|
|
|
|
দর কমছে দলে, মানতে পারছেন না আডবাণী
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
সালটা ১৯৮৯। লোকসভা নির্বাচনের আগের কথা। দিল্লিতে বিজেপি-র শীর্ষনেতাদের বৈঠক বসেছে। সেই বৈঠকে এক দিকে হাজির অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আডবাণী। অন্য দিকে আরএসএস শীর্ষনেতা ভাউরাও দেওরস (সরসঙ্ঘচালক বালাসাহেব দেওরসের সহোদর)। আডবাণীর রামমন্দির আন্দোলন তখন সবে শুরু হয়েছে। দলের জনপ্রিয়তম নেতা তিনিই। বৈঠকে দেওরস বলেন, “বাজপেয়ীজি, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আপনি ভোটে দাঁড়াবেন না। কারণ আপনি ও আডবাণীজি, দু’জনেই ভোটে দাঁড়ালে কে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হবে।”
মুহূর্তের মধ্যে নাটকীয় নিস্তব্ধতা নেমে এল বৈঠকে। এমন একটা নির্দেশ তো বাজপেয়ীর রাজনৈতিক জীবনেও বড় আঘাত। কিন্তু নিস্তব্ধতা কাটিয়ে তিনিই প্রথম মুখ খুললেন। বললেন, “দল যখন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন আমি সর্বান্তঃকরণে তা মেনে চলব।”
১৯৮৯ সালের লোকসভা ভোটে দাঁড়াননি বাজপেয়ী। আডবাণীকেই প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার করে ভোটে গিয়েছিল বিজেপি। কিন্তু সরকার গড়ার মতো আসন জিততে পারেনি তারা। সে বার প্রধানমন্ত্রী হন বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ। তাঁর সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন করেছিল বিজেপি। আর ভোটপর্ব মেটার পরে রাজ্যসভা থেকে জিতে সাংসদ হয়েছিলেন বাজপেয়ী।
তার পরের ইতিহাস সকলেরই জানা। আডবাণীর রথযাত্রা, বিজেপি-র ক্ষমতায় আসা। কিন্তু তত দিনে হাওয়ালা কাণ্ডে নাম জড়িয়েছে আডবাণীর। তিনি সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দেন। পরে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে ফের ফিরে আসেন সংসদে।
কিন্তু এ সবের জেরে তাঁর বদলে বাজপেয়ী হয়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী। আর তাঁর নাম ঘোষণা করলেন আডবাণী নিজেই।
বিজেপি সূত্র বলছে, ১৯৮৯ সালে যে রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা বাজপেয়ী দেখিয়েছিলেন, আজ সেই সহিষ্ণুতা দেখাতে পারছেন না আডবাণী। দল যখন মনে করছে নরেন্দ্র মোদীই তাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা, তাঁকেই প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী করার সিদ্ধান্ত যখন কার্যত হয়েই গিয়েছে, তখন আডবাণী সেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। |
|
সুসময়। এক মঞ্চে আডবাণী, বাজপেয়ী, মোদী। —ফাইল চিত্র |
১৯৯৯ সালে সিপিএম যখন সিদ্ধান্ত নিল যে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে উপমুখ্যমন্ত্রী করা হবে, তখন জ্যোতি বসু কি খুব খুশি হয়েছিলেন? সুভাষ চক্রবর্তী যে ভাবে ওঁর নিজের লোক ছিলেন, তা বুদ্ধবাবু কখনওই হননি। দু’জনের মধ্যে ব্যক্তিত্বের দূরত্ব ছিল, পছন্দ-অপছন্দেরও ফারাক ছিল। কিন্তু দল যখন সিদ্ধান্ত নিল, তখন সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমতকেই জ্যোতিবাবু মেনে নিয়েছিলেন। কাউকে বুঝতেই দেননি, তিনি অখুশি। এমনকী, তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হতে না-দেওয়ার দলীয় সিদ্ধান্তকে ‘ঐতিহাসিক ভুল’ বলেছিলেন অনেক দিন পরে।
আবার জ্যোতিবাবুর দলেরই নৃপেন চক্রবর্তী এই সহিষ্ণুতা দেখাতে পারেননি। পঞ্চাশের দশকে আলিমুদ্দিন তাঁকে ত্রিপুরায় পাঠিয়েছিল সংগঠন করতে। দশরথ দেব ছিলেন উপজাতি নেতা। তাঁর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাঙালি-উপজাতি মিলে অনেক দিন ধরে
দল গড়ে তুলেছিলেন নৃপেনবাবু। মানিক সরকারকে তিনিই তৈরি করেছিলেন। কিন্তু সেই মানিকবাবুই যখন দলের মুখ হয়ে উঠলেন, তখন সেটা মেনে নিতে পারলেন না নৃপেনবাবু। প্রকাশ্যে দলের সমালোচনা করে বহিষ্কৃত হলেন।
