|
|
|
|
|
মোদী-প্রশ্নে অনমনীয় সঙ্ঘ, গলল না বরফ
অনমিত্র সেনগুপ্ত • নয়াদিল্লি |
|
ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। হয়ে গেলেন বিক্ষুব্ধ নেতা!
মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছিল বেশ কিছু দিন ধরেই। আজ শুরু হল বৃষ্টিপাত। গোয়ায় বিজেপি জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে নরেন্দ্র মোদীকে নির্বাচনী প্রচার কমিটির প্রধান মনোনীত করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দলের যাবতীয় শীর্ষপদ থেকে ইস্তফা দিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী। চিঠিটা লিখেছিলেন কাল রাত দশটাতেই। আজ সকাল সাড়ে দশটায় ব্যক্তিগত সচিবকে দিয়ে সেটা পাঠিয়ে দিলেন বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিংহের কাছে। আডবাণীর অনুযোগ, দল আদর্শচ্যুত। নেতারা যে যার স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যস্ত। সে কারণেই দলের জাতীয় কর্মসমিতি, সংসদীয় বোর্ড ও দলের নির্বাচনী কমিটির পদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি।
আডবাণীর সেই ইস্তফা অবশ্য দল গ্রহণ করেনি। কিন্তু মূলত যে কারণে আডবাণীর গোঁসা, গোয়ায় নেওয়া সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার কোনও ইঙ্গিতও দেননি দলীয় নেতৃত্ব। বরং মোদীকে সামনে রেখে লোকসভা ভোটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা হবে না বলেই বিজেপি সূত্রে খবর। তবু আডবাণীর ভাবমূর্তি এবং দলে তাঁর অবস্থানের কথা বিবেচনা করে আজ দিনভর তাঁকে দফায় দফায় বোঝানোর চেষ্টা করেছেন বিজেপি শীর্ষ নেতারা। এমনকী, খোদ নরেন্দ্র মোদীও। সন্ধ্যায় বিজেপি সংসদীয় বোর্ডের বৈঠকেও সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছে, আডবাণীর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হবে না। সাংবাদিকদের কাছে সেই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে রাজনাথ বলেছেন, “দলীয় সভাপতি হিসেবে আমি ঠিক করেছি, কোনও অবস্থাতেই এই ইস্তফা আমি গ্রহণ করব না।”
কিন্তু মোদী-প্রশ্নে দল অনড় থাকায় আডবাণীও নিজের অবস্থান থেকে সরেননি। বস্তুত, দলের উদ্যোগ নিয়েই সন্দিহান আডবাণী শিবির। তাঁদের বক্তব্য, দল আডবাণীর পদত্যাগপত্র গ্রহণ না-করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু তাঁকে সেই চিঠি প্রত্যাহার করতে অনুরোধ তো করেনি। ফলে আডবাণীও পদত্যাগ করলেন, আর দলও সেটা গ্রহণ করল না বিষয়টি এই ভাবে ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে বলে আডবাণী-ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য। তাঁদের মতে, এই কৌশলের পিছনে রয়েছে আরএসএস। গোয়ার বৈঠকে মোদীকে তুলে ধরার যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা থেকে বিন্দুমাত্র সরতে রাজি নয় তারা। কিন্তু প্রকাশ্যে দেখানো হচ্ছে যে, আডবাণীকে ধরে রাখার চেষ্টা হচ্ছে। আজ রাজনাথকে ফোন করে আডবাণীকে বোঝাতে বলেছেন সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত। কিন্তু তিনি নিজে আডবাণীকে ফোন করেননি। ফলে আডবাণীকে ঘিরে সঙ্ঘের মাথাব্যথা আদতে কতটা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। |
|
—ফাইল চিত্র |
