প্রতিস্থাপনে নজির অন্যরা, রাজ্য পিছিয়ে কেন
তামিলনাড়ু পেরেছে, মহারাষ্ট্র পেরেছে, অন্ধ্রপ্রদেশ-গুজরাত-কর্নাটকও দ্রুত এগোচ্ছে। তা হলে পশ্চিমবঙ্গ পারছে না কেন?
কলকাতায় কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে নিজের শহর তামিলনাড়ুর কাঞ্চিপুরমে ফেরার আগে এক অনুষ্ঠানে রাজ্যের কয়েক জন স্বাস্থ্যকর্তাকে প্রশ্ন করেন অশোকন সুব্রমণি। কে তিনি?
চিকিৎসক দম্পতি অশোকন ও পুষ্পাঞ্জলি সুব্রমণিকে এক ডাকে চেনে তামিলনাড়ু। সময়টা ২০০৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। বাড়ির কাছে এক পথ দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয় সুব্রমণি দম্পতির ছেলে বছর পনেরোর হিতেন্দ্রন। তিন দিন ভেন্টিলেটরে রাখার পরে চিকিৎসকেরা জানান, ব্রেন ডেথ হয়েছে হিতেন্দ্রনের। কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রে তার হৃৎপিণ্ড শুধু সচল।
হিতেন্দ্রন সুব্রমণি
অশোকন বলছেন, একমাত্র ছেলের এমন অস্বাভাবিক পরিণতিতেও ভেঙে পড়েননি তাঁরা। বরং শোকের মধ্যেও পরের ইতিকর্তব্য ঠিক করে ফেলেন দ্রুত। ঠিক করেন, একমাত্র ছেলের প্রতিটি অঙ্গ প্রতিস্থাপন করার জন্য দান করবেন। সে সময় তামিলনাড়ু সরকারের একটি ‘ব্রেন ডেথ ডিক্লেয়ার কমিটি’ তৈরি হয়ে গিয়েছে। নিয়মমতো কমিটির কাছে প্রস্তাব পাঠালে তারা সম্মতি দেয়। তার পর কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র চলা অবস্থাতেই তাঁদের আদরের হিতুর শরীর থেকে তুলে নেওয়া হয় নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। সরকারের ‘প্রতিস্থাপন কো-অর্ডিনেশন কমিটি’ তাদের কাছে থাকা গ্রহীতার তালিকা থেকে প্রাপকদের নাম বেছে দেয়। চেন্নাই পুলিশ যানযট এড়াতে লালবাতি লাগানো গাড়িতে মাত্র ১১ মিনিটে হিতেন্দ্রনের হৃৎপিণ্ড পৌঁছে দেয় অন্য এক হাসপাতালে। সেখানে ৯ বছরের বালিকা আবিরামির দেহে তা প্রতিস্থাপন করা হয়। হিতেন্দ্রনের যকৃৎ পান কেরলের এক মহিলা, কর্নিয়া থেকে দৃষ্টি ফিরে পান দু’জন। তার দু’টি কিডনি প্রাণ বাঁচায় আরও দু’জনের।
অশোকন বলেন, “এই ঘটনা জানার পরে তামিলনাড়ুতে সরকারি হাসপাতালে থাকা মৃতদেহ থেকে অঙ্গ প্রতিস্থাপনে রাতারাতি জোয়ার আসে।” তাঁর দাবি, “২০০৮-২০১৩-র জানুয়ারি পর্যন্ত মৃতদেহ থেকে ১৮২০টি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ হয়েছে আমাদের রাজ্যে। এক ধাক্কায় কমে গিয়েছে রাজ্যের কিডনি পাচার চক্রের রমরমা। চেন্নাইয়ের কিডনি বেচাকেনার জন্য ‘কিডনি বস্তি’ ছিল। সেখানেও ব্যবসা প্রায় বন্ধ।” মহারাষ্ট্রে সরকারি উদ্যোগে শুধু ২০১২ সালেই মৃতদেহ থেকে ৪৩টি কিডনি, ১৮টি যকৃৎ, ২টি ফুসফুস সংগৃহীত হয়েছে।
অশোকন সম্প্রতি কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে এসে এ রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তাদের কাছে ওই প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়েছিলেন, “পশ্চিমবঙ্গ পারছে না কেন?” উত্তরে কিছু বলতে পারেননি তাঁরা।