একদা নরেন্দ্র মোদীও ছিলেন আডবাণীর স্নেহধন্য। এখন শিষ্যের উত্থানে গুরু অসহিষ্ণু। তবে আডবাণীর জীবনেও যে একটা গভীর বেদনা রয়েছে, সেটা স্বীকার করেন বিজেপি-র নেতারাই। আডবাণীর বয়স এখন ৮৬ বছর। সেই ১৯৮৯ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রীর পদ তাঁকে বারবার হাতছানি দিয়েছে। ১৯৮৯ সালে প্রণয় রায় ‘ইন্ডিয়া ডিসাইড্স’ নামে যে বই প্রকাশ করেছিলেন, তাতে ছায়া-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আডবাণীর বিরাট ছবি ছাপা হয়েছিল। আর বাজপেয়ীর ছবি ছাপা হয়েছিল ছায়া-বিদেশমন্ত্রী হিসেবে, অন্য ছায়া-মন্ত্রীদের সঙ্গে ছোট করে।
কিন্তু এই সম্ভাবনা আডবাণীর জীবনে কখনওই বাস্তব হয়নি। লালুপ্রসাদ ঠাট্টা করে বলেন, আডবাণীর হাতের ভাগ্যরেখায় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ নেই। এই অপ্রাপ্তিই তাঁকে অসহিষ্ণু করে তুলেছে বলে বিজেপি-র অনেকের মত। তাঁদের বক্তব্য, সেটা আডবাণীর শরীরী ভাষাতেও প্রকাশ পায়। তিনি বসে থাকার সময় অনবরত পা-নাচান। সব সময় হাত দু’টো কচলান।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করাটাকে অন্যায় বলে মনে করেন না আডবাণী। চরণ সিংহকে নিয়ে একটা ঘটনার কথা ঘনিষ্ঠ মহলে একাধিক বার বলেছেন তিনি। মোরারজি দেশাইয়ের মন্ত্রিসভায় আডবাণী যখন তথ্যমন্ত্রী, তখন চরণ সিংহের নেতৃত্বে একটা মন্ত্রিগোষ্ঠী গঠন করা হয়েছিল। এক দিন সেই মন্ত্রিগোষ্ঠীর বৈঠকে চরণ সিংহ দেরি করে এলেন। এসে বললেন, ‘এক সাংবাদিকের সঙ্গে ঝগড়া করতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল।’ কী নিয়ে ঝগড়া? ওই সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেছিল, ‘আপনি প্রধানমন্ত্রী হতে চাইছেন কেন?’ চরণ সিংহ তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কি সাংবাদিক থেকে সম্পাদক হতে চান না?’ সাংবাদিকটি বলেন, ‘অবশ্যই। কারণ সেটাই আমার কেরিয়ার।’ চরণ সিংহ তাঁকে বলেন, ‘রাজনীতিটাও আমার কেরিয়ার।’
ফলে প্রকাশ্যে স্পষ্ট করে না বললেও, প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশের নীতি নির্ধারণ করার ইচ্ছে যে আডবাণীর রয়েছে, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। আর এত দিন রাজনীতিতে থাকার পর সেই ইচ্ছার পিছনে কোনও অপরাধ বোধও কাজ করে না তাঁর মধ্যে।
সেই ইচ্ছা পূরণের জন্য নিজের ভাবমূর্তি বদলানোর কঠিন কাজটাও তো আডবাণী করেছেন। ২০০৪ সালে বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হলেন। কারণ তিনিই ছিলেন দলের উদার মুখ। আডবাণী তখন কট্টরবাদী হিন্দু মুখ। এর পর জোট রাজনীতির বাস্তবতা বুঝে ২০০৯ সাল থেকে সেই আডবাণীই উদার মুখ হয়ে ওঠার প্রয়াস শুরু করলেন। কংগ্রেস নেতারা কটাক্ষ করে বলেন, বেড়াল কি কখনও মাছ খাব না বলতে পারে! এর জবাবে আডবাণী-ঘনিষ্ঠরা বলেন, রাজনৈতিক রূপান্তর ঐতিহাসিক সত্য। হ্যারল্ড ল্যাস্কি, বার্টান্ড রাসেল, জাঁ পল সার্ত্র সকলের জীবনেই হয়েছে। বিপ্লবী সিপিএম সংসদীয় সিপিএমে পরিবর্তিত হয়েছে। ১৯৯১ সালের মনমোহন সিংহ আর ২০১৩ সালের মনমোহন সিংহও তো এক নন।
কিন্তু সমস্যা হল, আডবাণী নয়, গোধরা কাণ্ডের পরে কট্টর হিন্দুত্বের ‘পোস্টার বয়’ হয়ে ওঠা মোদীকেই এখন উদার মুখ হিসেবে পেশ করতে চাইছেন মোহন ভাগবত, অশোক সিঙ্ঘলরা। সেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না আডবাণী। তাঁর প্রশ্ন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীতীশ কুমার, নবীন পট্টনায়করা যখন মোদীকে উদার মুখ হিসেবে মানছেন না, তা হলে সেই দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হবে না কেন!
আসলে বিজেপি-র রাজনীতিতে তিনি যে ক্রমশ প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলছেন, সেটাই এখন মেনে নিতে পারছেন না লালকৃষ্ণ আডবাণী।
|
পুরনো খবর: মোদী -প্রশ্নে অনমনীয় সঙ্ঘ, গলল না বরফ |
|
|
|
|
|