হাঁড়ির খবর
টাকরায় সামার স্পেশাল
নালের বাইরে উঁচু তাকে থরে থরে বয়াম-বন্দি আচার-কাসুন্দি-মোরব্বা। তখন দুপুর মানেই এমন অধরা সব শৃঙ্গজয়ের লগ্ন। আজকের নাগরিক-জীবনে সেই শৈশব ক্রমশ দুর্লভ। জয়মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায় সেটা জানেন। ওল্ড বালিগঞ্জের বোহেমিয়ান-এ তাঁর হেঁসেলে তবু সেই দিনগুলোই যেন ফিরে ফিরে আসে।
যেমন চিরকেলে কুলের আচার ও জারক লেবুর পুনর্জন্ম। কুলের একটা অব্যর্থ ইংরেজি নাম দিয়েছেন শেফ জয়। বেঙ্গলবেরি। শুনে বাঙালির বুকটা হু-হু করে। সরস্বতী পুজোর কথা, আরও কত কী মনে পড়ে! গ্রীষ্ম মানেই সঞ্চিত গুড়কুল তারিয়ে তারিয়ে চাখার আস্বাদ। কালচে টক-মিষ্টি কুলের আচারের পসরা ঘাড়ে নিয়ে গলিতে বা স্কুলের গেটে হজমিওলার ডাকেই দুপুরের আবহ-সঙ্গীত। বেঙ্গলবেরি নামটায় সে সব মুহূর্ত জ্যান্ত হয়ে ওঠে। ধনে-জিরে-লঙ্কা-তেঁতুলের মিশেলে মশলাদীপ্ত কুলের আচার দিয়ে মৌলিক ভেটকির পদেই তাঁর কেরামতি দেখিয়েছিলেন জয়। এই গ্রীষ্মে তাঁর উপহার, গ্রিল্ড চিকেনে বেঙ্গলবেরি ম্যারিনেড। তা সে যতই কালো হোক, কালোরঙা কুলের আচারের চটপটা প্রলেপ গায়ে মেখে চিকেনের ফালি অনন্য। দারুণ স্নিগ্ধ একটা স্টার্টার।
জারক লেবুর স্বাদকে মেন কোর্সে আবাহনের কেরামতিও কম কীসে! কাঁটাবিহীন কাঁচালঙ্কা-পার্শের পদের সঙ্গে জারক লেবু সুরভিত একটা বিশেষ ভাতের আয়োজন করে বোহেমিয়ান। তাদের নতুন সৃষ্টি— ডাবের শাঁস, নারকোলের দুধের থকথকে ঝোলে হলুদবরণ চিংড়িতে জারক লেবুর সৌরভ। নেবুর টকটার নিখুঁত ব্যালেন্স। সর্ষের তেল-কাঁচালঙ্কাও একটু পড়েছে। নিরামিষখোরদের জন্য এই গ্রেভিতেই আলু, কুমড়ো, বরবটি, পটল, লাউয়ের তরকারি।
জিভের টাকরায় মাখার লোভনীয় সব আচার নিয়ে এমন নানা নিরীক্ষাই এখন বাঙালি রেস্তোরাঁর সিলেবাসভুক্ত। ওহ্ ক্যালকাটা-র কুমড়োপাতা আম-আচার দিয়ে ইলিশ, লাউপাতা আমতেলের ইলিশ কিংবা রসুনের আচারস্নাত ভেটকি টিক্কা তো কবেই রসিকমনের ‘হল অফ ফেম’-এ ঢুকে পড়েছে। কোনও কোনও শেফ বলেন, আলু-ফুলকপি দিয়ে ঝোলের বদলে গরমে আচারের ফুলকপি দিয়ে মাছের ঝোলটাও বেড়ে হয়! শুনে শোভাবাজার রাজবাড়িতে নন্দিনী দেববৌরানির সিগনেচার আচারি ট্যাংরার কথা মনে পড়ল। জিরে-ধনে-সর্ষে-পোস্তর সঙ্গে আমতেলের জড়ামড়িতে বড় বড় ট্যাংরা এক বার খেলে ভোলা যাবে না!
