উপোসি যক্ষ্মা রোগী ওষুধ পান, খাবার জোটে না
শ্চিম মেদিনীপুরের ছোট্ট গ্রাম গোপালি। খড়্গপুর-১ ব্লকের অন্তর্ভুক্ত ২৫টি গ্রামের একটি।
গোপালি ও তার আশপাশের গ্রামে শতকরা প্রায় আশি ভাগ মানুষই বিভিন্ন তফসিলি জাতি ও উপজাতির। যেমন লোধা, শবর, আদিবাসী, সাঁওতাল, ওঁরাও। খড়্গপুর আইআইটি থেকে সালুয়ার দিকে কিছুটা এগিয়ে গেলেই গোপালি গ্রাম পঞ্চায়েত উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র। ভারতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় জনস্বাস্থ্যের চিত্র বুঝতে এই উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির সংকলিত তথ্যের গুরুত্ব অসীম।
উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রটি আসলে গ্রাম পঞ্চায়েতের অফিসবাড়িতে। স্বাস্থ্য পরিষেবা দিয়ে থাকে। ছ’জন মহিলা ‘আশা’ (অ্যাক্রেডিটেড সোশ্যাল হেলথ অ্যাক্টিভিস্ট) কর্মী ও দু’জন ‘এএনএম’ (সহায়িকা সেবিকা ধাত্রী) নিয়ে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রায় ৮ হাজার মানুষকে পরিষেবা দেয়। তাদের নথি বলছে, সংক্রমণ ও জনস্বাস্থ্যের দিক থেকে যক্ষ্মা এই এলাকার অন্যতম প্রধান ব্যাধি।
যক্ষ্মা রুখতে সেই ২০০৬ সাল থেকে নতুন জাতীয় যক্ষ্মা নিবারণ প্রোগ্রাম (আরএনটিসিপি) চালু হয়েছে। তাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ‘হু’ অনুমোদিত ‘ডটস’ পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হয়। ‘ডটস’ হল ‘ডিরেক্টলি অবজার্ভড ট্রিটমেন্ট স্ট্র্যাটেজি’। অর্থাৎ যক্ষ্মারোগীকে সরকারি ক্লিনিকে এসে ৬ বা ৮ মাস ধরে নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মীদের তত্ত্বাবধানে নিয়মিত ও সঠিক ডোজে ওষুধ খেতে হয়। ওষুধ না খাওয়ার বা ফাঁকি দেওয়ার উপায় থাকে না।
আপাতত এই উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রতি মাসে নতুন-পুরনো মিলিয়ে গড়ে ১০-১২ জন যক্ষ্মারোগী আসেন। নথি বলছে, এখানে রোগ সংক্রমণ তফসিলি উপজাতির আদিবাসীদের মধ্যেই বেশি। অন্য স্থানীয় তফসিলি উপজাতি যেমন লোধা বা শবরদের মধ্যে তত যক্ষ্মারোগ দেখা যায় না। মে মাসের রেজিস্টারে যে ৯ জন যক্ষ্মারোগীর কথা রয়েছে তার মধ্যে ৭ জন পুরুষ, ২ জন মহিলা। কিন্তু ৯ জনের ৮ জনই আদিবাসী।
এমন অদ্ভুত বৈষম্যের কারণ কী?
