকাতা থেকে খবর এসেছে, আমার বোন মারা গিয়েছে!’” মনোজ জানান।
মেক আপ রুমে তখন থমথমে পরিবেশ। স্বাভাবিক ভাবেই মনোজের মনে প্রশ্ন, “যে মানুষটা সারা রাত ঘুমায়নি, সে কী করে ভোর সাতটায় আমার সেটে এসে পৌঁছেছিলেন? খবরটা জানালে তো শ্যুটিং ক্যানসেল করে দিতাম।” উত্তরে প্রাণ বলেন যে, এই কারণেই উনি খবরটা জানাননি। কারণ শ্যুটিং ক্যানসেল হলে তো অনেক টাকার লোকসান। “কাজের প্রতি এই ধরনের কমিটমেন্টের উদাহরণ আর একটাও দেখিনি,” সাফ জানান মনোজ।
যে অভিনেতা সারাটা জীবনের কেরিয়ারে বেশির ভাগই ‘খুন, ডাকাতি আর ধর্ষণ’ করে গেলেন, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনটা ছিল রুপোলি পর্দা থেকে একেবারেই অন্য মেরুর। “কোনও দিন কোনও নায়িকাকে দেখিনি ওঁর সঙ্গে কাজ করতে আড়ষ্ট বোধ করতে। একটা ছবি করতে গিয়ে সায়রাবানুর সঙ্গে একটা মজার ঘটনা হয়। প্রাণ সাব সেই একজন ধর্ষকের চরিত্রে। সায়রা বোধহয় কিছু একটা সাজেশন দিয়েছিলেন। প্রাণ সাব ওঁকে থামিয়ে বলেন: ‘চিন্তা কোরো না। পঁচিশ বছর আগে স্ক্রিনে এ ভাবে আমি তোমার মাকেও রেপ করেছি!’” হেসে বলেন শিল্পী।
বাড়িতে একেবারেই অন্য রকম মানুষ তিনি। বহু দিন শ্যুটিংয়ের পরে বাড়ি ফিরে আড্ডা দিতেন। “কোনও কোনও দিন ওঁর স্ত্রী শুক্লার হয়তো ফিরতে একটু দেরি হত। ঢোকা মাত্রই প্রাণ সাবকে দেখতাম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে,’’ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে প্রশংসা করে যান মনোজ।
আর তার পর গল্প করেন কী ভাবে দু’জনের বন্ধুত্ব শুরু হয় ‘দো বদন’য়ের সেট থেকে। পরিচালক রাজ খোসলা মনোজকে এতটাই পছন্দ করতেন যে তিনি চেয়েছিলেন ছবির কিছু দৃশ্যও যেন তিনি লেখেন। মনোজ তখন নিজে ‘শহিদ’ও লিখছেন। আর ‘দো বদন’ ছবির সেটে রাজ খোসলাকে ‘শহিদ’য়ের স্ক্রিপ্টটা পড়ে শোনাতেন। প্রাণ স্ক্রিপ্টটা শুনে মনোজের কাছে জানতে চেয়েছিলেন ডাকু কেহার সিংহ-য়ের চরিত্রটায় কে অভিনয় করবেন? তাতে মনোজ জানান, সেটা অনেকটাই প্রযোজকের উপর নির্ভর করবে। তা শুনে প্রাণ বলেন, ছবি শুরু হওয়ার আগে যেন প্রযোজককে একবার তাঁর কাছে পাঠানো হয়।
পরে প্রযোজককে যখন মনোজ এটা জানান, প্রযোজক বলেন প্রাণের তখন যা পারিশ্রমিক তা তাঁর পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। “তবুও আমি বলি, কথা দেওয়া ছিল। তাই একবার যেন প্রযোজক প্রাণ সাবের সঙ্গে দেখা করেন। মিটিংয়ের পরে দেখি আমার প্রযোজক তো আহ্লাদে আটখানা। বললেন: ‘আমি যখন প্রাণ সাবকে বলি যে আমার পক্ষে এক লক্ষ টাকা দেওয়া সম্ভব নয়, উনি জিজ্ঞেস করেন কত দিতে পারব। আমি বলি সাত কী আট হাজার! তা শুনে বলেন যে তুমি আমাকে সাত বা আট হাজার যাই দাও, তবে এটা জেনে রেখো যে তোমার ছবিটি করতে যদি কখনও সাত বা আট হাজার টাকা লাগে, তা হলে আমি কিন্তু সেটা তোমাকে দিতে পারি।’ অভিনয় করতে তাঁর ছিল এই রকম প্যাশন,” মনোজ বলেন।
লুধিয়ানাতে এই ছবির শ্যুটিংয়ের জন্য প্রায় একশো জনের ইউনিট। মনোজ শ্যুটিং করতেন জেলের ভিতরে। পরে এমনটাও শুনেছিলাম যে প্রাণ নাকি গোটা ইউনিটের এন্টারটেনমেন্টের জন্য প্রায় তিন লক্ষ টাকা খরচ করেছিলেন!