দল আনুষ্ঠানিক ভাবে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের অনুরোধ না-জানালেও বিজেপি নেতারা অবশ্য আজ দফায় দফায় বুঝিয়ে তাঁকে নরম করার চেষ্টা চালিয়েছেন। আডবাণীর চিঠি হাতে পেয়েই তাঁর সচিবকে রাজনাথ জানিয়ে দেন, ইস্তফা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তার পর নিজেই ছুটে যান আডবাণীর ৩০ পৃথ্বীরাজ রোডের বাড়িতে। শুধু রাজনাথ নন, ৮৫ বছরের ওই নেতাকে বোঝাতে একের পর এক তাঁর কাছে যান সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলি, বেঙ্কাইয়া নায়ডু। ফোন করেন নরেন্দ্র মোদী। দু’বারের চেষ্টায় তিনি কথা বলতে পারেন আডবাণীর সঙ্গে। “আমার যদি ভুল হয়ে থাকে, তা হলে মার্জনা চাইছি,” বলে অশীতিপর নেতার মান ভাঙানোর চেষ্টা করেন মোদী। সঙ্ঘ পরিবারের তরফে সেই ভার দেওয়া হয় এস গুরুমূর্তিকে।
আডবাণীর সঙ্গে কথা বলেন তিনিও।
দলে আডবাণী-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত সুষমা একটা সময় দাবি করেন, শেষ পর্যন্ত তাঁরা আডবাণীকে বোঝাতে সক্ষম হবেন বলেই তিনি আশাবাদী। কিন্তু ঘটনা হল, রাত পর্যন্ত নিজের অবস্থান থেকে সরে আসেননি আডবাণী। সংসদীয় বোর্ডের বৈঠকের পরে ফের তাঁর বাড়িতে গিয়েও তাঁকে রাজি করাতে পারেননি সুষমা, রবিশঙ্কর প্রসাদ, অনন্ত কুমারের মতো নেতারা। বিজেপি নেতাদের একাংশের মতে, যে ভাষায় আডবাণী চিঠিটি লিখেছেন, তাতে দলের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট কোনও আশ্বাস না-পেলে তাঁর পক্ষে পিছিয়ে আসা কঠিন। যে আশ্বাস দিতে সঙ্ঘ পরিবার নারাজ।
মোদী, না মোদী নয় এই প্রশ্নে এখন কার্যত আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গিয়েছে বিজেপি। শীর্ষ নেতৃত্বের একটা বড় অংশ মোদীর বিরোধিতা করলেও সঙ্ঘ পরিবার এবং দলীয় কর্মীদের চাপে তাঁকে নির্বাচন কমিটির প্রধান করতে বাধ্য হয়েছে বিজেপি। বলা হচ্ছে, লোকসভা ভোটে তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করাটা শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু মোদীকে ঘিরে লড়াইটা যে গত কাল গোয়াতেই শেষ হয়ে যায়নি, সেটা আজ বুঝিয়ে দিলেন আডবাণী।
তাই আজ দলের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে ইস্তফা দিলেও এনডিএ-র চেয়ারম্যান পদটি কিন্তু ধরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। বিজেপি সূত্রের ব্যাখ্যা, আডবাণীর অসন্তোষ বিজেপি-কে নিয়ে। এনডিএ বা তার শরিকদের নিয়ে নয়। তাই ওই পদটি না-ছেড়ে তিনি নীতীশ কুমারদের বার্তা দিয়েছেন। আডবাণী শিবিরের আশা, নীতীশের মতো শরিক নেতারা এর পরে এনডিএ-র পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থীর নাম ঘোষণা করে দেওয়ার দাবি জানাবেন। এবং বলবেন, আডবাণী সেই প্রার্থী হলে তাঁদের আপত্তি নেই।
নীতীশের দল জেডিইউ-এর সভাপতি শরদ যাদব ইতিমধ্যেই বলেছেন, “বাজপেয়ী ও আডবাণীর হাত ধরেই এনডিএ গড়ে উঠেছিল। আডবাণীর এ ধরনের সিদ্ধান্ত এনডিএ-র স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।” বিজেপি-র সব চেয়ে পুরনো শরিক শিবসেনার প্রধান উদ্ধব ঠাকরেরও দাবি, আডবাণীকে ফিরিয়ে আনা হোক। শিবসেনার বক্তব্য, আডবাণী হলেন বিজেপি-র ভীষ্ম। তাঁকে বোঝাতে হবে।
মোদীকে নির্বাচন কমিটির প্রধান করাটা রাজনৈতিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ কেন? কেনই বা ওই পদে তাঁর উত্থানে আডবাণীদের আপত্তি?
