টাওয়ার অব লন্ডনে যে ভ্রমাত্মক তথ্য আজও থেকে গিয়েছে সেই তথ্য অনুযায়ী মহারানি ভিক্টোরিয়াকে কোহিনুর উপহার দিয়েছিলেন পঞ্জাবের মহারাজা রঞ্জিত সিংহ। ঐতিহাসিক সত্যতা হল, কোহিনুর মোটেও উপহার দেওয়া হয়নি। ব্রিটিশরা লুঠ করেছিল!
ক্রিকেট-কোহিনুর ভারত থেকে সমর্পণের ব্যাপারে অবশ্য কোনও ঐতিহাসিক অস্বচ্ছতা নেই। প্রায় দু’বছর আগে অগস্টের অভিশপ্ত তেরো তারিখে ভারত সেটা তুলে দেয় ব্রিটিশদের হাতে। যার নাম আইসিসি-র এক নম্বর টেস্ট র্যাঙ্কিং। অভিশপ্ত সেই টিমের দুই মহাতারকা সদস্য আপাতত নিউ ইয়র্কে। পরিবার সমেত ছুটি কাটাচ্ছেন। একজন উঠেছেন নিউ ইয়র্ক সেন্ট্রাল পার্কের পাশে প্লাজা হোটেলে। আর একজন ম্যানহ্যাটনের অ্যাপার্টমেন্টে। বিশ্ব র্যাঙ্কিং রক্ষায় দু’জনেই মহাতাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা নেবেন মনে করা হয়েছিল। আর দু’জনেই চরম হতাশ করেন। আন্দাজ করার চেষ্টা করছি, মার্কিন সময় শুক্রবার রাতে ম্যানহ্যাটনের ফিফথ অ্যাভিনিউ বা ফিফটি নাইন্থ স্ট্রিটের মোড়ে যদি হঠাৎই দেখা হয়ে যায় সচিন তেন্ডুলকর আর বীরেন্দ্র সহবাগেতাঁরা পরস্পরকে কী বলবেন: সেই এজবাস্টন! আবার! তোর হোটেলে কেবল টিভিতে আসছে তো?
সাদা বাংলায় ঐতিহাসিক লজ্জায় গুঁড়ো হয়ে যাওয়া মসনদে শনিবার ভারত নামছে চিরশত্রু ক্রিকেট দেশের বিরুদ্ধে। পয়েন্ট তালিকা নীরবে যা-ই বলার চেষ্টা করুক, তাকে নীরব থাকতে বলাই ভাল! লোকেশন, প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ক্যাটক্যাটে রুক্ষ এই সময় অর্থহীন ম্যাচটাকেও মহাব্যঞ্জনার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে! |
অসম্ভব নিরাপত্তা ম্যাচ ঘিরে। অবশ্য এই অভিব্যক্তিটা ভারত-পাক ম্যাচে অতীতে নিশ্চয়ই দশ লাখ বার লেখা হয়ে ক্লিশে হয়ে গিয়েছে। ভবিষ্যতে আরও এক কোটি বার হবে। কিন্তু এ বারের স্পট ফিক্সিং অধ্যুষিত সময়ে নিরাপত্তার প্রেক্ষিতটাই আলাদা। এজবাস্টনে এ দিন পাকিস্তান নেট প্র্যাক্টিসে দেখলাম ফ্যানরা দাঁড়িয়ে অটোগ্রাফ নেওয়ার সময়ও গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সিকিউরিটি। একটা বাড়তি কথা অনুরাগীদের বলার উপায় নেই। তার আগেই তাকে এক রকম ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বার্মিংহ্যামের হায়াত রিজেন্সি হোটেলে উঠেছে দু’টো টিম। যুক্তরাজ্যে লন্ডনের পরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরের সবচেয়ে হুল্লোড়ে এলাকা। নাইট ক্লাব, ডিস্কো, পাবে ভর্তি। রাত্তিরে অর্ধনগ্ন গায়িকা বারের বাইরে মাইক্রোফোন হাতে। মহিলারা পথচারীকে রাস্তায় কার্ড গুঁজে দিচ্ছে পাশের জেন্টলম্যানস ক্লাবে গভীর আমন্ত্রণবার্তা জানিয়ে। টিম হোটেল থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকটা ঘুরলেই ‘ওয়াক অ্যাবাউট বার’। যাকে বিশ্বখ্যাত করে দিয়েছে ডেভিড ওয়ার্নারের বাঁ হাত। পাব-কর্মীরা গত ক’দিনে সমানে ইন্টারভিউ দিতে দিতে এখন ওস্তাদ হয়ে গিয়েছেন। পানশালার ভেতর ঢুকে ডান দিকে একটা উঁচু জায়গায় ভিআইপি অতিথিদের বসার ব্যবস্থা। অ্যাসেজ-প্রতিদ্বন্দ্বী দু’দেশের ক্রিকেটারদের সে দিন রাত দু’টোর সময় এখানেই বসানো হয়েছিল এবং আপাতত বার্মিংহ্যামের পয়লা নম্বর ট্যুরিস্ট স্পট!