এই আচার-বিলাসের পাশেই ঘুরে-ফিরে থাকছে ঝিঙে, লাউটাউ দিয়ে আদা-মৌরির স্নিগ্ধ দোলন, প্রাণ আকুল করা টক ডাল বা হাল্কা জিরেবাটা দিয়ে মাছের ঝোল। প্রখর গ্রীষ্মে পোলাও-কালিয়া-কষাকে পিছনে ঠেলে জিভের সূক্ষ্ম তারের এমন সব নির্ভার সৃষ্টিও রেস্তোরাঁয় কুলীনের মর্যাদা পাচ্ছে। এত দিন ইটিং আউটে ঠান্ডা ঠান্ডা খেতে চাইলে আমরা চিনে খাওয়ার কথা ভাবতুম। কিন্তু এখন নির্ভয়ে বাঙালি খাবারের দিকে ঝোঁকা যায়।
ভাবতে অবাক লাগে কী করে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট-বালিগঞ্জে কস্তুরী-র এই অবিস্মরণীয় পদটি এত দিন খেয়াল করিনি। ভাঙাচোরা শুক্তো। এই শুক্তোয় তেঁতো নেই। প্রধানত ঝিঙে ও কিছুটা কাঁচা পেঁপে, কাঁচকলা, বেগুন, আলু, থোড় (বাঙালবুলিতে ভারালি) বিশেষ ভাবে কোটা হয়। আর চরিত্র বলতে একটু আড়মাছের কাঁটা-মুড়ো, দু’চারটে বিক্ষিপ্ত চিংড়ি, ছিটেফোঁটা হলুদের ছোঁয়া, রাঁধুনি-ঘিয়ের হাল্কা সুঘ্রাণ। কস্তুরি-র কর্ণধার বাবলু সাহা বলেন, “এ এমন রান্না, যেখানেই খাই মুখে দিলে ঠিক বুঝে যাব কোনও ঢাকাই মাইয়ার সৃষ্টি!” মেছোস্পর্শেও শুক্তোর নির্ভার পবিত্রতা নষ্ট হয়নি, এমন শুক্তো সত্যিই আশ্চর্য।
বাঙালি মননের এ সব সামার ক্লাসিকের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই এখন নিত্যনতুন সৃজনশীলতার ঢল নেমেছে। ওহ্ ক্যালকাটা-য় গন্ধরাজ ভেটকি বা ডাবের ভাপা সন্দেশের হাত ধরে এই সমকালীন বাঙালি খানার জয়যাত্রার শুরু। বোহেমিয়ান-এ পটলের মহিমা অনুভব না করলেও জীবনে ফাঁক থেকে যাবে। ছোট ছোট গালাওটি কাবাবের মতো দেখতে ও বস্তুটি যে পটলের প্যাটি তা না বললে ধরতেও পারতুম না। বাঙালিঘরের প্রায় বিস্মৃত পটলের খোসাবাটা কি লাউবাটা-শিমবাটাকে শেফ জয়ের কুর্নিশ। খোসাসুদ্ধ বাটা পটলের এই টিকিয়ায় বাংলার পাড়াগেঁয়ে তুলসিপাতার ঝাঁঝালো বুনো স্বাদও মিশেছে। তার সঙ্গে মেক্সিকান সালসার আদলে টমেটো, কাঁচালঙ্কা, ধনে, রসুন, সর্ষের তেলের একটা আচার।
পোষ মানা পর্ক-মাটন কিংবা তরমুজের সেই পদটিও অগ্রাহ্য করার নয়। বোহেমিয়ান-এ পাকা আমযোগে মাটনের কাইময় রসালো হিমসাগরের নির্যাসের আলিঙ্গন। সর্ষের তেলযোগে হিং পড়ে তাতে সামান্য বীররসের সঞ্চার। কলাপাতায় মুড়ে ভাপানো পর্ক-পদটি অতীব হাল্কা। কাঁচা হলুদ, কাসুন্দি, ধনে-ডাঁটির গন্ধে মহিমামণ্ডিত চর্বিবিহীন পর্ক-ফালির ফ্লেভার। রেড মিটের ক্যালরি-ধারণের দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে মাংসপ্রেমীদের জন্য পাপস্খালনের একটি অভিনব ব্যবস্থাও রয়েছে। বাঙালি গ্রিল্ড তরমুজ। পার্ক হোটেলের জেন বা আফরা-য় তরমুজের কোল্ড সুপ কিংবা স্যালাডের রকমফের ঢের চাখা হয়েছে। কিন্তু একটু লেবু-নুন-লঙ্কাবাটা মাখা তরমুজ যে কতটা মোক্ষম হতে পারে, তা না খেলে বোঝা যাবে না। অতি সাবধানে গ্রিল করতে হয়। প্যানটা আগে থেকেই তাতিয়ে রাখা। ফলে, মশলা মাখা তরমুজ মাত্র কয়েক সেকেন্ড আঁচে রাখলেই তৈরি। জয় সতর্ক, এর বেশি ক্ষণ গ্রিল করলে তরমুজের বরতনুর আঁটোসাঁটো ভাবটা থসথসে হয়ে যাবে। এই তরমুজের উপরে পুদিনা মাখা একটু ইয়োগার্টের মুকুট। পুদিনার আরামটুকু গরমের পরম প্রাপ্তি। রেড মিটে কব্জি ডুবনোর আগে এই তরমুজে বুঁদ হয়ে গ্লানিমুক্ত হওয়া যায়।
ক’বছর আগে গরমে মেনল্যান্ড চায়না তেলবিহীন স্টার ফ্রায়েড আম-চিকেন বা লিচু-চিংড়িতে সাড়া ফেলেছিল। ওহ্ ক্যালকাটা শসা দিয়ে মুরগি, ইলিশ উপহার দেয় আকছারই। বোহেমিয়ান-এও এমন হাল্কা ফ্লেভারময় পদের ছড়াছড়ি। লিচুঠাসা চিকেনের স্টু বা ভেটকির আদা-মৌরির ঝোলে মৌরিপাতার উপস্থিতি বড়ই রমণীয়। ও হ্যাঁ, ঘরোয়া মৌরি-মিছরির জলটাও তো বাদ পড়েনি। তবে সরবত নয়, এ বার সে সর্বে (sorbet)। ফরাসি কায়দায় বিভিন্ন পদ চাখার ফাঁকে টাকরা মেজে নেওয়ার উপকরণ। কী শীত, কী গ্রীষ্ম, নতুনের মোড়কে এমন পুরনোর স্বাদ-গন্ধে মনটা স্বভাবতই কেমন পিছলে পিছলে যায়!

ছবি: শুভেন্দু চাকী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.