২০১৩ সাল। নানুর।
বাড়িটির সামনেই ল্যাম্পপোস্ট। সাঁটা আছে তৃণমূল নেত্রীর হাসিমুখ পোস্টার। বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া তেরাস্তার মোড়। সেখানেই শাসকদলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র কার্যালয়।
অথচ ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটেও ওই কার্যালয়ের মাথায় পতপত করে উড়ত লালঝান্ডা। যা ছিল আদতে সিটু-র পরিবহণ শ্রমিক সংগঠনের অফিস।
রাজ্যে পরিবর্তন আসার পরে শুধু রং বদলেছে পার্টি অফিস। কিন্তু এক সময়ের লালদুর্গ বলে পরিচিত নানুর সেই একতরফা নির্বাচনের মৃগয়াক্ষেত্রই হয়ে আছে। ২০০৩ সালেও চিরুনি তল্লাশি চালিয়েও এখানে তৃণমূলের পতাকা খুঁজে পাওয়া যেত না। সেখানে এখন লাল উধাও। গত বার নানুর ব্লকের ১১টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৫৯টি আসনের মধ্যে ১২৫টি এবং পঞ্চায়েত সমিতির ৩১টি আসনের মধ্যে ২৫টিই সিপিএমের দখলে ছিল। এ বার তার একটিতেও কোনও প্রার্থী দিতে পারেনি বামেরা।
নানুরে তৃণমূলের অবশ্য উত্থান শুরু ২০০০ সাল থেকেই। সুচপুর-গণহত্যার পরে রাজ্য রাজনীতিতে তোলপাড় ফেলা ওই হত্যা-কাণ্ডের সহানুভূতির হাওয়া পালে লাগিয়ে ২০০৩ সালে ব্লকের ১১টি পঞ্চায়েতের মধ্যে দু’টি পঞ্চায়েত বিরোধীরা দখল করে। ২০০৮ সালে চণ্ডীদাস-নানুর পঞ্চায়েত দখল করে তৃণমূল। পরে দল বদলের হাতিয়ারে উচকরণ পঞ্চায়েতটিও তৃণমূল বামেদের থেকে ছিনিয়ে নেয়। ২০১১ সালে তৃণমূল ছিনিয়ে নেয় নানুর বিধানসভা কেন্দ্রটিও। তার আগে ও পরে এলাকার বড় অংশের ফব ও আরএসপি কর্মী-সমর্থকও তৃণমূলে যোগ দেন। এর ফলে আরএসপি ও ফব-এর দখলে থাকা নানুরের আরও তিনটি পঞ্চায়েত চলে যায় তৃণমূলের হাতে। সিপিএমের টিকিটে জেতা প্রধান ও সদস্যদের অপরিবর্তিত রেখে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে অন্য পঞ্চায়েতগুলির নিয়ন্ত্রণও চলে আসে কার্যত তৃণমূলের হাতেই। |
পতাকাই সার। জনশূন্য নানুরের সিপিএম কার্যালয়। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি। |
সিপিএমের লোকেদের একটা বড় অংশেরই মত, এলাকার দুই দাপুটে নেতা আনন্দ দাস ও নিত্যনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের অনুপস্থিতি দলের ভিত নড়িয়ে দিয়েছে। ২০১০ সালের জুনে বাড়ির সামনেই খুন হন এলাকার সিপিএম বিধায়ক আনন্দ দাস। নভেম্বরে রায় আসে সুচপুর গণহত্যার। যাবজ্জীবন সাজা পেয়ে ৪৪ জন নেতা-কর্মী নিয়ে জেলে গিয়েছেন খুজুটিপাড়ার প্রভাবশালী নেতা নিত্যনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ও।
২০০৮ সালের নির্বাচনে নানুরের ১১টি পঞ্চায়েতের ১৫৯টি আসনের মধ্যে তৃণমূল পেয়েছিল মাত্র ১৪টি। জেলা পরিষদের তিনটি আসনই ছিল সিপিএমের। এ বারে পঞ্চায়েতের মোট ১৬৮টি আসনে তৃণমূলের হয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ২১৭ জন। অথচ পঞ্চায়েতের ১৬৮টি ও পঞ্চায়েত সমিতির ৩১টি আসনের একটিতেও কোনও মনোনয়ন জমা করতে পারেনি বামফ্রন্ট। সিপিএমের নানুর জোনাল সম্পাদক হাসিবুর রহমানের অভিযোগ, “তৃণমূলের সন্ত্রাসেই জেলা পরিষদের দু’টি আসন ছাড়া নানুর ব্লকের কোনও পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতি আসনে আমরা প্রার্থী দিতে পারিনি। যা পরিস্থিতি তাতে জেলা পরিষদের প্রার্থীও প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে কিনা আলোচনা চলছে।”
অথচ এক সময়ে সারা বছর তো বটেই, বিশেষ করে কোনও ভোটের আগে নানুর লাগোয়া সাকুলিপুরে সিপিএমের যে জোনাল অফিসে প্রায় বিয়েবাড়ি-বিয়েবাড়ি ভাব দেখা যেত, সেখানে এখন কার্যত ঘুঘু চরছে। জনমানব শূন্য পোড়ো বাড়ি। নয়াদিল্লিতে অর্থমন্ত্রী নিগ্রহ-কাণ্ডের পরেই সেখানে ভাঙচুর হয়। তারপরেই তালাবন্ধ। এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ভাঙা আসবাব, কাগজের স্তূপ। আর ভাঙার মতো সেখানে বিশেষ কিছু অবশিষ্টও নেই।
সিপিএমের অভিযোগকে মুখে উড়িয়ে দিলেও নানুরে দলের অন্দরের ‘ভাঙন’ নিয়ে কিন্তু অস্বস্তিতে তৃণমূলই। গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৬৮টি আসনে ২১৭ জন, পঞ্চায়েত সমিতির ৩১টি আসনে ৪১ জন তৃণমূলের প্রার্থীপদের দাবিদার (মনোনয়ন জমার নিরিখে)। তৃণমূলের একটা অংশ, রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে ‘ডামি প্রার্থী’ দেওয়ার তত্ত্ব তুলে ধরলেও, বড় অংশই মনে করেন, গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বই এর মূলে। “আগে সিপিএমের সঙ্গে তৃণমূল বা আরএসপি এবং ফব-এর সংঘর্ষ হত। এখন সংঘর্ষ যদি হয়, তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর মধ্যেই হবে।” মনে করছেন উচকরণের সুবল মেটে বা বড়াশাওতার আব্দুল রশিদেরা। তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের গোষ্ঠীর সঙ্গে যে কেতুগ্রামের বিধায়ক শেখ শাহানেওয়াজের ভাই কাজল শেখের গোষ্ঠীর সংঘর্ষ লেগেই রয়েছে, সেটা দলেরই কেউ-কেউ ফিসফিসিয়ে মনে করিয়ে দেন।
গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব অবশ্য বেশি ভাবাচ্ছে না খাইরুল বাসার মির ও দীপালি মণ্ডলদের। দুপুর ১টা নাগাদ ব্লক অফিসের দিকে যেতে দেখা মিলল দু’জনের। চণ্ডীদাস-নানুর পঞ্চায়েতে তৃণমূলের হয়ে মনোনয়ন জমা দিতে এসেছেন। অফিসে ঢোকার আগে হাসিমুখে বলে গেলেন, “এ বারই প্রথম নির্ভয়ে যাচ্ছি। আগে তো সিপিএমের সন্ত্রাসে প্রার্থী হওয়ার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না!” |