আপাতদৃষ্টিতে নির্বাচনী কমিটির প্রধান পদটা এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়। এর আগে আডবাণী, অরুণ জেটলি, প্রমোদ মহাজনরা ওই পদে বসেছেন। তাঁরা কেউই তখন প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ছিলেন না। কিন্তু এ বার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। মোদীকে সামনে রেখে ভোটে যাওয়ার দাবি উঠেছে দলের অন্দরে। বিজেপি-র নিচুতলার কর্মীরা যে দাবির শরিক। তা ছাড়া, এ বার প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী হিসেবে কাউকে তুলে ধরতে চাইছে না দল। সেই নিরিখে মোদীর এই পদপ্রাপ্তিকেই লোকসভা ভোটে তাঁর নেতা হয়ে যাওয়া বলে ধরে নিচ্ছেন বিজেপি কর্মীরা। কাল মোদীর নাম ঘোষণার পরেই পটনা, লখনউ, দিল্লি সর্বত্র উল্লাসে ফেটে পড়েছেন তাঁরা।
মোদীকে ঘিরে আপত্তির কারণ হিসেবে আডবাণী শিবির থেকে বলা হচ্ছে, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী লোকসভা ভোটের মুখ হলে নতুন শরিক তো আসবেনই না, নীতীশ কুমারের মতো পুরনো শরিকরাও এনডিএ ছেড়ে চলে যাবেন। ভোটের মেরুকরণ নয়, এনডিএ-র বিস্তার ঘটিয়েই লোকসভা ভোটে যেতে চান আডবাণী। তাই গোয়া কর্মসমিতির বৈঠকের আগে রাজনাথ যখন তাঁর কাছে এসে মোদীকে নির্বাচন কমিটির প্রধান করার কথা জানান, তখন তিনি আপত্তি করেছিলেন। আডবাণী বলেছিলেন, মোদীকে নির্বাচন কমিটির প্রধান করতে তাঁর আপত্তি নেই। কিন্তু পাশাপাশি নির্বাচনী রণকৌশল তৈরির জন্য আর একটি কমিটি গড়া হোক। যার প্রধান হোন নিতিন গডকড়ী। বিতর্ক এড়াতে সেই প্রস্তাবে রাজি হননি গডকড়ী। আডবাণী তখন সুষমার নাম বলেন। |
|
বৈঠকের পর বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিংহের সঙ্গে অরুণ জেটলি ও বেঙ্কাইয়া নায়ডু। ছবি: পিটিআই |
কিন্তু আডবাণীর ওই প্রস্তাবে রাজি হয়নি সঙ্ঘ পরিবার। কারণ, সে ক্ষেত্রে দলের প্রধান মুখ হিসেবে মোদীকে তুলে ধরার যে কৌশল নেওয়া হয়েছে, তা কার্যকর করা যাবে না। তাই গত কাল গোয়ায় একটিই নির্বাচনী কমিটি গড়ে মোদীকে তার প্রধান হিসেবে ঘোষণা করে দেওয়া হয়। সঙ্ঘ পরিবার আশা করেছিল, এক বার নাম ঘোষণা হয়ে গেলে বিজেপি-তে ক্ষমতা দখলের লড়াই বন্ধ হবে। কিন্তু শরিকদের হাতিয়ার করে দাপটের সঙ্গেই ময়দানে থেকে গেলেন আডবাণী।
এখন প্রশ্ন হল, আডবাণী ঠিক কী চাইছেন? আর তাঁকে নিয়ে দল ও সঙ্ঘ পরিবার কী করবে?
আজ পদত্যাগপত্র ছুড়ে দিয়ে আডবাণী প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে মোদীর নাম ঘোষণাটা অন্তত রুখে দিতে পেরেছেন বলেই মনে করছেন বিজেপি-র অনেকে। কারণ, এই মুহূর্তে আডবাণী যতই অপছন্দের লোক হোন, তাঁকে পুরোপুরি উপেক্ষা করাও সঙ্ঘ পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়। আডবাণীর মূল শক্তি হল তাঁর বয়স ও অভিজ্ঞতা। দেশের মানুষের কাছে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তিই তাঁর অন্যতম ইউএসপি। সেই জোরেই আজ ইস্তফা দিয়ে দল এবং আরএসএসের উপরে প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছেন তিনি। যাকে রাজনৈতিক দর কষাকষির কৌশল হিসেবেই দেখছেন অরুণ জেটলির মতো নেতারা।
কিন্তু সেই চাপের মুখে নতিস্বীকার করা হবে না বলেই এখনও পর্যন্ত ঠিক করে রেখেছেন সঙ্ঘ নেতৃত্ব। তাঁরা বিজেপি নেতৃত্বকে বলেছেন, আডবাণীকে বোঝানোর চেষ্টা করুন। কিন্তু মোদী-প্রশ্নে পিছু হটা হবে না। আডবাণীকেও নেতা হিসেবে গ্রহণ করা হবে না। কারণ, এই মুহূর্তে মোদীই দলে সব থেকে গ্রহণযোগ্য নেতা। তাই মোদীর নেতৃত্বেই আগামী নির্বাচন লড়া হবে।
ফলে গোয়ায় নেওয়া সিদ্ধান্ত থেকে বিজেপি যদি সরে না-আসে, তা হলে আডবাণীর ভবিষ্যৎ কী, সেটাই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন। |
|
পুরনো খবর: আপত্তি খারিজ আডবাণীদের |
|
|
|
|
|