|
|
|
|
|
|
|
মুখোমুখি... |
|
মা দেবকী, তো শাশুড়ি যশোদা |
ভরপুর সংসারী। জপতপ সেরে শ্যুটিংয়ে যান। তাঁকেই আবার ঋতুপর্ণ ঘোষ
বলতেন ‘খড়খড়ি মেয়ে’। অপরাজিতা আঢ্যর কথা শুনলেন সংযুক্তা বসু |
পত্রিকা: ‘জলনূপুর’ সিরিয়ালে হঠাৎ একজন অপ্রকৃতিস্থ নারীর ভূমিকায় আপনি। এটা কি ইমেজ ভাঙার জন্য?
অপরাজিতা: না। ইমেজ ভাঙার জন্য নয়। এর পিছনে একটা গল্প আছে।
পত্রিকা: কী গল্প?
অপরাজিতা: ‘জলনূপুর’-এর চিত্রনাট্যকার লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের কাজ আমার খুব ভাল লাগে। লীনাদির চিত্রনাট্যে তৈরি ‘ইস্টিকুটুম’ আর ‘কেয়াপাতার নৌকা’ দেখে মুগ্ধ হয়ে ফোন করেছিলাম ওঁকে। বলেছিলাম তোমার সঙ্গে কাজ করতে চাই। উনি তখন বললেন, “পরের কাজটা যখন হবে, তখন তোমায় বলব।” তার পর ‘জলনুপূর’-এর সময় উনি আমাকে বললেন কাজ করতে। দু’টো চরিত্র ছিল অভিনয়ের মতো। আমি তখন এই অপ্রকৃতিস্থ বা অটিস্টিক মেয়ে ‘পারি’র চরিত্রটাই বেছে নিই। আমার সিদ্ধান্ত শুনে লীনাদি আশ্চর্য ভাবে হেসেছিলেন। সেই হাসিটা আমি কোনও দিনও ভুলব না।
পত্রিকা: ‘পারি’র চরিত্রটা গড়ে তোলার জন্য হোমওয়ার্ক করেছেন?
অপরাজিতা: কোনও হোমওয়ার্কই কাজে দেয়নি। অনেক ভেবেছি কাজটা নিয়ে শ্যুটিংয়ের আগে। কিন্তু যে দিন পরিচালক ‘অ্যাকশন’ বললেন, সে দিন যেমন অভিনয় করলাম, তার সঙ্গে আমার আগের ভাবনাচিন্তার কোনও মিলই রইল না। পারির অঙ্গভঙ্গি কেমন হবে? কথা বলার ধরন কেমন হবে? সবটাই সেটে গিয়ে ‘অ্যাকশন’ বলার সঙ্গে সঙ্গে তাৎক্ষণিক ভাবে ঠিক হল। আমি ওই সব লোকজন, স্ক্রিপ্ট, সেট, এ সব না থাকলে কিছুতেই পারির অভিনয়টা করে দেখাতে পারব না।
পত্রিকা: হোমওয়ার্কের কথাটা উঠল কারণ আপনি নিশ্চয়ই কাজ করার আগে অটিস্টিক মানুষজনকে নিয়ে স্টাডি করেছেন? পারি কিন্তু ‘পারমিতার একদিন’-এর সোহিনী সেনগুপ্তর মতো নিজের সবটুকু হারিয়ে ফেলা মেয়ে নয়। সে মাঝে মধ্যে এমন সব সত্যি কথা বলে ফেলে যা সাধারণ মানুষ বাস্তব সংসারে দাঁড়িয়ে সচরাচর উচ্চারণ করতে পারবে না।
অপরাজিতা: আমি এই রকম মানুষ মিট করেছি, যাঁরা সব চেতনা থাকা সত্ত্বেও সুরে কম বলে। মনের বয়স শরীরের বয়সের চাইতে কম। কিন্তু তাঁদের প্রভাব আমার এই অভিনয়ে পড়েনি। পারি-কে গড়ে তোলার সত্তর ভাগ কৃতিত্ব স্ক্রিপ্টের। বাকি কৃতিত্ব আমার এবং অন্য কুশীলবদের।
পত্রিকা: নিশ্চয়ই আপনার ভক্তরা পারির চরিত্রে আপনাকে দেখে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছেন?
অপরাজিতা: হ্যাঁ, তা তো করেছেনই। সে দিন সাউথ সিটিতে গিয়েছি শপিং করতে। এক বয়স্কা মহিলা প্রশংসা করতে করতে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে লাগলেন। পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ওঁর ছেলে। তিনি বললেন, “আমাদেরও আপনার অভিনয় ভাল লাগে। কিন্তু এ ভাবে তো প্রকাশ করতে পারি না।” আমার গুরুদেবের অনেক কৃপা যে মানুষের এত ভালবাসা পেলাম।
|
|
পত্রিকা: আপনার গুরুদেব কে? দীক্ষা নিয়েছেন নাকি?
