পঞ্চায়েত ভোটে সশস্ত্র বাহিনী পাঠানোর প্রশ্নে সাত দিনের মধ্যেই অবস্থান পাল্টালো কেন্দ্রীয় সরকার। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দে মঙ্গলবার বলেছেন, “আমার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সোমবারই টেলিফোনে কথা হয়েছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনী দেওয়া হবে।” মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আঞ্চলিক দলগুলিকে নিয়ে ‘ফেডেরাল ফ্রন্ট’ গড়ার ডাক দেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের এই মতবদল নতুন রাজনৈতিক জল্পনার জন্ম দিয়েছে। মমতাকে চাপে রাখতে, নাকি তাঁর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে বাহিনী পাঠাতে রাজি হল কেন্দ্র, সেই প্রশ্ন উঠছে।
গোড়ায় কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করানোর ব্যাপারে আপত্তি থাকলেও হাইকোর্ট নিরাপত্তার রূপরেখা বেঁধে দেওয়ার পরে ৩০০ কোম্পানি বাহিনী চেয়ে কেন্দ্রকে চিঠি পাঠিয়েছিল রাজ্য। বাহিনী চাওয়া হয়েছিল তিনটি রাজ্যের কাছ থেকেও। কিন্তু দেশের নানা প্রান্তে মাওবাদী দমন অভিযান-সহ নানা কাজে কেন্দ্রীয় বাহিনী ব্যস্ত থাকায় তাদের পশ্চিমবঙ্গে পাঠানো যাবে না বলে জানান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ডিরেক্টর দীনেশ মাথুর। বাহিনী পাঠানোর ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করেনি রাজ্যগুলিও।
এ দিকে, পর্যাপ্ত বাহিনী না-পেলে পঞ্চায়েত ভোট আদৌ করা সম্ভব কিনা, তা নিয়ে সোমবারই সংশয় প্রকাশ করেছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। আজ, বুধবার বিষয়টি হাইকোর্টকে জানাবে বলে ঠিক করেছে তারা। কেন্দ্রীয় বাহিনী ছাড়া পঞ্চায়েত ভোট করা সম্ভব নয় বলে এ দিন বাগডোগরায় মন্তব্য করেছেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনও। এই অবস্থায় শিন্দের আশ্বাস পঞ্চায়েত ভোট ঘিরে ফের জমে ওঠা মেঘ কাটাতে সাহায্য করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রশ্ন হল, কেন কেন্দ্রের এই মত বদল? |
দীনেশ মাথুরের চিঠি আসার পর থেকেই পঞ্চায়েত ভোট ঘিরে সংশয়ের জন্য কেন্দ্রকে দায়ী করে প্রচার শুরু করেছিল তৃণমূল। পাঁচ তারিখ মহাকরণে দাঁড়িয়ে সেই চিঠির কথা জানানোর সময় কেন্দ্রকে কটাক্ষ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। তার পর আসরে নামেন তৃণমূলের অন্য নেতারা। গোটা বিষয়টি তাঁদের বিপক্ষে যাচ্ছে বুঝে প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ছয় তারিখই দিল্লি গিয়ে দলীয় হাইকম্যান্ডের কাছে ক্ষোভ উগরে দেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। বলেন, মনোনয়ন পেশ থেকে ভোট গণনা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী পাওয়া না-গেলে নির্বাচন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হওয়া সম্ভব নয়।
প্রদীপবাবুর অভিযোগ শুনে কিছুটা অবাকই হয়ে যান হাইকম্যান্ডের তরফে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা শাকিল আহমেদ। কারণ, কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানো নিয়ে তিনি নিজেই সপ্তাহ দুয়েক আগে শিন্দের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। শিন্দে আশ্বস্তও করেছিলেন তাঁকে। বিষয়টি নিয়ে কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীকে একটি নোট পাঠান শাকিল। প্রদীপবাবু এবং দীপা দাশমুন্সিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথাও বলতে বলেন তিনি।
পাশাপাশি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ওই চিঠি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে সোমবার দুপুরে রাহুল গাঁধীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী জয়রাম রমেশ। এ সবেরই নিট ফল বাহিনী পাঠাতে অসুবিধা হবে না জানিয়ে মমতাকে শিন্দের ফোন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তাদের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানোর বিষয়টি যে রাজনৈতিক স্তরে ঠিক হবে, সেটা গোড়া থেকেই জানা ছিল। শেষ পর্যন্ত তা-ই হয়েছে।
