এ রাজ্যে আশ্রয় নিতে চান শীর্ষ নেতারা
ত্তীসগঢ়ের হামলার পরে দণ্ডকারণ্য-বস্তার জুড়ে মাওবাদী দুর্গে কেন্দ্রীয় বাহিনী ও রাজ্য সরকারের সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছে। সেই চাপের মুখে মাওবাদীরা ছত্তীসগঢ় থেকে পালিয়ে ঝাড়খণ্ড হয়ে পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে এসে আশ্রয় নিতে চাইছে। ছত্তীসগঢ়-ঝাড়খণ্ড-ওড়িশা, এই তিনটি রাজ্যের সীমানাবর্তী যে এলাকা, সেখানে একটি মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলার চেষ্টা করছে মাওবাদীরা। তার পরে সেই মুক্তাঞ্চলটিকেই ছত্তীসগঢ় থেকে পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলে আসার করিডর হিসেবে ব্যবহার করতে চায় তারা। ঝাড়খণ্ডে যে হেতু রাষ্ট্রপতি শাসন চলছে, তাই সেখানে যৌথ বাহিনীর অভিযানের চাপে মাওবাদী নেতাদের গা ঢাকা দিয়ে থাকা মুশকিল। শুধু পশ্চিমবঙ্গে ঢোকা নয়, পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে রাজ্যে বিরোধী দল সিপিএমের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করতেও মাওবাদীরা মরিয়া।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “মাওবাদীদের এই রণকৌশলের জন্যই আমরা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ঝাড়খণ্ডের সীমানা সিল করে দিতে কেন্দ্রের কাছে আবেদন করেছি। সিপিএম ও মাওবাদী মিলিয়ে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছে। তবে আমার আশা, সাধারণ মানুষ এতে প্রভাবিত হবেন না। কারণ আমরা তাঁদের জীবিকা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবার দিকগুলিতে অগ্রাধিকার দিচ্ছি।”
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রের খবর, পশ্চিমবঙ্গে ঢোকার চেষ্টা ছাড়াও পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে নাশকতারও ছক কষছে তারা। তা হলে জঙ্গলমহলে প্রবল চাপের মধ্যে থাকা মাওবাদীরা নিজেদের সাফল্য দাবি করতে পারে। এই বিষয়ে ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব ও রাজ্য পুলিশের ডিজি-কে সতর্ক করেছে কেন্দ্র। কারণ শুধু জঙ্গলমহল নয়, গোটা দেশেই মাওবাদী সংগঠনের মধ্যে একটা হতাশা তৈরি হয়েছে। পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয়
কমিটির বহু নেতা হয় মারা গিয়েছেন, নয় তো জেলে। যাঁরা বাইরে রয়েছেন, তাঁদের অনেকেই অথর্ব। পার্টি কংগ্রেস না হওয়ার ফলে শীর্ষ কমিটিতে নতুন নেতা নির্বাচনও হয়নি। এই পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতের রণকৌশল কী হবে, তা নিয়েও মাওবাদী নেতৃত্বের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। অন্ধ্রের নেতা এবং অন্ধ্রের বাইরের নেতাদের মধ্যেও পুরনো বিবাদ তুঙ্গে। এর পাশাপাশি ছত্তীসগঢ়ে গত এক বছর ধরে মাওবাদীরা কোণঠাসা। তেমন বড় কোনও হামলা বা নাশকতা ঘটাতে পারছিল না তারা। ফলে মাওবাদী সংগঠনের নিচুতলাতেও হতাশা তৈরি হচ্ছিল। এর মধ্যে অনেকেই আত্মসমর্পণ করছেন। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, অতীতেও দেখা গিয়েছে, যখনই মাওবাদীদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়, তারা নৃশংস কোনও ঘটনা ঘটায়। রাজনৈতিক নেতা বা সাধারণ মানুষের মতো সহজ নিশানা বেছে নেয়। এ বারেও প্রথমে ছত্তীসগঢ়ে কংগ্রেস নেতাদের উপর হামলা, পরে বিহারে যাত্রিবাহী ট্রেনের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে তারা। গোয়েন্দারা আরও বলছেন, নিরাপত্তা বাহিনীর উপরে হামলার থেকে এই ধরনের হানা সরকার তথা পুলিশ-প্রশাসনে বেশি কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়।
