|
|
|
|
অনবদ্য ঋতুপর্ণা
মর্মস্পর্শী গল্প। কঠিন একটি বিষয়কে অনেক সহজ করে বলেছেন পরিচালক।
লিখছেন শ্রীলা মজুমদার |
‘মিসেস সেন’ ছবিটি নিয়ে লিখতে বসে, হঠাৎই মনে পড়ে গেল দু’টো ছবির কথা ‘আনন্দ’ আর ‘মিলি’। মিস্টার সোমনাথ সেন (রোহিত রায়)। যাঁকে ঘিরে এ ছবির গল্পের বুনন, আর সোহিনী (ঋষিতা ভট্ট) এক মিসেস সেন, এই দুই মৃত্যুকে ঘিরে গড়ে ওঠা নানা টানাপোড়েন।
বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটা মুন্সিয়ানা আছে। গল্পটা একটু ধরিয়ে দিই। সেন পরিবার। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে বিদেশে থাকে। প্রেম করে বিয়ে করা বৌ দেশে থাকে বাবা-মায়ের সঙ্গে। ছেলে মাঝে মাঝে আসে। সুখী দাম্পত্যজীবন। হঠাৎ বিদেশ থেকে খবর আসে মিস্টার সেনের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। এর পর, আর এক মিসেস সেন, অনুরাধা সেন (ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত) যায় বিদেশে। এখান থেকে গল্প শুরু হয়। এই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখে নেওয়ার দায়িত্ব আপনাদের।
এটা কাল্পনিক গল্প নয়। এ যেন সত্যিকে লুকিয়ে রাখার গল্প। জীবন থেকে উঠে আসা ঘটনা। বিদেশে মিসেস সেন অর্থাৎ ঋতুপর্ণা কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হয়। কখনও মনে হয়, ‘আমিই সত্যি’। কখনও মনে হয়, ‘আমি তো মিথ্যে। বাকি সব সত্যি’। এই সত্যি-মিথ্যের লড়াই করতে করতে জীবনকে নতুন ভাবে উপলব্ধি করেন ঋতুপর্ণা। এবং উত্তরণের পথে পৌঁছান। আর তাই বোধহয় এই গল্পটি এত মর্মস্পর্শী। হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। |
|
পরিচালক অগ্নিদেব চট্টোপাধ্যায় কোনও গিমিক বা অহেতুক গল্পটাকে দুর্বোধ্য করার চেষ্টা করেননি। খুব সাবলীল গতিতে গল্পটাকে এগিয়ে নিয়ে যান। অনেক কঠিন বিষয়কে অনেক সহজ করে বলেছেন (স্টোরি টেলিং ফর্ম)। এ ছবির মধ্যে দিয়ে দর্শকেরা পরিচালক অগ্নিদেবকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করবেন। চিত্রনাট্যকার সুদীপা মুখোপাধ্যায়- ‘চারুলতা ২০১১’, ‘তিনকন্যা’র থেকে অনেক বেশি পরিণত। নতুন প্রজন্মের চিত্রনাট্যকারদের মধ্যে ধীরে ধীরে নিজের জায়গা করে নিচ্ছেন তিনি।
এ ছবির আশি শতাংশই শু্যট করা হয়েছে তাইল্যান্ডে। অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্য। এ ছবির সিনেমাটোগ্রাফি (সিনেমাটোগ্রাফার শীর্ষ রায়) নিয়ে একটা কথাই বলা যায়, প্রতিটি ফ্রেম যেন ডেকে বলছে, ‘দ্যাখো, আমি কত সুন্দর।’ রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহারের মুহূর্তগুলো বারবার চোখকে ভিজিয়ে দিয়েছে। সম্পাদনার দিকে সাধারণত দর্শক ততটা নজর দেন না। এ ছবিতে সম্পাদক শান্তনু মুখোপাধ্যায়ের এডিটিং টাইমিং বড় চমৎকার। ভাল লেগেছে যেটা সেটা হল ছবির সব চরিত্র আলাদা আলাদা ভাবে ‘বিহেভ’ করে এবং কথা বলে। ঋতুপর্ণার দাদার চরিত্রে শঙ্কর চক্রবর্তী এককথায় অসাধারণ। তিনি যখন বোনকে এসে বলেন, “দুঃখগুলোকে বিশ্বাস কর। ওরা কখনও তোকে একা ছেড়ে যাবে না।” তখন বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে ওঠে।
অন্য দিকে ঋষিতার দাদার ভূমিকায় শুভাশিস মুখোপাধ্যায় আরও এক বার বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি জাত অভিনেতা। ঋষিতা ভট্টও ভাল। ছোট্ট একটা চরিত্রে রূপসা গুহর অভিনয় চোখে পড়ার মতো।
আর একটা কথা বলা হয়নি, ঋতুপর্ণার সাজপোশাকের মধ্যে সব চেয়ে চোখে পড়ার মতো তাঁর কপালে বড় সিঁদুরের টিপ। পরিচালক যেন জোর করেই এঁকে দিয়েছেন। স্বামীর বিপদের দিনে সেই সিঁদুরের টিপ যেন আরও গভীর হয়ে উঠেছে। তাই অনুরাধাকে দেখে আমাদের আশেপাশে সব মাসিরা নিজেদের ‘আইডেন্টিফাই’ করতে পারবেন। এ বার আমি মিসেস অনুরাধা সেন অর্থাৎ ঋতুপর্ণার কথায় আসি। এক কথায় অনবদ্য। এই সময়ের দেখা শ্রেষ্ঠ অভিনয়। স্বামীর মধ্য দিয়ে স্বামী এবং সন্তানসুখ পাওয়ার কী আকুল চেষ্টা। সাংঘাতিক সব মুহূর্তগুলোতে কোনও চড়া অভিনয়ের সাহায্য নেননি তিনি। ফলে সেই মুহূর্তগুলো অন্য মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছে। ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মিসেস সেনকে ঋতুপর্ণার ছোঁয়া লাগতে দেয়নি। যেন এ যুগের মিসেস সেন। ছবির একটা দৃশ্যে ঋতুপর্ণা বলেছেন, “তোমরা সবাই নিজেদের কথা ভাবছ আমার কথা তো কেউ ভাবছ না।” |
চোখে পড়েন ঋষিতা ভট্টও |
এই সংলাপ শুনে আমার মনে হল ঋতুপর্ণা যেন বলছেন, দীর্ঘ দিন ধরে নায়কহীন একটার পর একটা ছবি আমি একা কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছি। তোমরা তো একবারও কেউ আমার কথা ভাবলে না?
ছবি দেখতে দেখতে মনে হল ঋষিতার মৃত্যুদৃশ্য বড় দীর্ঘ। ছবির মাঝখানে যেখানে, ঋষিতা-রোহিতের ছেলে প্রিয়াংশুকে সমুদ্রের পাড়ে বসে নক্ষত্রদের চিনিয়ে দেন ঋতুপর্ণা, সেখানে ওদের মধ্যে একটা বন্ধন বা বৃত্ত তৈরি হয়। ছবির শেষে ঋতুপর্ণা যদি রোহিত রায়-ঋষিতাকে মুক্তি দেওয়ার পর ওই ছেলেটির হাত ধরতেন তা হলে বৃত্তটা সম্পূর্ণ হত। প্রশ্ন একটাই রয়ে গেল, বাচ্চাটি যে ঋতুপর্ণাকে বলেছিল ‘অনুরাধা তুমি যেও না’ তবে কি অনুরাধা ওকে ছেড়ে চলে গেল?
সব শেষে দর্শকেরা বাড়ি ফিরবেন একরাশ চোখের জল আর মন খারাপ নিয়ে, কেননা কষ্টটাই তো আসল, ওরা আমাদের একা ছেড়ে যাবে না। |
|
|
|
|
|