কিন্তু সেখানে তো বাদই দিলাম। গোটা তল্লাটে কোনও ক্রিকেটারের দেখা নেই। টিম হোটেলের লবিতে অবধি বিশেষ কেউ নামছেন না। ব্রেকফাস্ট অর্ধেক টিম খাচ্ছে নিজের ঘরে বসে। সন্দেহের মারাত্মক দূষণের সময়ে এমনিতেই কেউ ঝুঁকি নিতে চায় না। ভারত-পাক হলে তো আরওই না।
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে আজ পর্যন্ত ভারত হারাতে পারেনি পাকিস্তানকে। যেমন বিশ্বকাপে পাকিস্তান বারবার হেরেছে। কিন্তু পরিবর্তিত এই সময়ে ইতিহাস মনে হচ্ছে না প্রাসঙ্গিক হবে বলে! কত কিছুই তো বদলে গিয়েছে দু’বছরের মধ্যে। বার্মিংহ্যামের সেই অভিশপ্ত টেস্টে ভারত যখন খেলছিল, তখন ইংল্যান্ডের উন্নত শিল্পশহর দাঙ্গা-হাঙ্গামায় বিপর্যস্ত। অপরিচিত লুঠেরারা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল শহরের নানা অংশ। যা টিভিতে দেখে ভয়ার্ত হয়ে পড়ে গোটা ভারতীয় দল। সুরেশ রায়না আতঙ্কে টুইট অবধি করে ফেলেছিলেন। এজবাস্টন মাঠের তিন কিলোমিটারের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা হয়। যেখানে পশ্চিম বার্মিংহ্যামের ডাডলি রোডে মধ্যরাতে লুঠতরাজ প্রতিরোধ করতে যাওয়া জনতার বুকের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিয়েছিল কৃষ্ণাঙ্গ জামাইকানরা। তিন মুসলিম তরুণ তাতে ডাডলি রোডের পেট্রোল পাম্পের ধারে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এ বার ‘ওয়াক অ্যাবাউট বারে’ অজি-অসভ্যতা নিয়ে যেমন ব্রিটিশ মিডিয়ার অহর্নিশি প্রচার! সে বার তেমনই ট্র্যাজেডির শেষ স্টেশন হিসেবে চিহ্নিত ছিল ডাডলি রোডের দু’টো লাইটপোস্ট।
জায়গাটা সরেজমিন দেখেছিলাম সে বার ফুলের তোড়ায় তোড়ায় ঢেকে যাওয়া সরু লাইটপোস্ট ঢেকে শুধু ফুল আর ফুল। এ দিন এজবাস্টন মাঠে পৌঁছনোর ফাঁকে সেখানেই গিয়ে দেখলাম কী বিবর্ণ চেহারা পোস্টটার। বিশেষ ভাবে কোনও নামকরণ হয়নি। বিজ্ঞপ্তিও নেই। কেবল লাইটপোস্টের ডান্ডায় ঝুলছে শুকনো কিছু তোড়া। পাকিস্তানি ট্যাক্সিচালক গাড়িটা পাশে দাঁড় করিয়ে দুঃখ করলেন, “ওই যে তোড়াগুলো কিছু কিছু এখনও সরানো হয়নি সেটাই বোধহয় শ্রদ্ধা। মানুষ চলে যায়। আবার মানুষই সেটা ভুলে যায়।”
দু’বছর সত্যিই অনেকটা সময়। নইলে যে ভারতীয় ব্যাটিং সে দিন বিবর্ণ, কঙ্কালসদৃশ হয়ে সচিন সমেত অসম্মানিত হচ্ছিল। আজ তারাই টুর্নামেন্টে দু’টো ম্যাচের পরে কী অভ্যর্থনা পাচ্ছে! রোহিত শর্মার ফিটনেস পরীক্ষা হচ্ছে কি হচ্ছে না, সেটা নিয়েও কত জল্পনা। মনে হচ্ছে যেন তিনিই সহবাগ। আর বিকেলবেলা প্রেসবক্সে দুই পাকিস্তানি সাংবাদিকের ঝগড়া শুনে বেশ মজাই লাগল। একজন বলছেন, শিখর ধবন হায়দরাবাদের প্লেয়ার। আর একজন বলছেন, দিল্লির। প্রথম জন রীতিমতো দাবড়ানি দিলেন, “আইপিএল ভুলে গেলি? দেখিসনি ডেকানের হয়ে ওকে খেলতে?” শুনলাম আইপিএল পাকিস্তানে জনপ্রিয় শুধু নয়, প্রসিদ্ধ। পাক সাংবাদিকেরা বলছিলেন, “জাতীয় নেশাই যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে টিভিতে আইপিএল দ্যাখো আর ফোনে বেট লাগাও।”
বার্মিংহ্যাম স্টেশন থেকে বার হতেই ল্যাডব্রোকসের বিশাল অফিস। যেখানে বৈধ বেটিং হয়। অনুমান করছি পাক-ভারত ম্যাচের আগে আবহাওয়া নিয়েও না সেখানে একপ্রস্ত বেটিং হয়। যা চিরকাল হয়ে থাকে। আর বার্মিংহ্যামের এমন অনিশ্চিত আকাশব্যবস্থায় তো আরওই হবে। একবার রোদ্দুর উঠছে। পরক্ষণেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নেমে যাওয়া ঠান্ডা। খাতা-কলমে ১০/১১ ডিগ্রি। কিন্তু এই রকম হাওয়া চলছে বলে শহরে কানঢাকা টুপির দোকান খোঁজাটা এমন আবশ্যিক। দীনেশ কার্তিকদের শনিবার শুধু পাকিস্তান পেস বোলিং নয়, এই ঠান্ডাটাও খেলতে হবে। এজবাস্টন মাঠ এ দিন অনেক সুনসান। ওয়ারইকশায়ার কাউন্টির কাউকে জিজ্ঞেস করার মতো পেলাম না, আচ্ছা এখানে ব্রায়ান লারার ৫০১ নিশ্চয়ই এত ঠান্ডায় হয়নি!