গোয়েন্দা-কর্তারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ঝাড়খণ্ড থেকে মাওবাদীদের পশ্চিমবঙ্গে ঢোকার অর্থ এই নয় যে, শরণার্থীর মতো দলে দলে মাওবাদী ক্যাডার জঙ্গলমহলে ঢুকে পড়বে। মূলত মাওবাদী সংগঠনের শীর্ষনেতারাই জঙ্গলমহলে ঢুকে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করবেন। এর পিছনে মূলত আত্মরক্ষার চেষ্টা রয়েছে বলেই মনে করছেন গোয়েন্দারা। কারণ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পরিকল্পনা অনুযায়ী, মাওবাদী সংগঠনের প্রধান গণপতি থেকে শুরু করে দলের শীর্ষ নেতাদেরই এখন বেছে বেছে নিশানা করা হবে। কাজেই ছত্তীসগঢ়ের ডেরাগুলি মাওবাদীদের কাছে আর ততটা নিরাপদ নয়। আবার ঝাড়খণ্ডে রাষ্ট্রপতি শাসন চলছে। তাই সেখানে এমনকী লাতেহারের মতো এলাকাতেও সমস্যা তৈরি হয়েছে। তাই ছত্তীসগঢ়-ওড়িশা-ঝাড়খণ্ডের সীমানাবর্তী এলাকা দখল করার চেষ্টা চালাচ্ছে মাওবাদীরা।
কয়েক বছর আগে লালগড় আন্দোলন যখন তুঙ্গে, সেই সময়েই পশ্চিমবঙ্গ থেকে ছত্তীসগঢ় পর্যন্ত জঙ্গলপথে তাঁরা একটি করিডর তৈরি করে ফেলেছেন বলে দাবি করেছিলেন কিষেণজি। গোয়েন্দাদের সন্দেহ, সেই করিডরটাই এখন নিয়মিত ব্যবহার করতে চাইছে মাওবাদীরা। আর সে জন্য ছত্তীসগঢ়-ঝাড়খণ্ড-ওড়িশার সীমানা যেখানে এসে মিশেছে, সেখানে মুক্তাঞ্চল তৈরি করা জরুরি তাদের কাছে। এই এলাকাটি দখলে থাকলে ছত্তীসগঢ়ের দণ্ডকারণ্য বা অবুঝমাঢ় থেকে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত লম্বা করিডর ব্যবহার করা সহজ হবে। যে পথ ধরে একেবারে অন্ধ্র থেকে ছত্তীসগঢ়, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, বিহার হয়ে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত মাওবাদীদের যাতায়াতের কোনও অসুবিধা হবে না।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্তার বক্তব্য, “মাওবাদী নেতা অরবিন্দজি এবং প্রশান্ত বোস ওরফে কিষাণদা ইতিমধ্যেই ঝাড়খণ্ডের লাতেহারে গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছেন বলে রিপোর্ট মিলেছে। এই অরবিন্দজির পরিকল্পনাতেই কিছু দিন আগে এক নিরাপত্তা বাহিনীর জওয়ানের মৃতদেহের মধ্যে আইইডি লুকিয়ে রেখেছিল মাওবাদীরা। এই দু’জনকে ঘিরে চারটি বলয়ে মাওবাদীদের নিরাপত্তা রয়েছে। অরবিন্দজির হাঁটাচলার ক্ষেত্রে অসুবিধা রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। তাকে জঙ্গলের রাস্তায় পিঠে করে বয়ে বেড়ানোর জন্যও কয়েক জন ক্যাডার নিযুক্ত করা হয়েছে। প্রশান্ত বোসের শরীরের অবস্থা আরও খারাপ। তাকে মূলত ঘোড়ার পিঠে চাপিয়েই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়।”
ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহ বলেন, “মাওবাদীদের এই পরিকল্পনা সম্পর্কে আমরা অবহিত। সিআরপিএফ ও রাজ্যের পুলিশ বাহিনীকে নামিয়ে আমরা মাওবাদীদের প্রতিহত করার চেষ্টা করছি। কিন্তু এখানে কংগ্রেস বনাম বিজেপি এই রাজনীতির ঊর্ধ্বে ওঠার প্রয়োজন রয়েছে।” একই ভাবে পশ্চিমবঙ্গেও তৃণমূল বনাম সিপিএম রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে মাওবাদীদের নতুন পরিকল্পনার মোকাবিলা করা প্রয়োজন বলে গোয়েন্দা-কর্তারা মনে করছেন।
পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদীরা সিপিএমের সঙ্গে হাত মেলানোর চেষ্টা করছে কেন? নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাওবাদীরা বরাবরই বিরোধী পরিসরটা দখল করতে চায়। এই কারণেই মহারাষ্ট্রে তারা বিদর্ভ রাজ্যের দাবিকে সমর্থন করে এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বিরোধী-নেত্রী ছিলেন, তখন নন্দীগ্রাম থেকে শুরু করে জঙ্গলমহলে তৃণমূলকে মদত দেয় বলে অভিযোগ।