কেন্দ্র বাহিনী পাঠাতে রাজি হওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা প্রদীপবাবু এ দিন গোটা পরিস্থিতির জন্য রাজ্যকেই দুষেছেন। তাঁর কথায়, “কেন্দ্রীয় বাহিনী পেতে কোনও আগ্রহ দেখায়নি রাজ্য সরকার। নির্বাচন কমিশন ও আদালতের চাপে দায়সারা ভাবে বাহিনী চেয়েছিল। তাই হয়তো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক গোড়ায় অপারগতার কথা জানিয়েছিল। কিন্তু রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কথা সবিস্তার জানিয়েছিলাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। এ-ও বলেছিলাম, কেন্দ্রীয় বাহিনী না-পেলে পঞ্চায়েত ভোট অবাধ হবে না, রক্তক্ষয় হবে বিরোধীদের।”
তবে কেন্দ্র কত কোম্পানি বাহিনী পাঠাবে, তা এ দিন স্পষ্ট করে বলেননি শিন্দে। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি শুধু বলেন, “আমি মুখ্যমন্ত্রীকে নতুন করে আবেদন জানাতে বলেছি। রাজ্যের মুখ্যসচিবের মাধ্যমে সেই আবেদন আসবে। মুখ্যসচিব কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে কথা বলবেন। আমি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিবকেও এ বিষয়ে নির্দেশ দিয়ে দিয়েছি।” পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে বলা হয়, মুখ্যসচিবের আবেদন আসার পরে সিআরপিএফ, বিএসএফ-এর মতো কেন্দ্রীয় বাহিনীগুলির কাছে জানতে চাওয়া হবে, কে কত কোম্পানি বাহিনী ছাড়তে পারবে। সেই অনুযায়ী রাজ্যকে জানিয়ে দ্রুত জওয়ান পাঠানোর কাজ শুরু হবে। তবে সব কেন্দ্রীয় বাহিনীতেই যে জওয়ানের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম, তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারাই কবুল করছেন। ছত্তীসগঢ়ে মাওবাদী হামলার পরে সেখানে বাড়তি বাহিনী পাঠাতে হয়েছে। অন্যান্য মাওবাদী-অধ্যুষিত রাজ্য থেকেও বাহিনী সরানো কঠিন। তবে তাঁদের বক্তব্য, রাজনৈতিক চাপে অসাধ্যসাধন করতেই হবে।
কিন্তু বাহিনী চেয়ে রাজ্য নতুন করে আবেদন জানাবে কি না, তা নিয়ে মহাকরণ থেকে স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি। রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী নিজেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন করে বাহিনী পাঠানোর অনুরোধ করেছেন। আর আমরা ৩০০ কোম্পানি বাহিনী চেয়ে চিঠি তো পাঠিয়েই রেখেছি।” মহাকরণ সূত্রে খবর, সশস্ত্র বাহিনীর বিষয়ে আজ, বুধবার হাইকোর্ট কী বলে তা দেখে দু’এক দিনের মধ্যেই চিঠি পাঠানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
পঞ্চায়েত ভোটে নিরাপত্তা নিয়ে রাজ্যের পক্ষে বুধবার হাইকোর্টে কী বলা হয়, সে দিকে তাকিয়ে নির্বাচন কমিশনের কর্তারাও। যদিও মামলার প্রস্তুতি হিসেবে এ দিনই কমিশনের সচিব রাজ্যকে চিঠি পাঠিয়ে আদালতের নির্দেশ-মোতাবেক নিরাপত্তার কী ব্যবস্থা করা হচ্ছে, তা শীঘ্রই জানাতে বলেছেন। কেন্দ্র শেষ পর্যন্ত কত কোম্পানি সশস্ত্র বাহিনী পাঠায় সেটাও দেখতে চায় কমিশন। কমিশন সূত্রের বক্তব্য, প্রথম দফার ভোটে ১ লক্ষ ১৬ হাজার সশস্ত্র বাহিনী প্রয়োজন। রাজ্যের হাতে রয়েছে ৫০ হাজার। অর্থাৎ, প্রয়োজন আরও ৭৬ হাজার। এই ঘাটতি কেন্দ্র পূরণ করবে কি না, সেটাই প্রশ্ন। তবে রাজ্যপালের সমর্থন মঙ্গলবার তাঁরা পেয়ে গিয়েছেন। দার্জিলিং যাওয়ার পথে রাজ্যপাল বলেন, “কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে নির্বাচন কমিশন যে কথা বলছে, তা যুক্তিযুক্ত। কেন্দ্রীয় বাহিনী ছাড়া ভোট সম্ভব নয়। আমরা চেষ্টা করছি তা পাওয়ার।” রাজ্যপালের এই বক্তব্যের সঙ্গে অবশ্য সহমত নন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “রাজ্যপাল বললে তো কিছু হবে না! পুরো বিষয়টি এখন আদালতের হাতে। তারা কী বলল সেটাই আসল। আদালত চাইলে সব নির্দেশিকা বদল করে ভোটের ব্যবস্থা করতে পারে।”
|