এলাকা বিরোধী শূন্য। বহু আসনে প্রার্থী দিতে পারেনি সিপিএম তথা বামফ্রন্ট। তার পরেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পঞ্চায়েত দখল করতে ব্যর্থ শাসক দল তৃণমূল। সৌজন্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও গোঁজ প্রার্থী।
নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করার এই রাজনীতির অনিবার্য পরিণাম সোমবার প্রথম দফার ভোটের মনোনয়ন পর্ব শেষ হওয়ার পরেই উঠে এসেছে। বাঁকুড়ার ইন্দাস ব্লকের ছ’টি এবং পাত্রসায়র ব্লকের একটি পঞ্চায়েতে দলেরই গোঁজ প্রার্থীরা আপাতত মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তৃণমূলের সরকারি প্রার্থীদের কাছে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন জেলা তৃণমূল নেতৃত্বও। এই লড়াই দেখে দলের নিচুতলার অনেক কর্মীই বলছেন, “এতে এলাকায় সিপিএম অক্সিজেন পাচ্ছে।”
শুধুই পাত্রসায়র বা ইন্দাস নয়, জেলার আরও জায়গায় দলীয় দ্বন্দ্বের এই ছবি প্রকট হচ্ছে। যেমন, মাওবাদীদের সহযোগী সংগঠন হিসাবে পরিচিত পুলিশি সন্ত্রাসবিরোধী জনসাধারণের কমিটির নেতা হিসেবে এক সময়ের জেল খাটা প্রবীর গরাইকে এ বার কোতুলপুর ব্লক থেকে জেলা পরিষদের প্রার্থী করায় তৃণমূলের অন্দরে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। এই ঘটনা মানতে না পেরে প্রবীরবাবুর বিরুদ্ধে নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন তৃণমূলের সিহড় অঞ্চল কমিটির সম্পাদক বাসুদেব মুখোপাধ্যায়। জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, জেলা পরিষদের ৪০ নম্বর আসনে তৃণমূলের হয়ে দাঁড়িয়েছেন আত্মসমর্পণকারী মাওবাদী নেত্রী সুচিত্রা মাহাতোর স্বামী প্রবীর গরাই। ওই আসনেই নির্দল হয়ে লড়ছেন বাসুদেববাবু। |
পুরুলিয়ায় ভোট প্রচার তৃণমূলের। মঙ্গলবার সুজিত মাহাতোর তোলা ছবি। |
দলের দ্বন্দ্ব এ ভাবে সামনে এসে যাওয়ায় অস্বস্তিতে জেলা তৃণমূলের শীর্ষ নেতারা। তৃণমূল সূত্রের খবর, দলের শীর্ষস্তরের নেতারা বার বার গোঁজ প্রার্থীদের নাম প্রত্যাহারের জন্য চাপ দিয়েছেন। যদিও ঘটনা হল, কয়েক জন গোঁজ প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাহার করলেও অনেকেই দলের প্রতীক না পেয়ে নির্দল হয়েই লড়াইয়ে নামতে চলেছেন। পাত্রসায়র বা ইন্দাস তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
একদা ‘লালদুর্গ’ পাত্রসায়র ও ইন্দাসে গত বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকেই সিপিএমের সংগঠন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে। এ বার পঞ্চায়েত নির্বাচনে পাত্রসায়র ব্লকের গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৩৪টি এবং পঞ্চায়েত সমিতির ২৮টি আসনের মধ্যে কেবল বালসি-১ পঞ্চায়েতের একটি মাত্র আসনে প্রার্থী দিতে পেরেছে সিপিএম। জেলা পরিষদের ২টি আসনের মধ্যে একটিতে মনোনয়ন জমা দেওয়ার পরেও সোমবার প্রত্যাহার করে নিয়েছেন সিপিএম প্রার্থী মীরারানি দে। গ্রাম পঞ্চায়েতের ১২১টি আসনে এবং পঞ্চায়েত সমিতির ২৬টি আসনে ইতিমধ্যেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছে তৃণমূল।
এমন পরিস্থিতিতেও তৃণমূলের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে দলীয় কোন্দল। বীরসিংহ পঞ্চায়েতের ৯টি আসনের মধ্যে ৮টিতেই তৃণমূলের টিকিট পাওয়া এক গোষ্ঠীর প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দলীয় বিক্ষুব্ধেরা ‘নির্দল’ প্রার্থী হিসাবে দাঁড়িয়েছেন। পাত্রসায়র ব্লক তৃণমূল সভাপতি স্নেহেশ মুখোপাধ্যায়ের দাবি, “দলের রাজ্য ও জেলা নেতৃত্বের নির্দেশ মেনে প্রার্থীদের প্রতীক দেওয়া হয়েছে। তার পরেও যাঁরা প্রার্থী হিসাবে রয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের মনোনয়ন প্রত্যাহারের জন্য বলা হয়েছিল। কয়েক জন সেই সিদ্বান্ত মানেননি। আমরা তাঁদের সমর্থন করছি না।”
