কেউ কথা শোনে না, লৌহপুরুষ এখন নিঃসঙ্গ
স্পাইস জেটের বিমান। ফ্লাইট নম্বর এস জি ২৫৩।
‘ওয়ান এ’ আসনটি সংরক্ষিত ছিল লালকৃষ্ণ আডবাণীর জন্য। কিন্তু অসুস্থতার জন্য তিনি আসতে না পারায় সেখানে বসলেন সুষমা স্বরাজ। পাশে মুরলী মনোহর জোশী। অরুণ জেটলি, বিজয় গোয়েল থেকে বলবীর পুঞ্জ বিজেপির প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে কে নেই ওই বিমানে! পেট খারাপের যুক্তি দিয়ে আডবাণীর না আসায় ক্ষুব্ধ কিছু নেতা। বিমান বোঝাই বিজেপি নেতাদের মধ্যে থেকে একজন বললেন, “যে মানুষটি এই দলটির অন্যতম নির্মাতা, ৮৬ বছর বয়সে তিনি হয়ে গেলেন বিক্ষুব্ধ নেতা?” ওই নেতাকে বললাম, উনি কেন বিক্ষুব্ধ নেতা, সেটা জানার জন্য আপনি কি কোনও দিন আডবাণীজির সঙ্গে কথা বলেছেন?
সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এটাই প্রথম বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠক, যাতে এলেন না লালকৃষ্ণ আডবাণী। সন্ধ্যায় ফোন করলাম গোয়ার হোটেল থেকে। বিজেপির লৌহপুরুষ বললেন, “ফুড পয়েজনিং হয়ে গিয়েছে। দুপুর বেলায় একটু ভাল ছিলাম। কমলা (ওঁর স্ত্রী) একটু খিচুড়ি করে দিল। কিন্তু এখন শরীরটা আরও খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে, কাল যেতে পারব না।”
শুধু কর্মসমিতির বৈঠক কেন, কোনও সরকারি বৈঠকেও আডবাণীকে অসুস্থতার জন্য অনুপস্থিত হতে দেখিনি। বরং অরুণ জেটলি, সুষমা স্বরাজের তুলনায় উনি একটু বেশি রকম সুস্থ বলে বিজেপিতে নানা রঙ্গ রসিকতা চলে। সেই আডবাণী আজ বড় নিঃসঙ্গ। কেশুভাই পটেলকে সরিয়ে নরেন্দ্র মোদীকে মুখ্যমন্ত্রী করেছিলেন এই লালকৃষ্ণ আডবাণীই। তখন নরেন্দ্র মোদী দিল্লিতে বিজেপির দফতর অশোকা রোডের পিছনের ব্যারাকে থাকতেন। কিন্তু অটলবিহারী বাজপেয়ী মোদীকে চাননি। আবার ২০০২ সালে এই গোয়ায় জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে এসেছিলাম। সকালে টেলিভিশন খুলতেই দেখি, চন্দ্রবাবু নায়ডু দাঙ্গার জন্য নরেন্দ্র মোদীর ইস্তফা দাবি করছেন। ফোন করলাম আডবাণীকে। বললেন, “ইস্তফার প্রশ্নই উঠছে না। বিজেপি তার মুখ্যমন্ত্রী ঠিক করবে, শরিক নয়।” বাজপেয়ী কিন্তু সে দিন বৈঠকে চন্দ্রবাবুর পক্ষেই সওয়াল করেছিলেন। সেই আডবাণীই আজ মরিয়া সেই নরেন্দ্র মোদীকে ঠেকাতে!
কিছু দিন আগেই মোহন ভাগবত দিল্লিতে এক মধ্যাহ্নভোজনের আসরে ঘনিষ্ঠ মহলে বলে দিয়েছিলেন, আডবাণীকে কোনও মতেই প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করা হবে না। সব ওষুধের যেমন এক্সপায়ারি ডেট থাকে, তেমন রাজনৈতিক নেতাদেরও থামতে জানা চাই। না হলে নবীন প্রজন্ম আসবে কী করে? কিন্তু নরেন্দ্র মোদী কি আরএসএসের বশংবদ? বিজেপি সূত্র বলে, নিতিন গডকড়ী বা রাজনাথ সিংহ নিঃসন্দেহে সঙ্ঘের অনেক বেশি জো-হুজুর। কিন্তু আরএসএসের কাছে এটি স্পষ্ট, দলীয় কর্মী এবং সমর্থকদের কাছে নরেন্দ্র মোদীই একমাত্র বিকল্প নাম। ঠাট্টা করে ভাগবত তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে বলেন, একই গাড়ির কারখানা থেকে একই গাড়ি বেরোয়। কিন্তু কোনও কোনও গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের খরচা একটু বেশি হয়!
