আপত্তি খারিজ আডবাণীদের
টলবিহারী বাজপেয়ী-লালকৃষ্ণ আডবাণী জমানার অবসান। বিজেপিতে শুরু হল নরেন্দ্র মোদী জমানা। নাগপুরের চিত্রনাট্য মেনেই আগামী লোকসভা নির্বাচনের প্রচার কমিটির প্রধান হলেন মোদী। সেই সঙ্গে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদের প্রার্থী হওয়ার পথে এগিয়ে গেলেন আরও এক ধাপ।
বৃষ্টিস্নাত গোয়ায় যাবতীয় বাধাবিপত্তি কাটিয়ে প্রত্যাশিত পথেই আজ কর্মসমিতির বৈঠকের শেষ দিনে আনুষ্ঠানিক ভাবে মোদীকে প্রচার কমিটির প্রধান করার কথা ঘোষণা করেন বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিংহ। গোটা দেশ থেকে আসা দলীয় নেতাদের প্রবল উন্মাদনার মধ্যে এই ঘোষণা হল দলের প্রবীণ নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণীর অনুপস্থিতিতেই। সুষমা স্বরাজ চাননি, আডবাণীর অনুপস্থিতিতে মোদীর ব্যাপারে এমন কোনও ঘোষণা হোক। পরে অবশ্য সেই মোদীকেই মালা দিয়ে বরণ করতে হল তাঁকে! আর প্রধান মনোনীত হওয়ার পরে মোদী জানালেন, আডবাণীর সঙ্গে ফোনে কথা বলে তাঁর আশীর্বাদ নিয়েছেন তিনি। দিল্লিতে গিয়ে এ বারে দেখাও করবেন এই প্রবীণ নেতার সঙ্গে।
আর তিনি? স্বয়ং আডবাণী? যাঁর আপত্তিতে প্রায় আটকেই যাচ্ছিল মোদীর অভিষেক! তিন দিন নীরব থাকার পর আজ সকালে ব্লগ লিখতে গিয়ে রাজনীতি নয়, লিখলেন কমল হাসনের ‘বিশ্বরূপম’ সিনেমাটি নিয়ে! আর সেই প্রসঙ্গে তাঁর লেখায় উঠল হিটলার আর মুসোলিনির প্রসঙ্গ! তাঁর ওই মন্তব্যের আড়ালে মোদীকে কটাক্ষ করা হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করলেও সঙ্ঘ ও দলের সমর্থকদের প্রবল প্রত্যাশার চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত এগিয়েই গেলেন মোদী। আর দিনের শেষে আরও একটু নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন আডবাণী।
আডবাণীর অসন্তোষ
• ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১২: ব্লগে লিখলেন, প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন অ-কংগ্রেসি, অ-বিজেপি কোনও নেতা
• ৯ মার্চ, ২০১৩: বললেন, বিজেপি সম্পর্কে মানুষের মোহভঙ্গ হয়েছে।
• ১২ মে, ২০১৩: ফের ব্লগে: কর্নাটকে দল জিতলে বিস্মিত হতাম
• ৭ জুন, ২০১৩: অসুস্থ, গোয়ায় গরহাজির
• ৯ জুন, ২০১৩: ব্লগে লিখলেন হিটলার, মুসোলিনির কথা
আডবাণীজিকে ফোন করেছিলাম। উনি আশীর্বাদ করলেন। ওঁর
আশীর্বাদ পেয়ে সম্মানিত এবং অত্যন্ত কৃতজ্ঞ বোধ করছি।
নরেন্দ্র মোদী
অসুস্থতার জন্য আডবাণী যেমন কর্মসমিতির বৈঠকে যেতে পারেননি, তেমনই আজ জয়পুরে একটি অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা থাকলেও সেখানে যাননি। তবে সন্ধ্যায় দিল্লি থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে জয়পুরের সেই সভায় বক্তৃতা দেন তিনি। যে ভাবে দলের কর্মী ও কিছু নেতার প্রবল চাপে মোদীকে তুলে ধরা হল, তা হয়তো এখন মেনে নিতে হচ্ছে আডবাণীকে। কিন্তু তিনি যে এই সিদ্ধান্তে মোটেই খুশি নন, তা আজ আরও এক বার স্পষ্ট হয়েছে। মোদী যতই জানান, আডবাণী তাঁকে আশীর্বাদ করেছেন, আডবাণী কিন্তু তাঁর ভিডিও কনফারেন্সের বক্তৃতায় এক বারও এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাননি। তিনি অবশ্য কর্মসমিতিতে অনুপস্থিতির জন্য সাফাই দিয়েছেন। অসুস্থতার কারণ দেখিয়েছেন। এমনকী আরএসএসের প্রতি কৃতজ্ঞতাও পেশ করেছেন। কিন্তু মোদী সম্পর্কে নীরব থেকে মতপার্থক্যের জায়গাটি খোলা রাখলেন। আর কর্মসমিতির বৈঠকের পরে কর্মিসভায় মোদী অটল-আডবাণীর নাম না করে বললেন, দলের প্রবীণ নেতারাই তাঁকে ঘষেমেজে তৈরি করেছেন। সেই সভায় এক বারের জন্যও আডবাণীর নাম করেননি তিনি। যা দেখে দলের অনেক নেতা মনে করছেন, আডবাণী-মোদীর মধ্যে টানাপোড়েনের চোরাস্রোত অব্যাহত। মোদীর নাম ঘোষণা হলেও তাতে যে দলের অভ্যন্তরীণ কলহ মিটে গেল, এমনটি নয়। বরং এই সঙ্কট অদূর ভবিষ্যতে জটিলতর হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
নির্বাচনী প্রচার কমিটির প্রধান হওয়ার ঘটনা সে দিক থেকে একটি সামান্য ঘটনা। জাতীয় নির্বাচনী প্রচার কমিটির প্রধানের দায়িত্ব এর আগে স্বয়ং আডবাণী, অরুণ জেটলি, প্রমোদ মহাজনের মতো নেতারা পালন করেছেন। তা হলে মোদীর নির্বাচন নিয়ে কেন এত হইচই?
কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিজেপির এক শীর্ষ নেতা বলেন, “অতীতে প্রচার কমিটির দায়িত্ব কাউকে দেওয়া হলেও প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, সেটি সুনিশ্চিত ছিল। এই প্রথম বিজেপি নির্বাচনে যাচ্ছে, কিন্তু কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা ঠিক নেই। যদিও ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে যে, মোদীই দলের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী। এই দেওয়াল লিখনটা খুবই স্পষ্ট। আজ কর্মসমিতির বৈঠক থেকে সেই বার্তা আরও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণার বিষয়টিও চিত্রনাট্য মেনে খুব শীঘ্রই ঘোষণা হবে।” আজ কর্মসমিতির বৈঠকে যখন রাজনাথ প্রচার কমিটির বিষয়টি ঘোষণা করলেন, তার পর দলের সিংহভাগ নেতার মনে আর কোনও সংশয় থাকল না, কোন রাজ্যে কে প্রচারে যাবেন, কী ভাবে প্রচার হবে, কত টাকা খরচ হবে শুধু মাত্র এই খুঁটিনাটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবেন না মোদী। বরং তাঁরা মনে করছেন, আরএসএস সুকৌশলে আজ মোদীকেই প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করে দিল। লোকসভা নির্বাচন হবে তাঁরই নেতৃত্বে। সেই ঘোষণাও এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। মোদীর অভিষেকের প্রসঙ্গে জেটলি বলেন, “আজ শুভ সূচনা হল। কিন্তু মাত্র অর্ধেক পথ পেরোনো হয়েছে।” জেটলির এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মোদী নিজেও বলেন, “শুভ সূচনা হয়েছে। কিন্তু জয় অর্ধেক হয়েছে।”
মোদীর উত্থানের পরেও দলের মধ্যে প্রশ্ন উঠছে যে, শরিকদের মধ্যে এর কী প্রতিক্রিয়া হবে? অকালি,শিবসেনা এই ঘোষণাকে স্বাগত জানালেও নীতীশ কুমারের তরফে কোনও প্রতিক্রিয়া আসেনি। পাশাপাশি মোদীর উত্থানের পরে ধর্মীয় মেরুকরণও হবে কি না, চিন্তা রয়েছে তা নিয়েও। কংগ্রেসের কিছু নেতা মনে করছেন, মোদী এলে মেরুকরণ হবেই। তার ফায়দা তুলবে কংগ্রেস ও অন্য অ-বিজেপি ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি। কিন্তু আরএসএস মনে করছে, মোদীকে সামনে রেখে উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে অনেকগুলি আসন বাড়িয়ে নেওয়া যাবে। গোবলয়ে নরম হিন্দুত্বের এজেন্ডাকে সেই কৌশলে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। নানা সমীক্ষাতেও দেখা যায়, মোদীকে তুলে ধরলে কংগ্রেসের কিছুটা লাভ হলেও আসন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিজেপির লাভ তুলনায় বেশি। ফলে আরএসএস এখন আডবাণীর এনডিএর সম্প্রসারণের তত্ত্বকে শিকেয় তুলে মোদীকে সামনে রেখে দলের শক্তি ও আসন বৃদ্ধিকেই মূল লক্ষ্য করছে। সেই হিসাবেই অটল-আডবাণী জমানার রূপান্তর ঘটিয়ে মোদী জমানার চিত্রনাট্য রচনা করেছে আরএসএস।
কর্মসমিতির বৈঠকের পর গোয়ায় যে কর্মিসভার আয়োজন করা হয়েছিল, সেখানেও মধ্যমণি রইলেন মোদীই। রাজনাথ, অরুণ জেটলিরা থাকলেও গেলেন না সুষমা। রূপান্তরের প্রতিফলন ঘটল সেই মঞ্চেও। সেখানে রাজনাথ, সুষমা, জেটলি আর মোদীর ছবি থাকলেও ছিল না অটল-আডবাণীর ছবি! সেই নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়ায় রাস্তা থেকে অটল-আডবাণীর কাটআউট তুলে আনা হয়! চার দিক থেকে পরস্পরবিরোধী চাপের মধ্যে যে রাজনাথকে আজ মোদীর নাম ঘোষণা করতে হল, তিনিও কবুল করলেন, “গণতন্ত্রে জনপ্রিয় ব্যক্তিই নেতা হন। ফলে এই ন্যায়বিচার করতে আমাকে কোনও অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়নি। আপনাদের সামনে আমি এক নেতা দিয়েছি। এ বারে আপনারা দায়িত্ব পালন করুন।” এ ধরনের সভায় শেষ বক্তা হন দলের সভাপতি কিংবা আডবাণীর মতো প্রবীণতম নেতা। কিন্তু রাজনাথ আগে বলতে উঠে বললেন, “সব থেকে জনপ্রিয় নেতারই উচিত শেষ বক্তা হওয়া।”
হলও তাই। বার্তা স্পষ্ট। বিজেপি এখন মোদীরই জিম্মায়।

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.