ইন্দাস ব্লকের গ্রাম পঞ্চায়েতের ১২৯টি আসনের মধ্যে ৬৯টি এবং পঞ্চায়েত সমিতির ২৯টি আসনের মধ্যে ২৩টিতে সিপিএম প্রার্থী রয়েছেন। হিসাব বলছে, সিপিএম প্রার্থী দিতে না পারায় গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে অন্তত ৬০টি আসনে তৃণমূল প্রার্থীদের বিনা লড়াইয়ে জেতার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। পঞ্চায়েতের ৩০টি আসনে তৃণমূল প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছেন। এর পিছনে রয়েছে ইন্দাসের তৃণমূল বিধায়ক গুরুপদ মেটের সঙ্গে প্রাক্তন ব্লক সভাপতি রবিউল হোসেনের বিরোধ। দুই গোষ্ঠীই ইন্দাস-১, ইন্দাস-২, রোল, মঙ্গলপুর, দীঘলগ্রাম এবং আকুই-২ পঞ্চায়েতের ৬০টি আসনে একে অপরের বিরুদ্ধে প্রার্থী দিয়েছেন।
তৃণমূল নেতা রবিউল হোসেনের অভিযোগ, “বিধায়কের লোকেরা সিপিএমকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্যই ব্লকের বেশ কিছু পঞ্চায়েতের আসনে দলের ঘোষিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্দল দাঁড় করিয়েছেন। এ জন্যই আমাদের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিততে পারেননি।” বিধায়ক গুরুপদবাবুর পাল্টা দাবি, “দলের সিদ্বান্ত মেনেই প্রার্থীদের প্রতীক দেওয়া হয়েছে। সিপিএমের সঙ্গে আঁতাঁত করে কয়েক জন নির্দল হিসাবে ভোটে লড়ছেন। আমরা কোনও নির্দল প্রার্থীকে সমর্থন করছি না।” এ ব্যাপারে জেলা তৃণমূল সভাপতি অরূপ খাঁ বলেন, “গুটি কয়েক আসনে এটা হয়েছে বলে খবর পেয়েছি। কেন হল, তা দলীয় স্তরে দেখা হচ্ছে।”
কোতুলপুরে গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে এতটা দ্বন্দ্ব না থাকলেও খোদ ব্লক সভাপতির বিরুদ্ধেই দলীয় নেতার নির্দল প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় করায় অস্বস্তি বেড়েছে জেলা তৃণমূলে। ২০১২ সালের এপ্রিলে প্রবীর গরাই তৃণমূলে যোগ দেন। কার্যত তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে সঙ্গে থাকা নিমাই ঘোষকে সরিয়ে কোতুলপুর ব্লকের তৃণমূল সভাপতি করা হয় প্রবীরবাবুকে। এই ঘটনা মেনে নিতে পারেননি তৃণমূলের একাংশ। মিছিল, পথসভা করে প্রতিবাদ জানান বিক্ষুব্ধ দলীয় কর্মীরা। তাতে কাজ না হওয়ায় শতাধিক অনুগামীকে সঙ্গে নিয়ে কংগ্রেসে যোগ দেন নিমাইবাবু।
পঞ্চায়েত ভোটে সেই প্রবীরবাবুকেই সরাসরি জেলা পরিষদের প্রার্থী করায় তৃণমূলের ফের ক্ষোভ মাথাচড়া দিয়েছে। দল সূত্রের খবর, প্রবীরবাবুর আসনে প্রার্থী হতে চেয়ে তৃণমূলের হয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন সিহড় অঞ্চল কমিটির সম্পাদক বাসুদেব মুখোপাধ্যায়। কিন্তু দলের তরফে প্রবীরবাবুকেই প্রতীক দেওয়া হয়। ক্ষুব্ধ বাসুদেববাবু প্রকাশ্যেই বলছেন, “ভাবতেই পারছি না, জনসাধারণের কমিটির এক নেতাকে নেতাকে শেষে জেলা পরিষদের প্রার্থী করল দল!” তাঁর সংযোজন, “প্রবীরবাবুকে ব্লক সভাপতি করাতেই আমাদের আপত্তি ছিল। তবু শীর্ষ নেতৃত্বের কথা আমরা মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু জেলা প্রশাসনে তাঁকে বসাতে চাওয়া আমরা কোনও ভাবেই মেনে নেব না। তাই নির্দল হয়েই প্রবীরবাবুর বিরুদ্ধেই লড়ব।” প্রবীরবাবু অবশ্য বিষয়টিকে আমলই দিচ্ছেন। তাঁর বক্তব্য, “আমি নিশ্চিত মা-মাটি-মানুষের প্রার্থীকেই জয়যুক্ত করবেন ভোটাররা।”
তবে বাসুদেববাবুর এই বিদ্রোহকে সুনজরে দেখছেন না দলের জেলা নেতারা। দলের বাঁকুড়া জেলা কো-চেয়ারম্যান অরূপ চক্রবর্তী বলেন, “প্রার্থী নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্তই শেষ কথা। সব স্তরের কর্মীদেরই তা মেনে নেওয়া উচিত। বাসুদেববাবু যা করেছেন, তা আমরা সমর্থন করছি না। তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” |