ঠান্ডা থেকে এ বার গরমে আসা যাক। আইসিসি-র সূচি অনুযায়ী শনিবার ইংল্যান্ড সময় সকাল সাড়ে দশটা থেকে ভারত বনাম পাকিস্তান। তৃতীয় কোনও অংশগ্রহণকারী দলের কথা আইসিসি লেখেনি। যা কোহিনুর ব্রিটেনের রানিকে উপহার দেওয়ার মতোই ভ্রমাত্মক।
সর্বসমক্ষে না হলেও আবহে কাল আরও একটা শক্তিশালী ম্যাচ হচ্ছে। আর গোটা টুর্নামেন্ট ধরেই বোধহয় চলবে। ধোনি বনাম ভারতীয় মিডিয়া!
বিলেতে ম্যাচটা নতুন নয়। বছর চারেক আগে দেশজ মিডিয়াকে চরম অশ্রদ্ধা করে গোটা টিম সমেত সাংবাদিক সম্মেলন থেকে ওয়াকআউট করেছিলেন ধোনি। ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে যা ছিল অভূতপূর্ব। কিন্তু এ বারের সংঘাতের চেহারাটা যেন আরও নগ্ন। এই নিয়ে টানা দু’দিন হিন্দিতে সাংবাদিক সম্মেলন করতে অস্বীকার করলেন ভারত অধিনায়ক। যা তিনি আইসিসি-র মিডিয়া-নীতি অনুযায়ী করতে পারেন না। প্রেস কনফারেন্সে এ পর্যন্ত তাঁর শরীরী ভাষা যথেষ্ট জেদি, অভিমানী এবং রাগত। বিশ্বপর্যায়ের টুর্নামেন্টে আগাগোড়া স্বদেশি মিডিয়ার সঙ্গে ভারত অধিনায়কের কুসম্পর্কের একটাই নজির আছে। পঁচাশির বেনসন হেজেস ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে সুনীল গাওস্কর।
ওই টুর্নামেন্টটার ঠিক আগে ঘরের মাঠের ইংল্যান্ড সিরিজে তীব্র মিডিয়া সমালোচনা-বিদ্ধ গাওস্কর সিদ্ধান্ত নেন, আর কখনও দেশের অধিনায়কত্ব করবেন না। ট্রফি জিতে উঠেও নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন।
সে বার বেনসন হেজেস কাপ কভার করতে যাওয়া আনন্দবাজার গোষ্ঠীর প্রয়াত এক ক্রিকেটলিখিয়ের সঙ্গে গাওস্করের কথোপকথনটা খুব ইন্টারেস্টিং ছিল।
ক্রিকেটলেখক: ক্লাইভ লয়েড অবাক হয়ে গ্যাছেন। বলছেন এত ভাল ক্যাপ্টেন্সি করল। ট্রফি জিতে কেন ছাড়ছে?
গাওস্কর: লয়েড তো স্রেফ বড় ক্রিকেটার। মিডিয়া নয়। ক্রিকেটার আবার ক্রিকেটের কী বোঝে?
ধোনি অভিমানী হয়ে নেতৃত্ব ছাড়ার বান্দা নন। কিন্তু গ্রুপ অব ডেথ থেকে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদেরও হারিয়ে ত্রুটিহীন সেমিফাইনালে উঠলে অবশ্যই মনে মনে ভারতীয় মিডিয়াকে পাকিস্তানের হারটা উৎসর্গ করবেন! ওরা তো ভারতীয় মিডিয়া। ভারত জিতলে ওদের কী!
মিলেজুলে দাঁড়াল, ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত। সরি, বার্মিংহ্যামে রোদ্দুর উঠুক না উঠুক, ঘটনার ঘনঘটা আর তাৎপর্যে সেই জঙ্গি ভারত-পাক! |