|
|
|
|
ফিরে দেখা
ছবি বা গানের ক্ষেত্রে রিমেক আর রিমিক্সের দৌড়ে পিছিয়ে নেই বলিউড, এমনকী টলিউডও।
বাংলার মঞ্চে সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে কি? খোঁজ নিলেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত |
কিছু দিন আগের ঘটনা। লাকি আলির শ্যালক, মিকি ম্যাকক্লেয়ারি বলিউডে তাক লাগিয়ে দিলেন তাঁর রিমিক্স দিয়ে। মাধুরী দীক্ষিতের ‘ধক ধক করনে লগা’ রিমিক্স করলেন রোহন সিপ্পির ‘নৌটঙ্কি শালা’-তে। গানটি কলকাতার সব ডিস্কেই খুব জনপ্রিয়তা পায়। তার কিছু আগে ‘ডেভিড’ ছবির জন্য রেখা ভরদ্বাজকে দিয়ে গাওয়ান ‘দমাদম মস্ত কলন্দর’-এর টেকনো রক ভার্সান। ‘শয়তান’ ছবির জন্য মিকি রিমিক্স করেছিলেন ‘হাওয়া হাওয়াই’ আর ‘খ্যোয়া খ্যোয়া চাঁদ’ গান দু’টি। নতুন করে ফিরে দেখার আমেজটাই নাকি অন্য রকম, বলছেন মিকি।
তবে শুধু গান নয়, সিনেমার ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য। যে কোনও তামিল-তেলুগু ছবি হিট করলেই বলিউড প্রযোজকদের মধ্যে প্রায় মারপিট লেগে যায়। কে আগে গিয়ে ছবিটির হিন্দি রিমেকের স্বত্ব কিনবে। টলিউডও কম যায় না। আজকাল তো অনেক ক্ষেত্রেই একই ছবির বাংলা আর হিন্দি সংস্করণ মুক্তি পায় মাস দু’তিনের ফারাকে। কেউ বানান ‘রাউডি রাঠোর’। কেউ ‘বিক্রম সিংহ’। হলিউড থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ছবি করার ঝোঁকও কম নেই। দেখে মনে হয় রিমেক/রিমিক্স-এর জনপ্রিয়তা যেন দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।
কিন্তু মঞ্চে? সেখানে কি ফিরে ফিরে আসছে পুরনো নাটক? ভেঙেচুরে নতুন করে বানানো হচ্ছে কি?
গতকাল অভিনীত হয়েছে ‘জগন্নাথ’ নাটকের নতুন সংস্করণ। মূল নাটকটি করতেন অরুণ মুখোপাধ্যায়। তিনি অসুস্থ থাকাকালীন ঠিক হয় যে ছেলে সুজন, তাঁর পরিবর্তে অভিনয় করবেন। ‘‘বাবার ওই রোলটা করতে গিয়ে খুব ভয় পেয়েছিলাম। বাবা যেন সচিন তেন্ডুলকর। সচিনের হ্যামস্ট্রিং পুল হলে যেমন অন্য কোনও ব্যাটসম্যানকে খেলতে যেতে হয়, আমিও ঠিক তাই করেছি,” বলছেন সুজন। |
‘জগন্নাথ’ নাটকের একটি দৃশ্য |
কিন্তু ‘জগন্নাথ’ করার সময় কি কখনও মনে হয়েছে নাটকটা রিমেক/রিমিক্স করি? অরিজিনাল নাটকটি এমন ভাবে ডিজাইন করেছিলেন যে, ওটাকে পালটানো খুব শক্ত, বলছেন সুজন। শুধু শরীরী অভিনয়ের মাধ্যমে নাটককে একটা অন্য জায়গায় পৌঁছে দেয়। সেখানে অভিনয় করাটা ঠিক যেন একটা অঙ্কের ফর্মুলার মতো। আর এই ফরম্যাটটা ভাঙা যায় না। নাটকটা এতটাই আধুনিক যে, ওটাতে নতুন কোনও চমক আনা খুব শক্ত। “মূল চরিত্রে অন্য অভিনেতা আসার দরুণ নাটকটি একটা নতুন চেহারা পেয়েছে। তবে এটা ‘রিক্রিয়েট’ (পুনর্সৃজন) নয়। রিমেক (পুনর্গঠন) বলব,” বললেন অরুণ। এই প্রসঙ্গে সুজন উল্লেখ করেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের একটি উক্তি। “আমি ওঁর সঙ্গে একমত। থিয়েটারের রোজ জন্ম হয়। রোজ মৃত্যু হয়। তার ফলে নাটককে রিমিক্স করা কঠিন,” বলছেন সুজন।
