কেন্দ্র আগেই জানিয়ে দিয়েছিল, তারা বাহিনী দিতে পারবে না। যে সব রাজ্যের কাছ থেকে সশস্ত্র পুলিশ চাওয়া হয়েছিল, সোমবার পর্যন্ত তাদের তরফেও কোনও সাড়া মেলেনি। এই পরিস্থিতিতে এ দিন নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে রাজ্য জানিয়ে দিল, কমিশন যে পরিমাণ বাহিনী চেয়েছিল, তা জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছে না। পর্যাপ্ত বাহিনী না মেলায় ঘোষিত নির্ঘণ্ট মেনে পঞ্চায়েত নির্বাচন করা যাবে কি না, রাতে চিঠি পাওয়ার পরে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করল রাজ্য নির্বাচন কমিশন।
গত ৪ জুন হাইকোর্টে রাজ্য সরকার জানিয়েছিল, ২২ মে-র প্রশাসনিক কর্তাদের বৈঠকে কমিশন যে বাহিনী চেয়েছে, তা দিতে তাদের আপত্তি নেই। সেই মতো পঞ্চায়েত ভোটের জন্য দরকার ১.৪৬ লক্ষ সশস্ত্র বাহিনী। প্রথম দফার ভোটের জন্যই প্রয়োজন ১.১৬ লক্ষ বাহিনী। কিন্তু এই মুহূর্তে রাজ্যের হাতে মেরেকেটে ৫০ হাজার বাহিনী রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এই অবস্থায় কী করবে কমিশন? কমিশন সূত্রে বলা হয়েছে, কী করণীয়, হাইকোর্টের তা কাছে জানতে চাইবে তারা। রাজ্য সরকার পর্যাপ্ত বাহিনী দিতে না পারলে তাদের পক্ষে যে পঞ্চায়েত নির্বাচন করা সম্ভব নয়, সে কথাও তারা হাইকোর্টকে জানাবে।
সোমবার কমিশনের সচিব তাপস রায় বলেন, “মনোনয়নপত্র পেশ ও প্রত্যাহারের পর্বে আদালত নির্দেশিত নিরাপত্তা বাহিনী পাওয়া যায়নি। তার জেরে মনোনয়ন পর্বে হুগলি, বর্ধমান, কোচবিহার এবং বীরভূম-সহ বিভিন্ন জেলায় বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ঘটেছে। নিরাপত্তা সুনিশ্চিত না হলে কমিশন ভোটে যাবে কি না, তা বিবেচনা করা হচ্ছে।” কমিশনের সচিব জানান, পর্যাপ্ত বাহিনী না পেয়েও হাইকোর্টের নির্দেশেই তাঁরা মনোনয়নপত্র জমা এবং প্রত্যাহারের কাজ শুরু করেছেন। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে পর্যাপ্ত বাহিনী না পেলে তাঁরা যে আর এগোবেন না, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন তাপসবাবু। |
নির্বাচন সংক্রান্ত কোনও সমস্যা বা জট কাটাতে রাজ্য পঞ্চায়েত আইনের ১৩৭ ধারায় কমিশনকে যে কোনও নির্দেশ জারি করার ক্ষমতা দেওয়া রয়েছে। ওই ধারাতেই কমিশন পঞ্চায়েত নির্বাচন ছ’মাসের জন্য স্থগিতও করে দিতে পারে। পর্যাপ্ত বাহিনী না পেলে কলকাতা হাইকোর্টের কাছে কমিশন এ বার ১৩৭ ধারা প্রয়োগ করে ভোট স্থগিতের আর্জি জানাতে পারে বলে কমিশন সূত্রের খবর। কমিশনের সূত্রটি জানান, ইতিমধ্যেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে ১৩৭ ধারার প্রয়োগ শুরু হয়েছে। যেমন, এসডিও অফিসে গ্রাম পঞ্চায়েতের মনোনয়ন জমা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কমিশন। একই ভাবে পাহারা দিয়ে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার কেন্দ্রে নিয়ে আসার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। তবে ভোট যদি আদৌ স্থগিত করতে হয়, তা হলে সেই নির্দেশ জারির বিষয়টি হাইকোর্টকে জানিয়েই করতে চাইছে কমিশন।
সোমবারই দ্বিতীয় পর্বের ভোটের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার কাজ শেষ হয়েছে। তৃতীয় পর্বের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময়সীমা ১২ জুন পর্যন্ত। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিন বাড়ানোর অনুরোধও এসেছে।