স্বাস্থ্যকর্তাদের দাবি, সরকারি হাসপাতালে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মতো পরিকাঠামোই নেই। তাঁরাই জানান, ভারতে ১৯৯৪ সালে অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইন তৈরি হয়। তার পর থেকে এ রাজ্যের সরকারি হাসপাতালে মৃতদেহ থেকে এক বার কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে, এক বার জীবিত দাতার থেকে যকৃৎ প্রতিস্থাপন হয়েছে। আর এক বার মৃতদেহ থেকে নেওয়া যকৃতের প্রতিস্থাপন ব্যর্থ হয়েছে। আর খুব সম্প্রতি দু’বার মৃতদেহ থেকে ত্বক নেওয়া হয়েছে। তাঁদের কথায়, “এখানে চোখ ছাড়া মৃতদেহ থেকে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের হার শোচনীয়।”
স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশই স্বীকার করছেন, এই ‘নেই’-এর রাজ্যে কারও হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, পুরুষাঙ্গ, হাত-পা বা যকৃৎ দরকার হলে ভাগ্যের হাতে নিজেকে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া কোনও উপায় থাকছে না। যাঁদের পয়সা আর যোগাযোগ রয়েছে, তাঁরা দক্ষিণ বা পশ্চিমের রাজ্যগুলিতে গিয়ে অঙ্গ প্রতিস্থাপন করিয়ে আসছেন। যাঁরা তা পারছেন না, কোনও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের অভাবে হয় মারা যাচ্ছেন, অথবা আধমরা হয়ে কাটাচ্ছেন। রাজ্যে ফি বছর কত মানুষের অঙ্গ প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়, তারও কোনও তথ্য নেই স্বাস্থ্য দফতরে। প্রশ্ন করলেই সেই পরিকাঠামোর অভাবের কথা উঠছে।
কেন পরিকাঠামো নেই? রাজ্যের স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাফাই, “কাজটা করা খুব দরকার, কিন্তু প্রক্রিয়াটি জটিল।” তাঁর বক্তব্য, “এমন ডাক্তারই পাচ্ছি না যাঁদের নিয়ে ‘ব্রেন ডেথ ডিক্লেয়ার কমিটি’ তৈরি করব এবং যাঁদের ডাকলে পাওয়া যাবে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য ঘেঁটে কোন রোগীর কী অঙ্গ লাগবে, তার তালিকা তৈরি করাও বড় কাজ। পুলিশের সঙ্গেও আলোচনায় বসতে হবে। কারণ, দুর্ঘটনায় মৃতের দেহ ময়নাতদন্তে যাওয়ার আগে তার থেকে অঙ্গ তুলতে গেলে পুলিশের বিশেষ অনুমতি লাগবে।” রাজ্যে ব্রেন ডেথ কমিটি নেই বলে কোনও প্রতিস্থাপন কো-অর্ডিনেশন কমিটিও নেই। তবে কিডনির দাতা বাছাই করতে স্বাস্থ্য দফতরের একটি কমিটি রয়েছে। সেখানেও বিস্তর অভিযোগ।
কলকাতা ছাড়ার আগে স্বাস্থ্যকর্তাদের কাছে বিস্ময় প্রকাশ করে অশোকন বলেছেন, “এখানে মানুষ এত শিক্ষিত, অনুভূতিপ্রবণ। অথচ অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য এখনও অন্ধকারে হাতড়াতে হয়! কেন সরকারি ভাবে পরিকাঠামো তৈরি হচ্ছে না? কেন মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘোষণায় এত দ্বিধা?” উত্তরে একরাশ লজ্জা ছাড়া আর কিছুই দেখাতে পারেননি স্বাস্থ্যকর্তারা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.