তবে কৌশিক সেনের পরিচালনায় ‘থানা থেকে আসছি’ দেখে সুজন মুগ্ধ। “অরিজিনালি নাটকটা কৌশিকের বাবা শ্যামল সেন করেছিলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে। বাবানদা (কৌশিক সেন) নাটকটাকে নতুন ভাবে দেখিয়েছে। মডার্ন এলিমেন্টস এনেছে। নরেন্দ্র মোদির প্রসঙ্গ এসেছে। আর কাঞ্চন মল্লিকের জীবনের এটাই হয়তো শ্রেষ্ঠ অভিনয়,” বলছেন তিনি।
পরিচালক দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের মতে বাংলা থিয়েটারে আগের মতো ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতাটা চলে গিয়েছে। “কী চলবে, সেটা বোঝার চেষ্টা করে একটা নাটক করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাতে নিজের খোঁজার চেষ্টাটা কমে আসে। এখানে পুরনো নাটককে রিভিজিট করা হয় প্রায়ই। কিন্তু পুনর্সৃজন যাকে বলে, সেটা মৌলিক নাটক নিয়ে করা হয় না। যিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সাহস দেখান, তিনি হয়তো নিজের মৌলিক লেখা নিয়েই সেটা করে থাকেন,” দেবেশ জানান।
গত বছর দেবেশ ‘ফ্যাতাড়ু’ নাটকটির পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। অরিজিনাল নাটকে ছিল রুদ্রনীল ঘোষ, স্বপন রায় আর দেবরঞ্জন নাগ। এখনকার প্রযোজনায় অভিনয়ে আছেন শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়, সতীশ সাউ আর দেবেশ নিজে। অ্যাক্টিং সোলটা একটু পাল্টালেও, নাটকের প্রোডাকশন ডিজাইনটা পাল্টায়নি। পুনর্সৃজন হিসেবে দেবেশ ব্যাখ্যা করবেন ২০১২ সালের ‘ভালমানুষ’ নাটকটি পরিচালনা করার অভিজ্ঞতাকে। অরিজিনাল টেক্সট অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। পরিচালক সেটাই রেখেছিলেন। কিন্তু প্রোডাকশন ডিজাইনটা আলাদা। গানের সুর আলাদা। অনেকেই ভয় দেখিয়েছিলেন দেবেশকে এই বলে যে, এত পালটানো উচিত নয়। “কিন্তু আমার ‘ভালমানুষ’-এ অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি ট্রিবিউট যেমন এসেছিল, ঠিক সে ভাবেই এসেছিল ব্রেশ্ট। নব্বইয়ের মাঝামাঝি অজিতেশ নাট্য অ্যাকাডেমি থেকে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল ‘তিন পয়সার পালা’। অরিজিনাল নাটকটি পুরোটাই এক রেখে করা হয়েছিল। শুধুমাত্র কিছু অভিনেতা আলাদা,” দেবেশ জানান। |
বাংলা থিয়েটারে মগজাস্ত্রের প্রয়োগ আজকাল কমে এসেছে। অনেক ক্ষেত্রেই থিয়েটারের লোকেরা খবরের কাগজ ছাড়া আর কিছুই পড়েন না। মৌলিক নাটক নিয়ে পুনর্সৃজন হয় না। ক্লাসিক নিয়ে সে চেষ্টা চোখে পড়ে