কেন্দ্রীয় বাহিনী যে মিলবে না, সেটা গত ৫ জুন মহাকরণে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই ঘোষণা করেছিলেন। জানিয়েছিলেন, এই ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক চিঠি দিয়ে রাজ্য সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে। গত শুক্রবার পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের ঘরে জরুরি বৈঠকের পরে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, অন্যান্য রাজ্য থেকেও বাহিনী পাওয়া যাবে না। সোমবার রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে কমিশনের দফতরে চিঠি পাঠিয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনী সম্পর্কে রাজ্যের অবস্থান জানিয়ে দেওয়া হয়।
রাতে সেই চিঠি পৌঁছয় রাজ্য নির্বাচন কমিশনের দফতরে। কমিশন সূত্রে জানানো হয়, কেন্দ্রীয় সরকারের পাঠানো চিঠিটি কমিশনকে পাঠিয়ে দিয়েছে রাজ্য। কমিশন সূত্রের বক্তব্য, এ বারে হাইকোর্টের কাছে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করবে কমিশন।
ভোট নিয়ে সংশয়ের মধ্যেই বিভিন্ন প্রশাসনিক অফিসারদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রশ্নে ফের রাজ্য সরকার কমিশনের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। পক্ষপাতমূলক আচরণের জন্য এ দিনই পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা থানার ওসিকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। নির্দেশে বলা হয়েছে, নির্বাচন চলছে, এমন কোনও জায়গায় যেন তাঁকে বহাল করা না হয়। পাশাপাশি তিনটি জেলার পুলিশ সুপারের ভূমিকা নিয়েও কমিশন তার অসম্তোষ মৌখিক ভাবে রাজ্য সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে।
সরকারি সূত্রের খবর, পিংলা থানার ওসি পঙ্কজ মিস্ত্রির কাজকর্ম নিয়ে কংগ্রেসের তরফে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ জানানো হয়। কমিশন জেলা স্তরে নির্দেশ দিয়ে অভিযোগগুলি সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়। কিন্তু তার পরেও অভিযোগ আসতে থাকে। কংগ্রেসের তরফে মানস ভুঁইয়া কমিশনের কাছে ওসি-র কাজে পক্ষপাতিত্ব রয়েছে বলে অভিযোগ করেছিলেন। তিনি এ দিন বলেন, “শাসকদলের তল্পিবাহক হিসাবে কাজ করছিলেন ওই ওসি। কংগ্রেস কর্মীদের হুমকি দেওয়া, মারধর করা চলছিল। বারবার বলার পরও ওসি কোনও কাজ করেননি।” কমিশন সূত্রে বলা হয়, ওই ওসি-র বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে কমিশন তদন্ত করেছে। কমিশনের তদন্তে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে।
যদিও সরকার এখনই কোনও পদক্ষেপ করতে নারাজ। রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার সুনীল চৌধুরীর কাছে পিংলার ওসি-র সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছেন। পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক সুরেন্দ্র গুপ্ত এ দিন বলেন, “সরকারি কোনও নির্দেশ এখনও পাইনি।” মহাকরণ সূত্রে বলা হয়, পিংলা থানার ওসি-কে বদলি করে দেওয়া হলে পরবর্তী ক্ষেত্রে কমিশনের সব নির্দেশই রাজ্য প্রশাসনকে মানতে হবে। কমিশন ভোটের সময়ে প্রশাসনিক অফিসারদের নিয়ন্ত্রণ করুক, রাজ্য সরকার চায় না। সরকারি কর্তাদের কথায়, “এখন থানার ওসি-কে সরিয়ে দিলে ভোট চলাকালীন কমিশনের একচ্ছত্র অধিকার মেনে নেওয়া হবে। এখন যদি এমন নির্দেশ মানা হয়, তা হলে আগামী দিনে পুলিশ সুপারকে সরানোর নির্দেশ এলে তা-ও মানতে হবে।”
|