এক দিকে যখন পঞ্চায়েতে অর্ধেক আসনে জেতার লড়াইয়ের জন্য কোমর বাঁধছেন মেয়েরা, অন্য দিকে তখনই রাজ্যের অর্ধেকেরও বেশি কিশোরী হেরে যাচ্ছে জীবনের লড়াইয়ে। আঠারো বছরের আগেই বিয়ে, উনিশ না-পেরোতেই সন্তান। ফলে অশিক্ষা-অপুষ্টি-দারিদ্রের চক্র চলতেই থাকে। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সমীক্ষা বলছে, ৫৩ শতাংশ নাবালিকা-বিবাহ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে এ বিষয়ে দেশে ষষ্ঠ স্থানে। আর যোজনা কমিশন বলছে, বিপিএল মানুষদের সংখ্যার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চম স্থানে। এ দুটোর সম্পর্ক যে ঘনিষ্ঠ, তা নিয়ে আর সন্দেহ নেই।
প্রশ্ন কেবল এই, পঞ্চায়েতে আরও বেশি মহিলা এলে কি বাল্যবিবাহ কমবে? পুরুষতন্ত্র যে মনোভাব থেকে বড় না-হতে বউ করে দেয় মেয়েদের, মহিলা সদস্যরা কি তা ঠেকিয়ে দিতে পারবেন?
ঝালদা ২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি রেখা কুমার বলেন, “পিছিয়ে-পড়া ব্লক হলেও এখান থেকেই কিন্তু বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ হয়েছে। বিয়ে ঠেকাতে মেয়েরা কখনও সহপাঠীদের, কখনও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাহায্য পাচ্ছে।” স্কুলে সেমিনার চলাকালীন উঠে দাঁড়িয়ে নিজের বিয়ের প্রতিবাদ করেছে এমন ঘটনাও ঘটেছে। এ বিষয়ে জনমত গড়ার দায়িত্ব পালন করেছে পঞ্চায়েত, রেখাদেবীর দাবি।
কিন্তু জনমত গড়াই কি যথেষ্ট? পুরুলিয়া ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পদ্মাবতী মাহাতো তা মনে করেন না। “পঞ্চায়েতের কিছুটা ঘাটতি তো রয়েইছে।”
ঘাটতি থাকছে কোথায়? পুরুলিয়া জেলা পরিষদের নারী ও শিশুকল্যাণ দফতরের কর্মাধ্যক্ষ উৎপলা মাহাতোর অভিযোগ, ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটের পর থেকে জেলা পরিষদের হাতে আর কোনও কাজ নেই, ক্ষমতাও নেই। ফলে ব্লক, গ্রাম পঞ্চায়েত, গ্রাম সংসদ স্তরে বাল্য-বিবাহ বিরোধী আলোচনাচক্র করার যে লক্ষ্য তাঁর নিয়েছিলেন তা সফল হয়নি। কিন্তু কাজটা শুরু হয়েছিল। “না হলে এত বছরের অভ্যেসের বিরুদ্ধে যে মেয়েরা প্রতিবাদটা শুরু করেছিল, তারা কোথা থেকে সমর্থন পেয়েছিল?”
বীরভূমের দুবরাজপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি প্রিয়াঙ্কা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য মনে করেন না, তাঁর এলাকায় পঞ্চায়েত নাবালিকাদের নিয়ে খুব মাথা ঘামিয়েছে। “এই এলাকায় মেয়েদের বিয়ে কম বয়সে দেওয়া হয় না, এমনটা নয়। তবে কেউ তেমন প্রতিবাদ করে না বলে বিষয়টা প্রকাশ্যে আসেনি। গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধানেরা এ বিষয়ে ভাবছেন বা কিছু করছেন বলেও কানে আসেনি,” বলেন তিনি।
চণ্ডীতলা ১ পঞ্চায়েত সমিতির শিশু-নারী উন্নয়ন স্থায়ী সমিতির কর্মাধ্যক্ষ দেবযানী বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, অল্প বয়সে বিয়ে ঠেকানোর কৃতিত্ব মূলত এলাকার স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির। “গোষ্ঠীর মেয়েদের থেকে খবর পেয়ে অনেকবার নাবালিকার বিয়ে আটকেছি প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে। গত পাঁচ বছরে অনেক সচেতনতা শিবিরও হয়েছে গোষ্ঠীর মেয়েদের নিয়ে।”
নানা জেলায় পঞ্চায়েতগুলির সঙ্গে বাল্য-বিবাহ প্রতিরোধের কাজ করেছেন ইউনিসেফ-এর পারমিতা নিয়োগী। তাঁর অভিজ্ঞতা, পঞ্চায়েত সদস্যরা গোড়াতেই অস্বীকার করেন যে, তাঁদের এলাকায় বাল্য-বিবাহ ঘটছে। অনেক কথাবার্তার পর তাঁরা বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হন। তবু মেয়ের পরিবার এলাকায় প্রভাবশালী হলে পঞ্চায়েত সদস্যরা প্রতিবাদ করেন না। “যে সব এলাকায় বাল্যবিবাহের প্রতি সমর্থন খুব বেশি, সেখানে ভোট হারানোর ভয়ে পঞ্চায়েত সদস্যরা কিছু বলতে সাহস করছেন না,” বলেন পারমিতা।
তা হলে আরও বেশি মেয়ে পঞ্চায়েতে এসে লাভ হবে কি?
হয়তো কত মেয়ে আসছে, তার চাইতেও বড় হয়ে দাঁড়াবে, কেমন মেয়েরা আসছেন। রাখী সাঁপুই হুগলির চণ্ডীতলা ২ পঞ্চায়েত সমিতিতে তৃণমূল প্রার্থী। বয়স ৩৩ বছর। মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। বছর চারেক আগে স্বামী মারা যান। দুই মেয়েকে মানুষ করছেন বাপের বাড়ির সাহায্যে। রাখীর কথায়, “নাবালিকা অবস্থায় বিয়ে করার যন্ত্রণা নিজের জীবন দিয়েই প্রমাণ পাচ্ছি। জিততে পারলে বাল্যবিবাহ আটকানো হবে আমার প্রধান কাজ। কারও স্ত্রী বা বোন হিসেবে নয়, মেয়েরা নিজেদের পরিচয় নিয়ে বাঁচুক।” শুধু বিয়েই নয়, মেয়েদের উপর যে কোনও হয়রানির বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়িয়েছেন রাখী। পাশে পেয়েছেন এলাকার আরও কিছু মহিলাকে।
তবে বেশি সংখ্যায়ে মেয়েদের পঞ্চায়েতে আসাও জরুরি, মনে করেন দেবযানী। তাঁর উপলব্ধি, “যত বেশি মেয়েরা রাজনীতিতে আসছে, তাদের উপর অত্যাচার তত কমছে। আমাদের ব্লকের অনেক জায়গায় তো মদ-চোলাইয়ের রমরমাও অনেকটা কমেছে মহিলাদের রাজনীতিতে আসার জন্য।” রাজনীতির হাত ধরে পঞ্চায়েতে এসে মেয়েরা যদি পরিবার, সমাজের নির্যাতন, বঞ্চনা থেকে মুক্ত গ্রামসমাজ তৈরি করতে পারে, তাতে রাজ্যের মস্ত লাভ হবে, সন্দেহ নেই। |