দেবেশ চট্টোপাধ্যায় |
‘জগন্নাথ’ নাটকটির পুনর্গঠন করেছি আমরা। বাংলায় নাটকের পুনর্সৃজনের চলটা কম। তার একটা কারণ হতে পারে যে এখানে সে রকম নাটকের সংখ্যা খুব কম যা যুগ যুগ পরেও ফিরে দেখা যায়
অরুণ মুখোপাধ্যায় |
|
আরও বলেন যে বাংলার মঞ্চে ক্লাসিককে পুনর্সৃজন করাটা সহজ। “লোকালাইজড স্পেস-এর হিট প্রোডাকশনগুলোকে অনেকেই রিভিজিট করেন। কিন্তু পুনর্সৃজনটা এড়িয়ে যান। হয়তো এই ভেবে যে, সেই হিটগুলো প্রায় মিথের স্টেটাসে চলে গিয়েছে। আর সেগুলো ভেঙেচুরে কিছু করতে গেলে প্রতিবন্ধকতা আসতে বাধ্য। তবে শেক্সপিয়র বা ব্রেশ্টের নাটককে পুনর্সৃজন করলে সেই ভয় থাকে না কারণ সারা বিশ্বেই অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকে এই নাটকগুলো নিয়ে,” জানাচ্ছেন দেবেশ।
যুক্তিটা হয়তো অনেকাংশে ঠিক। ‘কিং লিয়র’ থেকে ‘ম্যাকবেথ’, ‘জুলিয়াস সিজার’ থেকে ‘হ্যামলেট’ সব নাটকই অনেক বার করে রিভিজিট করা হয়েছে বাংলা মঞ্চে। অনির্বাণ ভট্টাচার্য গত বছর পরিচালনা করেছেন ‘অয়দিপাউস’। বলছেন, “আমি প্রথম থেকেই বলেছি যে, শম্ভু মিত্রের ‘অয়দিপাউস’য়ের নাটক ইতিহাস হয়ে গিয়েছে। আমাদের সেই স্পর্ধা নেই ওই নাটকের সঙ্গে কমপিট করার। আমি ‘সোফোক্লিস’ থেকে অনেকটাই সরে এসেছিলাম। হর ভট্টাচার্য আর আমি নতুন ভাবে নাটকটিকে দেখতে চেয়েছিলাম। তবু তুলনা এসেছে। তবে ক্লাসিক নাটকের ক্ষেত্রে আমি এই অ্যাটেম্পটটা নিয়েছি। কিন্তু মৌলিক নাটক হলে আমি সেটা করব না।”
তাই উৎপল দত্তের ‘টিনের তরোয়াল’ করার প্রস্তাবে রাজি হননি অনির্বাণ। ‘সাজানো বাগান’ নাটকটি অফিস ক্লাবে পরিচালনা করেছেন তিনি। কিন্তু কখনওই সেটা গ্রুপ থিয়েটারে পরিচালনা করবেন না। “যদি আমাকে বলা হয় ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’কে পুনর্সৃজন করতে, আমি রাজি হব না। আমার যত পরীক্ষা তা আমি নিজের কাজে দেখাব। তুলনা হবে জেনেও কেন অন্যের মৌলিক নাটক নিয়ে কাজ করতে যাব?” প্রশ্ন অনির্বাণের।
উৎপল দত্তের ‘মানুষের অধিকার’ নাটকটি পুনর্সৃজন করেছিলেন ব্রাত্য বসু। “নাটকে আমি পোস্ট-২০০২ সালের গুজরাতের প্রসঙ্গ এনেছিলাম। হিন্দু-মুসলমান সংঘাতের কথাও এসেছে সেখানে। ‘হ্যামলেট’কে আমি ‘ডিকন্সট্রাক্ট’ বিনির্মাণ করে ‘হেমলাট’ বানিয়েছি। আমার লেখা, পরিচালনা আর অভিনয় করা ‘অশালীন’ নাটকটি পূর্ব-পশ্চিম পুনর্গঠন করেছে। মুখ্য ভূমিকায় রাহুল। ‘চতুষ্কোণ’য়ের পুনর্গঠন করেছে আভাষ নাট্যদল,” জানান ব্রাত্য। তবে ব্রাত্য মেনে নিচ্ছেন যে, বাংলার মঞ্চে পুনর্সৃজন চলটা খুব একটা উঠে আসেনি। শেষ করছেন এই বলেই, “সবাই যেখানে মৌলিক কাজ করছেন, সেখানে পুনর্সৃজনের প্রয়োজনীয়তাটাই কেউ অনুভব করছেন না।” |
|
|
|
|
|