অভিজ্ঞ স্বাস্থ্যকর্মীদের একাংশের ধারণা, আদিবাসীদের অত্যধিক মদ্যপান ও অপুষ্টিই প্রধান কারণ। এঁরা রোজগার যে করেন না, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রেই স্বামী-স্ত্রী দু’জনে রোজগার করে। কিন্তু হাতে পয়সা এলেই সেটা দিয়ে নিজেদের বা সন্তানদের খাবার কেনার বদলে মদের পেছনে খরচা করে ফেলেন। অন্য উপজাতির মধ্যে কি এত মদ খাওয়ার চল নেই, না কি তাদের খাদ্যাভাস আলাদা সে প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর মেলেনি। কিন্তু উত্তর খোঁজাটা জরুরি। মদে ডুবে থাকা গল্পের দেবদাস বা রাজনীতি করতে গিয়ে পেটে কিল মেরে ঘুরে বেড়ানো সুকান্ত ভট্টাচার্য কেন যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন, তার উত্তর। কেননা খাদ্যসুরক্ষা ও অপুষ্টির সঙ্গে যক্ষ্মার এই যোগসূত্র থাকলে শুধু ওষুধ দিয়ে রোগ নির্মূল করা সম্ভব কি না, সেটাও ভেবে দেখার বিষয়।
খাদ্য ও যক্ষ্মার অন্য একটি সম্পর্ক আপাতত পরিষ্কার। ‘ডটস’ পদ্ধতিতে রোগীকে খালি পেটে ওষুধ খেতে হয়। তার মানে যতক্ষণ না পেটে ওষুধ পড়ছে, ততক্ষণ রোগীকে না খেয়ে থাকতে হয়। এই উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের রোগীরা অধিকাংশই গরিব, দিন-আনি দিন-খাই ধরনের। অনাহারে বা অর্ধাহারে থাকা, অপুষ্টিতে ভোগা। দূর-দূর থেকে হেঁটে এসে তাঁরা এমনিতেই অবসন্ন হয়ে পড়েন। খালি পেটে ওষুধ খাওয়ার পরে আরও বেশি ঝিমিয়ে পড়েন তাঁরা। সে দিন বা অনেক সময়ে তার পরের দিনও তাঁদের আর উঠে কাজকর্ম করার শক্তি থাকে না।
অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পে যোগদানকারী মা ও ৫ বছর অবধি শিশুদের জন্য একটি করে পুষ্টিকর ‘মিল’ খেতে দেওয়ার সরকার অনুমোদিত ব্যবস্থা আছে। ‘ডটস’ স্কিমে আসা রোগীদের জন্য কিন্তু কোনও খাবারের বা ‘মিল’ দেওয়ার নিয়ম নেই। অথচ যক্ষ্মারোগে শুধু ওষুধ নয়, নিয়মিত পুষ্টিকর খাদ্যেরও প্রয়োজন। স্বাস্থ্যকর্মীদের মতে, অন্তত যে ছ’মাস ‘ডটস’ অনুযায়ী ওষুধ খেতে সরকারি ক্লিনিকে আসতে হয়, অন্তত তত দিন সেই ব্যবস্থা করা গেলে গ্রামাঞ্চলের গরিব যক্ষ্মারোগীরা উপকৃত হতে পারেন।
জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, এই অঞ্চলে কিছু ‘এমডিআর-টিবি’ রোগী আছেন। এই ধরনের যক্ষ্মায় প্রচলিত ওষুধ বা চিকিৎসা পদ্ধতি সাড়া দেয় না। এই ধরনের যক্ষ্মা নিয়ে ‘হু’-ও যথেষ্ট চিন্তিত। গোপালির স্বাস্থ্যকর্মীরা জানেন, স্থানীয় সালুয়া ব্যাটালিয়ন অঞ্চলে এই রকম এক রোগী আছেন। কিন্তু উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে তেমন কেউ এখনও আসেননি। রোগীর অবস্থা গুরুতর হলে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে তাকে হিজলি গ্রামীণ হাসপাতালে ‘রেফার’ করে দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে আূাপ সংক্রামক রোগের জন্য আলাদা ওয়ার্ড নেই। তাই তারা যক্ষ্মারোগীদের বেশি দিন রাখতে চায় না। প্রাথমিক স্তর থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিকে উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সক্ষম করে না তুললে সেটাও বোধ হয় রোগ নির্মূল করার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।

লেখক আইআইটি খড়্গপুরের অধ্যাপক



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.