অপরাজিতা: গুরুদেবের নাম বলতে পারব না। তবে আমি দীক্ষিতা। রোজ জপতপ প্রাণায়াম করে শ্যুটিংয়ে বেরোই।
পত্রিকা: বছর পনেরো হল অভিনয় করছেন। বেশ কিছু বাংলা ছবিতেও কাজ করেছেন। তবু বাংলার দর্শক আপনাকে কেন শুধু টেলিভিশনের সুঅভিনেত্রী হিসেবেই জানে?
অপরাজিতা: আমার অনেক পছন্দ, অপছন্দের ব্যাপার আছে। একটা সময় ছিল মাঝে মাঝেই নায়িকা হওয়ার অফার আসত। কিন্তু চিত্রনাট্য পড়ে দেখতাম সেখানে নায়িকা বা অভিনেত্রী হিসেবে আমার করণীয় কিছু নেই। দ্বিতীয় কথা নায়িকা হতে গেলে যে ধরনের গড়ন, বা চেহারা হওয়া দরকার, সেটা আমার ছিল না। সব রকম পোশাকে আমাকে মানাবার কথা নয়। বড় পরদায় মনের মতো সুযোগ আসবে না এটা আমি ধরেই নিয়েছিলাম। সেই জন্যই চেয়েছিলাম ছোট পরদাতেই ভাল অভিনয় করব। মানুষ যাতে মনে রাখে।
পত্রিকা: তা হলে টিভির কাজগুলোই আপনার কাছে স্মরণীয় হয়ে রইল?
অপরাজিতা: অবশ্যই। এত সংখ্যক দর্শক দেখেছেন। প্রশংসা করেছেন। স্মরণীয় হয়ে থাকবে না? ‘এক আকাশের নীচে’র মীনাক্ষী, ‘তমসারেখা’র দিবা সেন, ‘কুরুক্ষেত্র’-র অনন্যা গুহ, ‘গানের ওপারে’-র রানি, ‘মা’ ধারাবাহিকের মণি সকলের মনে থাকবে বলেই মনে হয়। আমার তো মনে থাকবেই।
পত্রিকা: ইদানীং তো অন্য রকম বাংলা ছবি হচ্ছে। সেখানে কাজ করার ইচ্ছে নেই?
অপরাজিতা: আছে বলেই ‘ল্যাপটপ’য়ে অভিনয় করেছি। ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘শুভ মহরৎ’ আর ‘চিত্রাঙ্গদা’য় কাজ করেছিলাম। অঞ্জন দত্তের ‘ম্যাডলি বাঙালি’তে কাজ করেছি। সে সব তো কত আগে থেকেই। আমার কথা হল রোল মাপে ছোট হলে ক্ষতি নেই। কিন্তু চরিত্রের মধ্যে যেন অভিনয় করার মতো উপাদান থাকে। ‘গয়নার বাক্স’তে কঙ্কনার বড় জায়ের রোলটা করে খুব ভাল লেগেছিল। ইদানীং বেশ কয়েকটা নতুন ধারার ছবিতে কাজ করলাম। ‘চলো পটল তুলি’, ‘দূরবীন’, ‘আমি সায়রাবানু’ তার মধ্যে পড়ে। এগুলো এখনও রিলিজ করেনি।
পত্রিকা: ঋতুপর্ণ ঘোষের নজরে পড়েছিলেন কী ভাবে?
অপরাজিতা: ‘এক আকাশের নীচে’তে যখন কাজ করতাম, তখনই ঋতুদা আমাকে প্রথম দেখেছিলেন। ‘শুভ মহরৎ’ ছবির আগে একদিন সুদেষ্ণাদি (রায়) বলল, ঋতুদা আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। আমি এক ঘণ্টা দেরি করে ওঁর বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছিলাম। উনি বলেছিলেন, “তুই কি এই রকম দেরি করে শ্যুটিংয়ে আসবি নাকি?” আমি বেশ ক্যাটক্যাটিয়ে বলেছিলাম ‘দেরি তো হতেই পারে। কোনও কারণে আটকে গেলে?’ ঋতুদা বলেছিলেন, ‘ফোন তো করা যায় দেরি হলে’, তার পর বলেছিলেন ‘বড় খড়খড়ি মেয়ে তো তুই। মুখে একটা মারব।’ ঋতুদার শাসন, স্নেহ সবই খুব মনে পড়ছে আজকাল। অমন স্নেহময় মানুষ খুব কম হয়। অনেক সময় অভিনয় নিয়ে সাজেশন চেয়েছি। পেয়েওছি। তা আমার জীবনের পাথেয় হয়ে থাকবে। উল্টোপাল্টা পোশাক পরলে খুব রেগে যেতেন। বলতেন, “পাশবালিশের মতো হাত। তার ওপরে বিদঘুটে ব্লাউজ পরা!’ এই রকম কত কথা যে মনে পড়ছে। ‘চিত্রাঙ্গদা’য় মালা চরিত্রটা করার সময় জিজ্ঞেস করেছিলাম চরিত্রটা কেমন? ঋতুদা বলেছিলেন, “তোর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা যেমন, চরিত্রটা তেমনই।’ খুব সহজে বুঝিয়ে দিতেন সব কিছু।
পত্রিকা: ‘গানের ওপারে’র রানি করার সময় নিশ্চয়ই এই যোগাযোগ আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছিল?
