|
|
|
|
|
|
ব্যাগ গুছিয়ে... |
বরফ জমা সারা হলে...
ভোরে ঘুম ভাঙতেই চমকের চূড়ান্ত। মেঘের ঘনঘটা উধাও।
কাচের
জানলায় বরফমোড়া প্রকৃতি। পাহাড়চুড়োয় সোনা
রোদের ঝিলিক।
লেখা ও ছবি পার্থসারথি মুখোপাধ্যায় |
|
|
গোঁ গোঁ শব্দে ট্যুরিস্ট-বোঝাই গাড়িটা দ্রুত চলছে এঁকেবেঁকে। কখনও পাহাড়ের কোল ঘেঁষে, কখনও বা হাড় হিম-করা খাদের ধার বরাবর। হেডলাইটের জোরালো আলো হারিয়ে যাচ্ছে তীক্ষ্ণ বাঁকে। পিছনে গাড়ির সারি। প্রবল দুর্যোগ মাথায় নিয়ে গ্যাংটক থেকে সাতসকালে বেরিয়েছি। পাহাড়ে এখন সন্ধে ছাড়িয়ে রাত। গাড়ির কাচ তোলা। তবু ঠান্ডা হাওয়া ঢুকছে, বিঁধছে সূচের মতো। ড্যাশবোর্ডের হালকা আলোয় দৃশ্যমান সদ্য টিন-এজ উত্তীর্ণ নেপালি চালক ভাবলেশহীন। হঠাৎ হেডলাইটের এক ঝলক আলোয় ধরা পড়ল রাস্তার ধার-বরাবর ছেঁড়া সাদা কাপড়ের মতো বিক্ষিপ্ত কিছু পড়ে রয়েছে। কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা। তার পরেই গাড়ির মধ্যে সমস্বরে উল্লাস! বরফ! বরফ! এ যাবৎ বাড়ির রেফ্রিজারেটর আর বাজারে মাছওয়ালার সৌজন্যেই বরফ দেখে এসেছি। এই প্রথম বার দেখলাম প্রকৃতিদেবীর সৌজন্যে, তাও আবার গ্রীষ্মের শুরুতেই!
গ্যাংটক থেকে অনেক দূরে এসে পড়েছি। বরফ-ঢাকা মাইলস্টোনে ‘লাচুং’ তখনও তিন কিলোমিটার। অন্ধকার পাহাড়ি রাস্তায় সেনা জওয়ানদের এক-আধটা গাড়ির আনাগোনা। রাস্তায় জমে-থাকা বরফের পরিমাণ দ্রুত বাড়ছে। বেশ খানিকক্ষণ চলার পরে গতিরোধ। সামনে খানকয়েক গাড়ির সারি।
|
|
চালক কাচ নামাতেই নেপালিতে উত্তেজিত কথাবার্তা। এটুকু বোঝা গেল, বরফে গাড়ি আটকেছে। এগোতে গিয়ে সামান্য স্লিপ করতে শুরু করেছে আমাদের গাড়িও। সর্বনাশের চূড়ান্ত। শেষমেশ চালক ও সেনা জওয়ানদের তৎপরতায় বিপদ থেকে রেহাই। মিনিট দশেক পরেই নামতে হল। বাইরে আলো-আঁধারিতে দেখি, রাস্তা জুড়ে শুধুই বরফ। চলার রাস্তা বন্ধ। জানা গেল, এটাই লাচুং।
মোবাইলের ঘড়িতে তখন সাড়ে সাতটা। চালকের তাগাদায় গাড়ি থেকে নামতে গিয়েই পা পিছলে আলুর দম। কাঠের সিঁড়ির গোটা চারেক ধাপ শক্ত বরফের নীচে। কোনও মতে টাল সামলে মালপত্র নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে। কাঠের ঘর। তিন দিন ধরে প্রবল দুর্যোগে বিদ্যুৎ বিদায় নিয়েছে অনির্দিষ্ট কালের জন্য। দুর্যোগ থামলে তবেই ফিরবে। সংলগ্ন বাথরুম নির্জলা। শৌচালয়ে ব্যবহারের জন্য হোটেলে এক বালতি জল চাইতে গিয়ে হাসির খোরাক হতে হল। জল! সে তো খাওয়ার জন্য লাগে! ভাবখানা এমন।