আডবাণীর মোদী-বিরোধিতার যুক্তি হল, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীরনেতৃত্বে সরকার গঠন করা যাবে না। উল্টে কংগ্রেসের লাভ হবে। এনডিএ-র শরিকরাও সবাই সমর্থন করবে না। যেমন নীতীশ কুমার। আবার মোদী এলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো পুরনো সঙ্গীকেও পাওয়া অসম্ভব হয়ে যাবে।
কিন্তু আডবাণীর দুঃখ, এই বিষয়গুলি নিয়ে দলের কোনও নেতাই তাঁর সঙ্গে আলোচনা করছেন না। আবার অভিমানে তিনিও আরএসএস বা বিজেপির কোনও নেতার কাছে নিজে থেকে এই বিষয়টি তুলতে চাইছেন না।
আডবাণীকে প্রশ্ন করেছিলাম, “আপনি কি সত্যিই প্রধানমন্ত্রী পদের প্রার্থী হতে চান? অন্য কাউকে কি মেনে নেওয়া আপনার পক্ষে সম্ভব নয়?” জবাবে আডবাণী বলেছিলেন, “আমি তো কখনও বলিনি, যে আমি প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হতে চাই!” প্রশ্ন, “তা হলে জানিয়ে দিন না, যে আপনি প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হতে চান না?
তা হলেই তো অশান্তি শেষ হয়!” আডবাণীর জবাব, “আমি যখন বলিনি আমি হব, তা হলে কেন বলতে যাব যে হব না?” আমাকে তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, “রাহুল গাঁধী কি বলেছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন না? কিন্তু তিনি যে হবেন, সে কথা বলেননি কখনও। সবই তো মিডিয়ার জল্পনা।” তখন বললাম, “বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহও ইলাহাবাদ উপনির্বাচনের পরে বলেছিলেন যে, তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চান না। এমনকী সেন্ট্রাল হলে চন্দ্রশেখরকে ঠেকাতে দেবীলালের নামও ঘোষণা হয়ে গিয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত দেবীলালের প্রস্তাবে বিশ্বনাথ প্রধানমন্ত্রী হন। তাই আপনি হবেন না, এটা তো কৌশলগত ভাবেও বলা ভাল..!” প্রবীণ নেতাটি বললেন, “আমি কোনও দিন কৌশলের রাজনীতি করিনি। যেটি সত্যি, যেটি উচিত, আমি সেটাই বলি।”
বুঝতে পারলাম, বিজেপির অন্দরে ক্ষমতার লড়াই আপাতত বাড়বে বই কমবে না। বিনা যুদ্ধে এই সিন্ধি নেতাটি এক ইঞ্চি জমি ছাড়তেও রাজি নন। আসলে প্রবীণ নেতারা অনেক সময় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। মানিক সরকারকে তৈরি করেছিলেন নৃপেন চক্রবর্তী। কিন্তু শেষ জীবনে সেই মানিক সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হওয়াটাকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। দল থেকে বিতাড়িত হন নৃপেনবাবু।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের চেয়েও জ্যোতি বসুর কাছের হয়ে উঠেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আগে আডবাণী যখনই গুজরাতে নিজের লোকসভা কেন্দ্র গাঁধীনগরে যেতেন, বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানাতে আসতেন মোদী। যে দিন প্রথম নিজে না এসে হারিন পাণ্ড্যকে পাঠিয়েছিলেন তিনি, সে দিন প্রকাশ্যে কিছু না বললেও মনে মনে দুঃখই পেয়েছিলেন আডবাণী। আবহাওয়ার পূর্বাভাস সে দিনই পেয়ে গিয়েছিলেন। যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল বলতে গেলে সে দিন থেকেই।
দু’দিন আগে মোদী যখন আডবাণীর সঙ্গে দেখা করতে যান, তখন আডবাণী তাঁকে দশ মিনিটের বেশি সময় দেননি। এ দেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ন্যান্সি পাওয়েলের সঙ্গে বৈঠকের কারণ দেখিয়ে হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে বিদায় দিয়েছিলেন মোদীকে।
অতএব এ বার গোয়ার বৈঠক অনুপস্থিত আডবাণীর সঙ্গে উপস্থিত মোদীর দ্বৈরথ! বিমানে অরুণ জেটলি অবশ্য এক শুনেই একটি মোক্ষম গুগলি দিলেন! “হরিপুরা কংগ্রেসে পট্টভি সীতারামাইয়াকে হারিয়ে জিতেছিলেন সুভাষচন্দ্র বোস। সে দিন গাঁধী বলেছিলেন, ‘এ আমার ব্যক্তিগত পরাজয়’। সে দিনের লড়াইটার ক্ষেত্রে বলবেন, মতাদর্শগত, গণতান্ত্রিক মতপার্থক্য। আর বিজেপির ক্ষেত্রে হলেই ক্ষমতার লড়াই!”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.