বাঙালি জওয়ান-সহ হত তিন |
ভরদুপুরে যাত্রীবোঝাই ট্রেনে নির্বিচার গুলি মাওবাদীদের
নিজস্ব প্রতিবেদন |
ফের মাওবাদী হামলার নিশানায় রেল। এ বার বিহারের জামুই জেলায়। বৃহস্পতিবার দুপুরে ধানবাদ থেকে পটনাগামী ইন্টারসিটি এক্সপ্রেসে মাওবাদী হামলায় তিন জন নিহত হয়েছেন। নিহত তিন জনের মধ্যে এক জন বাঙালি আরপিএফ জওয়ান রয়েছেন। তাঁর নাম সুকান্ত দেবনাথ। বাকি দু’জনের এক জন পুলিশের সাব-ইনস্পেক্টর ও এক জন যাত্রী। জখম হয়েছেন দুই রেল কর্মী-সহ
পাঁচ জন। |
|
ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িশায় রেললাইন বা রেলের কেবিন বিস্ফোরণে উড়িয়ে একাধিক বার রেল পরিষেবা থমকে দিয়েছে মাওবাদীরা। ঝাড়খণ্ডের লাতেহার-সহ কয়েকটি জায়গায় গোটা ট্রেন ‘হাইজ্যাক’ করার একাধিক নজিরও রয়েছে তাদের। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা হামলার সময় বেছে নিয়েছে রাতের অন্ধকারকে। এ দিন ভরদুপুরে পটনা থেকে ১২০ কিলোমিটার আগে যে ভাবে ট্রেন থামিয়ে মাওবাদীরা হামলা চালাল, তার উদাহরণ খুব বেশি নেই বলেই জানাচ্ছেন বিহার পুলিশের কর্তারা। তার উপর যে ভাবে যাত্রীদের কামরা লক্ষ করে বাইরে থেকে তারা গুলি চালিয়েছে, তা রেল মন্ত্রকের কাছে যথেষ্ট উদ্বেগের।
সপ্তাহ তিনেক আগেই, গত ২৫ মে ছত্তীসগঢ়ে কংগ্রেসের একটি মিছিলে হামলা চালিয়ে রাজ্য স্তরের একাধিক প্রথম সারির নেতাকে খুন করে মাওবাদীরা। সেই ঘটনার পরে মাওবাদী অধ্যুষিত রাজ্যগুলিকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। সেই মতো বিভিন্ন এলাকায় বাড়ানো হয় নিরাপত্তাও। কিন্তু তার পরেও এমন ঘটনায় উদ্বেগ বাড়ছে সরকারের অন্দরে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আর পি এন সিংহ জানান, মাওবাদীরা যে ভাবে যাত্রী ট্রেনকে নিশানা করছে, তাতেই স্পষ্ট, ওরা কতটা মরিয়া হয়ে উঠেছে।
পুলিশের একাংশের অনুমান, এ দিন মাওবাদীদের উদ্দেশ্য ছিল আরপিএফ জওয়ানদের কাছ থেকে তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলি লুঠ করা। যাত্রীদের কয়েক জন পরে জানান, মাওবাদীরা কামরায় উঠে আরপিএফের জওয়ানদের খুঁজছিল। যদিও এমন অভিযোগও শোনা গিয়েছে যে, মাওবাদীরা কয়েক জন যাত্রীর জিনিসপত্র লুঠ করেছে। |
|
মাওবাদী হামলায় নিহত বিহার পুলিশের কর্মী অমিত কুমার। ছবি: মণীশ সিন্হা। |
মাওবাদী হামলার পরে এ রাজ্যের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে এ দিন দুপুরে মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র, স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং স্বরাষ্ট্র দফতরের সচিব (কো-অর্ডিনেশন) পি নীরজনয়ন জরুরি বৈঠকে বসেন। স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রে খবর, জামুইয়ের ঘটনার জেরে এ রাজ্যের সব জেলা ও রেল পুলিশের সব থানায় সতর্কতা জারি করা হয়েছে। জঙ্গলমহল এলাকায় রাতের ট্রেন চলাচলের ব্যাপারে রেল বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। রাতের ট্রেনে গার্ড ও চালকের কামরায় আরপিএফ মোতায়েন করা হয়েছে। জঙ্গলমহলের স্টেশনগুলিতে নিরাপত্তাও বাড়ানো হয়েছে।