‘দাঁড়ান। আগে খাবার জলের ব্যবস্থা করি, তার পরে দেখছি’, নেপালি হোটেল-মালকিন বললেন। হোটেল ঠিক নয়, আসলে হোম-স্টে। জানা গেল, আচমকা দুর্যোগে নেহাতই আপৎকালীন ব্যবস্থা করা হয়েছে সেনাবাহিনীর সহায়তায়। জনা-চল্লিশ ট্যুরিস্টের জন্য নির্ধারিত হোটেলটি এখনও প্রায় আধ কিলোমিটার ওপরে। আপাতত প্রাণ বাঁচাতে এ ছাড়া আর উপায় ছিল না। বাইরের কলে জল পড়ছিল তখনও। হাত দিয়ে বুঝলাম ঠান্ডা কাকে বলে। সবাই মিলে হাত লাগিয়ে সেখান থেকেই বাথরুমের জন্য কিঞ্চিৎ জল সংগ্রহ করলাম। ততক্ষণে তেষ্টা মেটাতে হাজির বেশ কয়েক বোতল গরম জল। মিলল চা, কফি, দু’মিনিটের ইনস্ট্যান্ট নুডল্স, থুকপা। ঘরে আলোর একমাত্র উৎস মোমবাতি।
|
|
অপরিসর বারান্দায় গুটিকয়েক পর্যটক। অন্ধকারেই বরফের গোলা নিয়ে খেলায় মাতলেন কেউ কেউ। পাশের ঘরে অন্যরা ব্যস্ত ক্যান্ডল লাইট পার্টিতে। চাঁদ মুখ ঢেকেছে মেঘের আড়ালে। হঠাৎই শুরু হল বরফ পড়া। হালকা পেঁজা তুলো নেমে আসছে আকাশ থেকে। সঙ্গে জোরালো হাওয়া। ক্লিক, ক্লিক। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলসাচ্ছে। দিনে যদি বরফ না পড়ে! তাই রাতের সুযোগ ছাড়তে রাজি নয় কেউ।
পাল্লা দিয়ে বাড়ল বরফ। নীচে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির ছাদ কিছুক্ষণের মধ্যেই সাদা। বরফের আস্তরণ সর্বত্র। ঠান্ডা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। পারদ নেমেছে মাইনাস সেভেনে। রাত গড়িয়ে এগারোটা। বিশ্বচরাচর ঘন অন্ধকারের ঘোমটায়। নাগরিক সভ্যতা-বর্জিত নিস্তব্ধ প্রকৃতি আপন খেলায় মেতেছে। প্রতি নিঃশ্বাসে ফুসফুসে জমেছে ঠান্ডা। বহু দূরে পাহাড়ের গায়ে হালকা আলোর ফোঁটা। বিদ্যুৎহীন বাড়িতে মোমবাতি জ্বেলেছে কেউ। অপার্থিব অনুভূতি। ধোঁয়া-ওঠা গরম ভাত, পেঁয়াজ দিয়ে ডাল, সামান্য আলুভাজা আর মাছের ঝোল দিয়ে ক্যান্ডল লাইট ডিনার। সাড়ে ন’হাজার ফুটে ঘনঘোর দুর্যোগে আশাতীত আতিথেয়তা। খাওয়া শুরু করতে না করতেই জুড়িয়ে জল। ততক্ষণে বরফপাত থেমেছে। পরদিন সকালে ইয়ুমথাং যাওয়া অসম্ভব, জানিয়ে দিল আমাদের চালক। গ্যাংটক ফিরতে হবে এখান থেকেই। অদৃষ্টকে গাল পেড়ে সোজা বিছানায়। বিদ্যুৎহীন ঘরে রুম হিটার থেকেও নেই। উলিকট, জামা, ডবল পুলওভার, মোটা জ্যাকেট, হাতে পায়ে মোজা, মাথায় টুপির ওপর তিন খানা জাবদা কম্বল চাপিয়েও রেহাই মিলল না। নিরন্তর হি-হি। দাঁতে খিল।