ওই নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা আরও দাবি করেছেন, তখন শাসক দল সিপিএমের স্থানীয় অফিসগুলি থেকে পুলিশকে মাওবাদীদের গতিবিধি জানিয়ে খবর পাঠানো হতো। শান্তি কমিটি তৈরি করে সিপিএম মাওবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজ করত। সে জন্য বহু সিপিএম নেতা-কর্মীকে মাওবাদীদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। এখন কিন্তু সিপিএমের সেই সব কাজকর্ম বন্ধ। উল্টে পঞ্চায়েত ভোটে তারা অনেক জায়গায় পক্ষে বারবার অভিযোগ করা হচ্ছে। তাই স্থানীয় স্তরে তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে মাওবাদীরা তাদের প্রকাশ্য সংগঠন বা মাওবাদী দরদীদের প্রার্থী হিসেবে খাড়া করতে চাইছে। তবে তাঁদের সঙ্গে মাওবাদীরা যোগাযোগের চেষ্টা করছে, এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নীলোৎপল বসু বলেছেন, “আমরাই তো ওদের (মাওবাদীদের) বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলাম। ওদের আঁতাঁত ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে। আমাদের সঙ্গে মাওবাদীরা যোগাযোগ করতে চাইবে কেন?”
গোয়েন্দা সূত্রে আরও বলা হচ্ছে, জঙ্গলমহলে নাশকতা চালানোর ক্ষেত্রেও মাওবাদীরা সম্ভবত একটি কথা এখন মাথায় রাখবে। তা হল, সাধারণ মানুষ যেন তাদের উপরে নতুন করে আর বিরূপ না হয়। পশ্চিমবঙ্গে তাদের নিশানা হবে মূলত যৌথ বাহিনী এবং তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা।
পঞ্চায়েত ভোটে অংশ গ্রহণের চেষ্টা মাওবাদীদের কাছে নতুন কিছু নয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সূত্র বলছে, গত বছর ওড়িশায় পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ও মাওবাদীরা এমন চেষ্টা করে আংশিক সাফল্যও পেয়েছিল। গোয়েন্দাদের অনুমান, মালকানগিরি ও কোরাপুটের ৩০টি ব্লকের পঞ্চায়েত মাওবাদীদের দখলে। কিন্তু ওই সব এলাকায় বিরোধীদের সঙ্গে হাত মেলাতে হয়নি তাদের। কারণ মাওবাদী-আতঙ্কে অন্য কোনও দল সেখানে প্রার্থী দেয়নি। আগেভাগেই নির্বাচন বয়কটের ডাক দিয়েছিল মাওবাদীরা। তাই তাদের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই জিতে যায়।
পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য মাওবাদীদের পক্ষে তা সম্ভব হবে না বলেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তাদের বিশ্বাস। এ বিষয়ে তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একমত। কেন্দ্রের নকশাল দমন বিভাগের কর্তাদের বক্তব্য, জঙ্গলমহলে এই মুহূর্তে হাতে গোনা কিছু মাওবাদী নেতা সক্রিয়। যাঁদের মধ্যে রয়েছেন আকাশ, বিকাশ, রঞ্জিৎ পাল, মদন মাহাতো, জয়ন্ত পাল, বিকাশের স্ত্রী তারা এবং শ্যামলের মতো কয়েক জন। তাই জঙ্গলমহলে মাওবাদীরা ভোট বয়কটের ডাক দিলেও তার খুব বেশি প্রভাব পড়বে না বলেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তাদের বক্তব্য।
তবে পঞ্চায়েত ভোট বয়কট বা নাশকতার চেষ্টা সফল হোক বা না হোক, মাওবাদী শীর্ষ নেতাদের আসল লক্ষ্য কিন্তু অন্য। তাঁরা এখন চাইছেন রাজ্যের মাওবাদী নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে জঙ্গলমহলে আস্তানা নতুন করে গড়ে তুলতে। আর সে জন্যই ছত্তীসগঢ়-ঝাড়খণ্ড-ওড়িশার সীমানাবর্তী এলাকায় মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলতে মরিয়া তারা।

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.