পরে ‘উপকার’ ছবিটি করার সময় আবার মনোজ যান প্রাণের কাছে। স্ক্রিপ্ট শোনার পরে প্রাণের অট্টহাসি। “এই রোলটা আমার জন্য নয়। আমি বোঝাই মালাং চাচার রোলটা ওঁর জন্যই লেখা। তখন প্রাণ সাব একটা শর্ত দেন। ‘শহিদ’ করতে গিয়ে তো তেমন কিছুই টাকা-পয়সা পাননি। তাই ‘উপকার’ করলে ওঁকে যেন রেগুলার পারিশ্রমিক থেকে একশো টাকা বেশি দেওয়া হয়। সেটাই দেওয়া হয়েছিল। পরে আমি দেখি যে এই একশো টাকাটা উনি এক গরিব-দুঃখীকে দান করে দিলেন,” জানান অভিনেতা। ‘গুমনাম’য়ের সেট থেকে আর একটা গল্প বলেন তিনি। প্রাণের কলটাইম ভোর সাতটা। কিন্তু উনি সেটে পৌনে সাতটায় এসে উপস্থিত। মনোজ পৌঁছে দেখেন উনি মেক আপ রুমে ঘুমিয়ে আছেন। ঘুম থেকে উঠে বলেন, আগের দিন অনেক রাত অবধি পার্টি হয়েছিল। পার্টি থেকে বাড়ি গেলে ঘুমিয়ে পড়তে পারেন। তা হলে যদি সেটে আসতে দেরি হয়ে যায়? তাই পার্টি থেকে সোজা সেটে চলে আসেন! |
|
জঞ্জির |
অভিনয়ের দিক থেকে প্রাণের অন্যতম বড় গুণ ছিল তাঁর প্রত্যেকটা সংলাপকে তিন থেকে চার রকম ভাবে বলার ক্ষমতা। “দারুণ ভাল অবজার্ভার ছিলেন উনি। রাজ কপূর, দিলীপ কুমার, দেব সাব সবার সঙ্গে দাপিয়ে অভিনয় করে গিয়েছেন। আমার ধারণা এই সব দাপুটে অভিনেতাদের, একজন সুযোগ্য অপোজিশনের সঙ্গে অভিনয় করতে পারার জন্য তাঁদের নিজেদের অভিনয় ক্ষমতাটাও আরও বেশি ঝাঁঝালো হয়েছে। একজন অভিনেতার কাজ আরও ভাল হয় যখন তাঁর বিপরীতে একজন দক্ষ অভিনেতা থাকেন। প্রাণ সাব প্রত্যেকটি ছবিতে এটা করে গিয়েছেন।”
আর ‘জঞ্জির’য়ের শের খান? শুধু তো রঙিন দাড়ি আর উইগ পরেই পাঠানের চরিত্রে মন জয় করেননি তিনি। স্বরে বৈচিত্রও এনেছেন। “অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে কাজটা দেখুন। অমিতাভ তখন একদম আনকোরা, নতুন। আর তাঁর সামনে প্রাণ সাব আদরণীয় এক পাঠান। প্রাণ সাব সব সময় নতুনদের খুব উৎসাহ দিতেন। কী অসাধারণ সে সব অভিব্যক্তি,” মনোজ ব্যাখ্যা করেন।
তবে এই রকম অভিনয় করার পরেও কেন প্রাণকে শুধু ভিলেন হিসেবে টাইপকাস্ট করা হয়? “এটাই আমাদের ইন্ডাস্ট্রির দুর্ভাগ্য। ‘উপকার’য়ে আমি ওকে পজিটিভ চরিত্রে কাস্ট করি। কত জন যে আমাকে বারণ করেছিল মান্না দে-র গলায় ‘কসমে ওয়াদে পেয়ার বফা’ গানটা প্রাণ সাবের উপর যেন চিত্রায়ণ না করি। আমি রাজি হইনি। আমার ধারণা, যদি একজন ভাল মানুষ ভিলেনের রোল করতে পারে, তা হলে সে ভাল মানুষের চরিত্রে অভিনয় করতে পারবে না কেন?”
ইন্ডাস্ট্রি কিন্তু এটা বোঝেনি। আর এই দুঃখটাই রয়ে গিয়েছে প্রাণের সতীর্থের। “সাফল্য পেতে গেলে রিস্ক নিতেই হবে। সেটাই ইন্ডাস্ট্রি প্রাণ সাবের মতো একজন অভিনেতাকে নিয়ে করেনি। ওঁর মধ্যে একটা বড় গুণ ছিল, তা হল এটা বোঝা যে কখন অবসর নেওয়া উচিত। অনেক অভিনেতাই এটা মেনে নিতে পারেন না যে অবসরের সময় এসেছে। উনি চাইলে কিন্তু প্রযোজকদের ঠকাতে পারতেন। রোল নিয়ে সে রকম কমিটমেন্ট নাও দিতে পারতেন। কিন্তু না, প্রাণ সাব তা করেননি। এটা একটা বড় গুণ।”
কেউ কারও জায়গা নিয়ে নিতে পারে না। কিন্তু উত্তরসূরি তো মাঝে মধ্যে খোঁজা হয়। কোন অভিনেতার মধ্যে খুঁজে পান প্রাণের ছায়া? বিনোদ খন্না, শত্রুঘ্ন সিংহ আর গুলশন গ্রোভার মনোজের ধারণা এই অভিনেতারা প্রাণের থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছেন।
আজকাল শরীর অত ভাল থাকছে না সব সময়। একটু ভাল থাকলে মাঝে মধ্যেই ফোনে কথা হয়। এক-আধ বার গিয়ে দেখাও করে আসেন মনোজ। “ঊর্দু কবিতা দারুণ পছন্দের। গালিব, মীর তো আছেনই, তার সঙ্গে পছন্দ অসগর গন্ডভির কবিতা। এক সময় তো নিজের ফুটবল ক্লাবও ছিল। নাম ছিল ‘বম্বে ডায়নামোস ফুটবল ক্লাব’। স্মৃতি রোমন্থন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তে দেখি না ওঁকে। একটা কথা মাঝে মাঝেই বলেন: ‘ডোন্ট ওয়ারি, আই অ্যাম ওকে’।”
আর এই আশ্বাসের মধ্যে দিয়ে যেন বুঝিয়ে দেন যে তিরানব্বই বছরের লম্বা ইনিংসের পরেও শের খান এখনও তাঁর প্রতাপ হারিয়ে ফেলেননি। |
|
|
|
|
|