মাওবাদী হানায় নিহত আরপিএফ জওয়ান সুকান্ত দেবনাথের বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার গোপালনগর থানার চক-চৌবেড়িয়া গ্রামে। বাবার নাম রতন দেবনাথ। তিনি পেশায় কৃষক। সুকান্তরা এক ভাই ও এক বোন। বছর দেড়েক আগে সুকান্ত চাকরি পেয়েছিলেন। সুকান্তের কাকা গণেশ দেবনাথ রাতে বলেন, “টিভিতে খবর দেখে দুর্ঘটনার খবর জানতে পেরেছি। রাত পর্যন্ত ওঁর বাবা-মাকে বিষয়টি জানানো হয়নি।” |
|
হামলার পর ইন্টারসিটি এক্সপ্রেসের যাত্রীরা। ছবি: পি টি আই। |
নিহত বাকি দু’জন হলেন বিহার পুলিশের সাব-ইনস্পেক্টর অমিত কুমার এবং ট্রেনের যাত্রী শরবর আলম। অমিত জামুইয়ে কর্মরত। তিনি কাজে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। বেসরকারি সংস্থার কর্মী শরবর আলম পূর্ণিয়ার বাসিন্দা। গুরুতর জখম হয়েছেন রেলের জামালপুর ওয়ার্কশপের কর্মী মনোজ কুমার সিংহ। এ ছাড়া, ওই ট্রেনের গার্ড কে পি সিংহ-সহ চার জন আহত হয়েছেন। রেলমন্ত্রী সি পি জোশী জানান, মাওবাদী হামলায় নিহতদের পরিবারকে পাঁচ লক্ষ টাকা, গুরুতর আহতদের এক লক্ষ টাকা এবং অল্প চোট পাওয়াদের ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেবে রেল।
বিহার পুলিশের এডিজি (আইন-শৃঙ্খলা) এস কে ভরদ্বাজ বলেন, “বেলা ১টা ১৫-২০ নাগাদ শ’দেড়েক মাওবাদীর একটি দল ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস থামায়। আধ ঘণ্টা ধরে নাগাড়ে ট্রেন ও যাত্রীদের লক্ষ করে গুলি ছোড়ে তারা। আরপিএফ-এর দুই কর্মীর থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রও লুঠ করে তারা।” জামুইয়ের জেলাশাসক শশীকান্ত তিওয়ারি জানান, হামলার পরে মাওবাদীরা জামুইয়ের জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে বলে খবর। তাদের খোঁজে দু’কোম্পানি সিআরপিএফ পাঠানো হয়েছে। ডিএসপি মহম্মদ আবদুল্লার নেতৃত্বে ওই বাহিনী গোটা এলাকা জুড়ে চিরুনি তল্লাশি শুরু করেছে। জেলাশাসক আরও জানান, কেন্দ্রীয় বাহিনী ও জেলা পুলিশকে আটকাতে জঙ্গলের পথে বিস্ফোরক পেতে রেখেছে মাওবাদীরা। |
|
নামিয়ে আনা হচ্ছে গুলিবিদ্ধ
এক যাত্রীকে। ছবি: পি টি আই। |
রেলের পূর্ব-মধ্য ডিভিশন সূত্রের খবর, ধানবাদ থেকে পটনাগামী ট্রেনটি এ দিন বেলা ১টা ৪ মিনিটে জামুই স্টেশন ছাড়ে। ভালুই স্টেশনের আগে কুন্দের হল্ট স্টেশন পার হওয়ার পরেই চালক দেখতে পান লাইনের উপর মাওবাদীদের একটি দল ট্রেনের দিকে রাইফেল তাক করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাদের অধিকাংশই মহিলা এবং বেশির ভাগেরই বয়স ২০-র নীচে। চালক ট্রেনের গতি বাড়িয়ে পালিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে গতি কমিয়ে দেন। বছর কয়েক আগে ঝাড়খণ্ডের খেলারিতে মাওবাদীরা একই ভাবে ট্রেন আটকালে চালক গতি বাড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পরেই লাইনে পেতে রাখা বিস্ফোরক দিয়ে লাইন উড়িয়ে দেয় মাওবাদীরা। ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়েছিল। সেই ঘটনা মাথায় রেখেই এই ট্রেনের চালক গতি কমিয়ে দেন। মাওবাদীদের কাছাকাছি গিয়ে ট্রেনটি একেবারে দাঁড়িয়ে যাওয়ার পরে রেললাইনের দু’দিকের জঙ্গল থেকে বেশ কিছু সশস্ত্র মাওবাদী বেরিয়ে আসে এবং গোটা ট্রেন ঘিরে ফেলে। এ সময় কয়েক জন ইঞ্জিনের কাচ লক্ষ করে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল থেকে নাগাড়ে গুলি ছুড়তে শুরু করে। তাতে চালক আহত হন। ইতিমধ্যেই আরও কয়েক জন ইঞ্জিনে উঠে দ্বিতীয় চালকের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে ট্রেন ছাড়তে নিষেধ করে। |
|
নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশি।
ছবি: পি টি আই। |
ট্রেনটির দ্বিতীয় চালক রেলের কর্তাদের জানিয়েছেন, প্রথম চালককে জখম করার পরে কয়েক জন গার্ডের কামরার দিকে গিয়ে গার্ড কে পি সিংহকে আটক করে। তাঁকে মারধরও করা হয়। মাওবাদীদের একটি দল এ-১ বাতানুকূল কামরায় উঠে এলোপাথাড়ি গুলি চালায় বলে একটি সূত্রের দাবি। কয়েক জন মাওবাদী ইঞ্জিনের পরের বগিতে উঠে আরপিএফের দুই জওয়ানকে লক্ষ করে গুলি চালাতে
থাকে। গুলিতে মারা যান জওয়ান সুকান্ত দেবনাথ। তাঁর সঙ্গী অন্য এক জওয়ান জখম হন। ট্রেন জুড়ে যখন মাওবাদীদের এই তাণ্ডব চলছে, তার মধ্যেই আসরে নামেন ট্রেনের শেষের দিকের বগিতে থাকা তিন আরপিএফ জওয়ান। তাঁরা মাওবাদীদের লক্ষ করে গুলি ছুড়তে থাকেন। মাওবাদীরাও পাল্টা জবাব দেয়। বেলা পৌনে দু’টো নাগাদ গুলি বিনিময় থামিয়ে মাওবাদীরা জঙ্গলে পালিয়ে যায়। পরে চালক ট্রেনটিকে নিয়ে সাড়ে তিনটে নাগাদ কিউল স্টেশনে পৌঁছন।
জামালপুরের রেল পুলিশ সুপার অমিতাভ দাস বলেন, “দু’পক্ষের মধ্যে কমবেশি দেড়শো রাউন্ড গুলি বিনিময় হয়েছে। মাওবাদীরা দু’টি স্বয়ংক্রিয় রাইফেল লুঠ করেছে।” তিনি জানান, ট্রেন কিউল স্টেশনে পৌঁছনোর পরে গুলিবিদ্ধদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে তিন জনকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। আহতদের
চিকিৎসা চলছে। পূর্ব-মধ্য রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক অমিতাভ প্রভাকর বলেন, “মাওবাদীরা হামলা চালানোর জন্য এ দিন জঙ্গল ও পাহাড় ঘেরা এলাকা বেছে নিয়েছিল। আরপিএফ জওয়ানরা লড়াই চালিয়ে কোনও রকমে যাত্রীদের বাঁচিয়েছেন।”
আসানসোল-দানাপুর-ধানবাদ ডিভিশন সূত্রের খবর, এই ঘটনার পরে ওই শাখায় বেশ কিছু ক্ষণ ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। এ জন্য হাওড়া থেকে ছাড়া এবং হাওড়াগামী একাধিক ট্রেন দেরিতে চলেছে। |
|