অপরাজিতা: তা হয়েছিল। কিন্তু ঋতুদাকে যখন জিজ্ঞেস করতাম এই জায়গাটা একটু দেখিয়ে দাও না, বলতেন, “তুই পারবি। আমাকে জিজ্ঞেস করবি না তো। আমি তা হলে ফ্লোরেই আসব না।’’
পত্রিকা: এ রকম একজন মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আরও বেশি সুযোগ চাননি কেন?
অপরাজিতা: আমি বলতাম তো আমাকে বড় রোল দাও না কেন ঋতুদা? ঋতুদা বলত, “ছোট রোলই মন দিয়ে করো না।”
পত্রিকা: তা হলে আপনি যা পেয়েছেন তাই নিয়েই বেশ খুশি?
অপরাজিতা: তা অনেকটাই খুশি। মানুষ তো আমার অভিনয় মনে রাখে।
পত্রিকা: আপনাকে দেখে কিন্তু বেশ গিন্নিবান্নি মনে হয়। বাড়ির কাজকর্ম, লৌকিকতাএ সব করেন? নাকি কেবল শ্যুটিং নিয়েই...
অপরাজিতা: আমি গুছিয়ে সংসার করতে ভালবাসি। ইচ্ছে হলে রান্না করি। ইচ্ছে হলে ঘর সাজাই। কোনও চাপ নেই আমার উপর। সংসারে অধিকারের জোরের চেয়ে ভালবাসার জোর অনেক বেশি সেটা আমরা জানি। যৌথ পরিবারে স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ-দেওর, দিদিশাশুড়ি, ননদের বাচ্চা, সব নিয়ে একসঙ্গে হই হই করে বাঁচি। আমার নিজের এখনও পর্যন্ত সন্তান নেই। ননদের ছেলেই আমার ছেলে। তিন জন পাতানো মেয়ে আছে। তাদের সব আবদার-আহ্লাদ আমার কাছে, আমার স্বামীর কাছে। খুব ছোট বয়সে বিয়ে হয়েছে। আমার নিজের মা যদি দেবকী হন, তো শাশুড়ি-মা হলেন যশোদা। শাশুড়ির কাছে সংসার সম্পর্কে অনেক কিছুই শিখেছি। আমার জীবনে ওঁর অবদানের তুলনা নেই।
পত্রিকা: টিভিতে সিরিয়াল দেখার অভ্যেস আছে?
অপরাজিতা: রাতে নিজের অভিনয়ের সিরিয়াল দেখি। নিজের ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার জন্যই। অন্যদের অভিনয়ের সিরিয়ালও দেখি। তাতে অনেক কিছু শেখা যায়।
পত্রিকা: ‘কুরুক্ষেত্র’ সিরিয়ালে আপনাকে এক প্রতিবাদী নারী হিসেবে দেখা যায়। নারী হিসেবে আপনি কতটা প্রতিবাদী?
অপরাজিতা: দারুণ প্রতিবাদী। কোনও অন্যায়, সে বাড়িতে হোক বা বাইরে কাজের জগতেপ্রতিবাদের আওয়াজটা প্রথম আমিই তুলি। কোনও অন্যায়ের সঙ্গে আপস করা আমার স্বভাবে নেই। সে জন্য অনেক সময় নিজের আবেগকেও সংযত করতে হয়। আবেগ সংযমে রাখব তাও ভাল, কিন্তু আপস করব না।
|
সাত কাণ্ড |
• যে স্বপ্ন দেখতে চাই: খাঁটি মানুষ হওয়ার স্বপ্ন
• যে ছবি করতে চাই: ‘কুরুক্ষেত্র’ সিরিয়ালটা যদি ছবি হয়
• যা কিছু ভয় পাই: গুরুজনদের সম্মান নষ্ট হওয়া
• যাকে কাছে পেতে চাই: আমার নিজের মা, আর আমার শাশুড়ি
• যা হারালে দুঃখ পাই: মেজাজ হারালে
• যেখান থেকে পালাতে চাই: পরনিন্দা পরচর্চা
• যে দুঃখ ভুলতে চাই: দুঃখ ভুলতে চাই না |
|
|
|
|
|
|