গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রকাশ পাল • চুঁচুড়া |
ব্যাগে বিস্তর কাগজপত্র নিয়ে থানায় যাচ্ছিলেন তারাপদ দলুই।
“শাসকদলের লোকজন মারধর করছে, পাট্টা কেড়ে নিচ্ছে, ঘর করছি বলে টাকা চাইছে”— হাঁপাতে হাঁপাতে বলে চলেন মাঝবয়সী লোকটি। নিবাস শ্রীপুর গ্রাম, খানাকুল ২ ব্লক, আরামবাগ মহকুমা, জেলা: হুগলি।
ওদের নিশ্চয়ই ভোট দেবেন না? হাঁপাতে হাঁপাতেই হেসে ফেলেন তারাপদবাবু— “ভোট! এখানে ভোট হয় না কি? এক পক্ষ তো জিতেই গিয়েছে।” একটু থেমেই যোগ করেন, “আগেও অবশ্য এমনটাই হত। শুধু রংটা বদলেছে।”
এ রাজ্যে পরিবর্তনের হাওয়া ওঠার আগে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামেরও আগে একচ্ছত্র বাম জমানায় যে শেষ পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছিল, সেই ২০০৩ সালে জেলার গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে প্রায় ৪১ শতাংশ আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দখল করে বামেরা। পঞ্চায়েত সমিতিতেও প্রায় ৪২ শতাংশ আসনের হাল একই। হুগলি জেলা পরিষদেও ২৫ শতাংশের বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। এবং বামফ্রন্টের হয়ে এই সব আসনের সিংহ ভাগই দখল করে সিপিএম।
এই ধারারই প্রতিফলন দেখা যায় পরের বছর লোকসভা নির্বাচনে। যে বার আরামবাগ আসনে ৫ লক্ষ ৯৯ হাজার ভোটে জিতে গোটা দেশে রেকর্ড করেন সিপিএমের অনিল বসু (অধুনা বহিষ্কৃত)। বুথের পর বুথে বাম-বিরোধীদের ভোট ছিল শূন্য। এই নিয়ে তোলপাড় হলেও তদানীন্তন শাসক গোষ্ঠীর কিছু যায়-আসেনি। ২০০৬ সালে সিঙ্গুরে জমি-আন্দোলনের হাত ধরে রাজ্য রাজনীতিতে নতুন শক্তি নিয়ে উঠে আসে তৃণমূল। দু’বছর বাদে সিঙ্গুর ব্লকে ১৬টি পঞ্চায়েতের ১৫টিই জিতে নেয় তারা। তবু সেই ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনেই গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদ স্তরে যথাক্রমে প্রায় ২৬, ২৭ ও ১৫ শতাংশ আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতে বামফ্রন্ট। |
রাজ্যে পরিবর্তনের পরে বহু এলাকায় সিপিএম তথা বামফ্রন্টের দাপট কার্যত ভোজবাজির মতোই উড়ে গিয়েছে। বিশেষ করে গোঘাট, খানাকুল, আরামবাগের মতো ‘লাল সন্ত্রাসে’র এলাকায়। বরং সে সব জায়গায় এখন লালঝান্ডা খুঁজে পাওয়াই দায়। গোঘাটে যে অভয় ঘোষ নামে যে সিপিএম নেতার নামে বাঘে-গরুতে জল খেত, নানা মামলায় জেলে ঘুরে এসে তিনি আপাতত বেপাত্তা। শ্রীঘরে রয়েছেন আরামবাগের প্রাক্তন সাংসদ বিনয় দত্ত। খানাকুলে বংশীবদন মৈত্রের মতো নেতারা হয় ঘরে ঢুকে গিয়েছেন অথবা ঘরছাড়া। জমি ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা ক্রমশ ঘোরালো হলেও সিঙ্গুর অন্তত এখনও বেচারাম মান্নাদের পাশেই আছে। এই অবস্থায় তৃণমূল যে গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদ স্তরে যথাক্রমে প্রায় ৩৮, ৩৬ ও ১৪ শতাংশ আসন বিনাযুদ্ধে দখল করবে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।
জেলা প্রশাসনের হিসেবে, তারকেশ্বরে গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৪৪টি আসনে ১০২টিতে তৃণমূল প্রার্থীরা ভোটের আগেই জিতে গিয়েছেন। ধনেখালিতে ২৬৪টি আসনে ২২৩টি এবং জাঙ্গিপাড়ায় ১৭৭টি আসনের মধ্যে ১৪৮টি পঞ্চায়েত আসনেও তা-ই। আরামবাগেও ২২১টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসনের মধ্যে ১৮১টি ইতিমধ্যে তাদের পকেটে। ধনেখালিতে পঞ্চায়েত সমিতির ৫২টি আসনের মধ্যে ৪২টিতে প্রার্থী দিতে পারেনি বামেরা। জাঙ্গিপাড়ায় ৩০টি আসনের মধ্যে দিতে পেরেছে মাত্র চারটিতে।
জেলার একেবারে প্রান্তিক এলাকা খানাকুল তো যাকে বলে রেকর্ড করেছে। খানাকুল ১ এবং ২ ব্লকে ২৪টি পঞ্চায়েতে মোট আসন ৩৩৭টি। তার একটিতেও তৃণমূল ছাড়া কেউ প্রার্থী দিতে পারেনি। পঞ্চায়েত সমিতির ৭০টি আসনের মধ্যে মাত্র একটিতে এবং জেলা পরিষদের ৬টি আসনের মধ্যে দু’টিতে প্রার্থী রয়েছেন। তবে কেউ সিপিএম বা কংগ্রেসের নন।
সিপিএমের জেলা সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরীর অভিযোগ, “চতুর্দিকে তৃণমূলের বাহিনী সন্ত্রাস চালিয়েছে। কিন্তু আরামবাগ-হরিপালের মতো কিছু জায়গায় পুলিশ সরাসরি রাস্তায় নেমে ওদের মদত দিয়েছে।” যদিও পুলিশ এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। তৃণমূলের জেলা সভাপতি তপন দাশগুপ্ত পাল্টা বলেন, “সাড়ে তিন দশক ধরে সিপিএমের টানা সন্ত্রাসের দগদগে ঘা হুগলির মানুষের মনে এখনও টাটকা। তাই ওরা প্রার্থী পায়নি।”
সিপিএমের খানাকুল জোনাল সম্পাদক মণীন্দ্র রানার দাবি, “যত অত্যাচার হচ্ছে, থানায় তত অভিযোগ জানানো যাচ্ছে না। তাতে অত্যাচার আরও বাড়বে।” খানাকুলের তৃণমূল বিধায়ক মহম্মদ ইকবালের টিপ্পনী, “ও সব হুমকি-মারধরের কথা তো সাজানো। মনোনয়ন দাখিল করতে প্রার্থী ছাড়াও দু’জন প্রয়োজন হয়। সিপিএমের লোক কই!”
দীর্ঘ আড়াই বছর ঘরছাড়া খানাকুলের সিপিএম কর্মী রবি মোল্লার গলায় ঝরে পড়ে আফশোস— “মা মৃত্যুপথযাত্রী। ঘরে ফিরতে পারছি না। মেয়ের বিয়েতেও বাড়ি যেতে পারিনি। আমাদের নিশ্চিত কিছু ভুল ছিল। কিন্তু তৃণমূলও তো সেই একই ভুল করছে!” |