ভোরে ঘুম ভাঙতেই চমকের চূড়ান্ত। মেঘের ঘনঘটা উধাও। কাচের জানলায় বরফমোড়া প্রকৃতি। পাহাড়চুড়োয় সোনা রোদের ঝিলিক। পাইন বনে বরফের ঘোমটা। রাস্তায় বরফমোড়া গাড়ি। বরফের রাজ্যে সব কিছু একাকার। শিশুর সারল্যে ব্যস্ত ট্যুরিস্টদের দল। বরফজুতো পরে বরফকেলি। হাঁটু-ডোবা বরফে প্রবল লম্ফঝম্ফ। সেনা জওয়ানদের আনাগোনা। ধবধবে সাদা পাহাড়ের মাথায় আবছা ধোঁয়ার মুকুট। পাহাড়ের খাঁজে রংবেরঙের বাড়ি। ঝুপ ঝুপ শব্দে বাড়ির চাল থেকে পড়ছে ঝুরো বরফ। গোলাপি গাল আর খুদে চোখের নেপালি শিশুর চোখে অপার বিস্ময়। বরফ গলিয়ে কুলকুল বইছে লাচুং নদী। দিগন্তজোড়া উপত্যকা। সুইজারল্যান্ড কিংবা কানাডার পরিচিত দৃশ্য। নদীর ধারে ঝাঁক বেঁধে স্ট্যাচু হয়ে চমরি গাইয়ের পাল। ইন্দো টিবেটান বর্ডার ফোর্সের জওয়ানরা ব্যস্ত বরফ সরাতে। হাত লাগিয়েছেন স্থানীয়রাও। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের বেশ কয়েক ডিগ্রি নীচে। বেলা এগারোটা। চালক তাড়া লাগান। রাস্তা খারাপ। গ্যাংটক পৌঁছতে বিকেল হয়ে যাবে। থুকপা আর ডিম-পাউরুটি সহযোগে জলযোগ সেরে বিদায়ের পালা। ইয়ুমথাং যাওয়ার চেষ্টা করলে হত না? এক সেনা জওয়ান মাথা নেড়ে বলেন, প্রাণে বাঁচতে চাইলে নীচে নামতে হবে। আজ দুপুর থেকেই ফের বরফ পড়বে। উপদেশ শিরোধার্য। ইয়ুমথাং, জিরো পয়েন্ট অদেখাই থেকে গেল এ যাত্রা। বদলে যা দেখলাম, নিশ্চিত ভাবেই মনের মণিকোঠায় রেখে দেওয়ার মতো। বিদায় লাচুং!
|
|
কী ভাবে যাবেন |
গ্যাংটক থেকে ইয়ুমথাং যাওয়ার রাস্তায় এক রাত লাচুং-এ কাটিয়ে পরদিন
খুব সকালে ইয়ুমথাং,
জিরো পয়েন্ট। বেলা বাড়লে ইয়ুমথাং থেকে গ্যাংটকের
পথে।
গ্যাংটক থেকে দূরত্ব প্রায় ১২০
কিলোমিটার।
গ্যাংটকের হোটেল
থেকেই
লাচুং-ইয়ুমথাং ট্যুর ও হোটেলের ব্যবস্থা করা হয়। |
কোথায় থাকবেন |
কয়েকটি হোটেল ও হোম-স্টে রয়েছে এখানে। প্রতিটি হোটেলেই রয়েছে
ইয়ুমথাং ও জিরো পয়েন্ট দর্শনের জন্য প্যাকেজ ট্যুরের ব্যবস্থা। |
মনে রাখবেন |
মার্চের মাঝামাঝি থেকে জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পাহাড়ঘেরা লাচুং-এ বরফ সাধারণত
থাকে না।
লাচুং থেকে আর একটু এগোলে ১১ হাজার ফুট উঁচুতে ইয়ুমথাং।
গরমকালে ফুলের দুনিয়া, শীতকালে বরফের। |
|
|
|
|
|
|